মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৬২
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবি-ইন্দ্রদ্যুম্নের কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবি-ইন্দ্রদ্যুম্নের কাহিনি
পাণ্ডবগণ ক্ষত্রিয়মাহাত্ম্যের বিষয়ে আরও কাহিনি শুনতে চাইলে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় এই কাহিনি বললেন - বিশ্বামিত্রের পুত্র রাজা অষ্টক অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপ্ত করে তার ভাই প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবির সঙ্গে একদিন রথে চড়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে দেবর্ষি নারদের সঙ্গে দেখা হোলো। অষ্টক নারদকে প্রণাম করে রথে তুলে নিলেন। যেতে যেতে এক ভাই নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা চারজনেই স্বর্গে যাব, কিন্তু নরলোকে কে আগে ফিরে আসবেন? নারদ বললেন, অষ্টক আগে ফিরে আসবেন। যখন আমি তার গৃহে বাস করছিলাম তখন একদিন তার সঙ্গে রথে যেতে যেতে নানা বর্ণের কয়েক হাজার গরু দেখতে পাই। আমি জিজ্ঞাসা করলে অষ্টক বললেন, আমিই এই সব গরু দান করেছি। এই অহঙ্কারের জন্যই অষ্টকের আগে পতন হবে।
আর এক ভ্রাতা প্রশ্ন করলেন, অষ্টকের পর কে নরলোকে ফিরে আসবেন? নারদ বললেন, প্রতর্দন। একদিন তার সঙ্গে আমি রথে যাচ্ছিলাম এমন সময়ে এক ব্রাহ্মণ এসে একটি ঘোড়া চাইলেন। প্রতর্দন বললেন, আমি ফিরে এসে দেবো। ব্রাহ্মণ বললেন, এখনই দিন। প্রতর্দন রথের দক্ষিণ পাশের একটি ঘোড়া রথ থেকে খুলে নিয়ে দান করলেন। তার পর আর এক ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় তাকে রথের বাম পাশের একটি ঘোড়া রথ থেকে খুলে নিয়ে দিলেন। তার পর আরও দুইজন ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় অবশিষ্ট দুই ঘোড়া দান কোরে স্বয়ং রথ টানতে টানতে বললেন, এখন আর ব্রাহ্মণদের চাইবার কিছু নেই। প্রতর্দন দান করে অহঙ্কারী হয়েছিলেন সেজন্যই তাঁর পতন হবে।
তারপর একজন প্রশ্ন করলেন, দুজনের পর কে স্বর্গচ্যুত হবেন? নারদ বললেন, বসুমনা। একদিন আমি তার গৃহে গিয়ে আশীর্বাদ করি — তোমার পুষ্পক রথ লাভ হোক। বসুমনা পুষ্পক রথ পাওয়ার পরে আমি তার প্রশংসা করলাম। তিনি বললেন, দেবর্ষি, এ রথ আপনারই। তার পর দ্বিতীয়বার আমি তার কাছে গিয়ে রথের প্রশংসা করলাম, তিনি আবার বললেন, রথ আপনারই। আমার রথের প্রয়োজন ছিল, তাই তৃতীয় বার তার কাছে গেলাম কিন্তু রথ না দিয়ে তিনি বললেন, আপনার আশীর্বাদ সত্য হয়েছে। এই কপট বাক্যের জন্যই বসুমনার পতন হবে।
তারপর একজন প্রশ্ন করলেন, বসুমনার পর কে নরলোকে ফিরে আসবেন? নারদ বললেন, শিবি স্বর্গে থাকবেন, আমারই পতন হবে। আমি শিবির সমান নই। তার কারণ বলছি শোনো - একদিন এক ব্রাহ্মণ শিবির কাছে এসে বলেছিলেন, আমি অন্নপ্রার্থী, তোমার পুত্রকে বধ করো, তার মাংস আর অন্ন রান্না কোরে আমার প্রতীক্ষায় থাকো। শিবি তার পুত্রের মাংস রান্না কোরে একটি পাত্রে রেখে তা মাথায় নিয়ে ব্রাহ্মণের খোঁজ করতে লাগলেন। একজন তাকে বললো, ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে আপনার প্রাসাদ, কোষাগার, অস্ত্রাগার, আস্তাবল, হাতিশালা সব দগ্ধ করছেন। শিবি অবিকৃত মুখে ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বললেন, আপনার অন্ন প্রস্তুত হয়েছে, ভোজন করুন। ব্রাহ্মণ বিস্ময়ে নতমুখ হয়ে রইলেন। শিবি আবার অনুরোধ করলে ব্রাহ্মণ বললেন, তুমিই খাও। শিবি ব্রাহ্মণের নির্দেশ পালন করতে উদ্যত হোলে, ব্রাহ্মণ তখন তাঁর হাত ধরে বললেন, তুমি সমস্ত ইন্দ্রিয় এবং ক্রোধকে জয় করেছো, ব্রাহ্মণের জন্য তুমি সবই ত্যাগ করতে পারো। তারপর শিবি দেখলেন, দেবকুমারতুল্য তার পুত্র সুসজ্জিত অবস্থায় তাঁর সম্মুখে রয়েছে এবং ব্রাহ্মণ অদৃশ্য হয়েছেন। তিনি স্বয়ং বিধাতা, রাজর্ষি শিবিকে পরীক্ষা করবার জন্য এসেছিলেন। অমাত্যগণ শিবিকে প্রশ্ন করলেন, কোন ফল লাভের জন্য আপনি এই কর্ম করলেন? শিবি উত্তর দিলেন, যশ বা ধন লাভ করার উদ্দেশ্যে করিনি, সজ্জনের যে আচরণ করা উচিৎ তাই আমি করেছি।
পাণ্ডবগণ মার্কণ্ডেয়কে প্রশ্ন করলেন, আপনার চেয়ে প্রাচীন কেউ আছেন কি? মার্কণ্ডেয় বললেন, পুণ্যক্ষয় হওয়ার পর রাজর্ষি ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বর্গ থেকে পতিত হয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে চেনেন কি? আমি বললাম, আমি নিজের কাজে ব্যস্ত থাকি সেজন্য সকলকে মনে রাখতে পারি না। হিমালয়ে প্রাবারকর্ণ নামে এক প্যাঁচা বাস করে, সে আমার চেয়ে প্রাচীন, হয়তো আপনাকে চেনে। ইন্দ্রদ্যুম্ন ঘোড়া হয়ে আমাকে সেই প্যাঁচার কাছে বহন কোরে নিয়ে গেলেন। প্যাঁচা তাকে বললো, তোমাকে চিনি না। তবে ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরে নাড়ীজঙ্ঘ নামে এক বক আছে, সে আমার চেয়ে প্রাচীন, তাকে প্রশ্ন করো। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আমাকে আর প্যাঁচাকে নাড়ীজঙ্ঘের কাছে নিয়ে গেলে সে বললো, আমি এই রাজাকে চিনি না। এই সরোবরে আমার চেয়ে প্রাচীন অকূপার নামে এক কচ্ছপ আছে, তাকে প্রশ্ন করো। বকের ডাক শুনে কচ্ছপ সরোবর থেকে উঠে এলো। আমাদের প্রশ্ন শুনে সে মুহূর্তকাল চিন্তা করে হাত জোড় কোরে বললো, এঁকে জানব না কেন? ইনি এখানে এক হাজার যজ্ঞ করে যূপকাষ্ঠ স্থাপন করেছিলেন। ইনি দক্ষিণাস্বরূপ যে সকল গাভী দান করেছিলেন তাদেরই বিচরণের ফলে এই সরোবর সৃষ্টি হয়েছে।
তখন স্বর্গ থেকে দেবরথ এলো এবং ইন্দ্রদ্যুম্ন দৈববাণী শুনলেন - তোমার জন্য স্বর্গ প্রস্তুত, তুমি কীর্তিমান, তোমার যোগ্য স্থানে এসো। তার পর ইন্দ্রদ্যুম্ন আমাদের সকলকে নিজ নিজ স্থানে রেখে দেবরথে স্বর্গে প্রস্থান করলেন।
______________
(ক্রমশ)