Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 72

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৭২

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত সাবিত্রী ও সত্যবানের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বর্ণিত সাবিত্রী ও সত্যবানের কাহিনি

মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে যুধিষ্ঠির বললেন, আমার নিজের জন্য, ভাইদের জন্য বা রাজ্যনাশের জন্য আমার তত দুঃখ হয় না, যত দুঃখ দ্রৌপদীর জন্য হয়। দুরাত্মারা পাশা খেলার সভায় আমাদের যে কষ্ট দিয়েছিল দ্রৌপদীই তা থেকে আমাদের উদ্ধার করেছিলেন। আবার তাকে জয়দ্রথ হরণ করলো। এই দ্রৌপদীর মতো পতিব্রতা কোনও নারীর কথা আপনি জানেন কি? যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন শুনে মার্কণ্ডেয় বললেন, মহারাজ, তুমি রাজকন্যা সাবিত্রীর পতিব্রতার কাহিনি শোনো -

মদ্র দেশে অশ্বপতি নামে এক ধর্মাত্মা রাজা ছিলেন। তিনি সন্তান কামনায় সূর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সাবিত্রীর উদ্দেশ্যে এক লক্ষ হোম করেন। আঠার বছর পূর্ণ হোলে, সাবিত্রী তুষ্ট হয়ে হোমকুণ্ড থেকে উঠে রাজাকে বর দিতে চাইলেন। অশ্বপতি বললেন, আমার বহু পুত্ৰ হোক। সাবিত্রী বললেন, তোমার অভিলাষ আমি পূর্বেই ব্রহ্মাকে জানিয়েছিলাম, তাঁর কৃপায় তোমার একটি তেজস্বিনী কন্যা হবে। আমি তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মার আদেশে এই কথা বলছি, তুমি আর কোনো বর প্রার্থনা কোরো না।

কিছুকাল পরে রাজার জ্যেষ্ঠা মহিষী এক সুদর্শনা কন্যা প্রসব করলেন। দেবী সাবিত্রী দান করেছেন বলে কন্যার নাম সাবিত্রী রাখা হল। মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় এই কন্যা ক্রমে যৌবনবতী হলেন, কিন্তু তার তেজের জন্য কেউ তাকে বিবাহ করতে চাইলেন না। একদিন অশ্বপতি সাবিত্রীকে বললেন, তোমাকে সম্প্রদান করবার সময় এসেছে, কিন্তু কেউ তোমাকে বিবাহ করতে চাইছে না। তুমি নিজেই তোমার উপযুক্ত গুণবান পতি নির্বাচন করো। এই বলে রাজা কন্যার ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিলেন। সাবিত্রী লজ্জিতভাবে পিতাকে প্রণাম করে প্রবীণ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে রথে চড়ে যাত্রা করলেন। তিনি রাজর্ষিগণের তপোবন দর্শন এবং তীর্থস্থানে ব্রাহ্মণকে ধনদান করতে লাগলেন।

একদিন মদ্ররাজ অশ্বপতি সভায় বসে নারদের সঙ্গে কথা বলছেন এমন সময় সাবিত্রী ফিরে এসে প্রণাম করলেন। নারদ বললেন, রাজা, তোমার কন্যা কোথায় গিয়েছিল ? তোমার কন্যা যুবতী হয়েছে, কন্যার বিবাহ দিচ্ছ না কেন? রাজা বললেন, দেবর্ষি, সেই উদ্দেশ্যেই একে পাঠিয়েছিলাম, এ কাকে বরণ করেছে তা শুনুন। পিতার আদেশে সাবিত্রী বললেন, শাম্ব দেশে দ্যুমৎসেন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি অন্ধ হয়ে যান এবং তার পুত্র তখনও বালক, এই সুযোগ পেয়ে শত্রু তাঁর রাজ্য দখল করে। তিনি পত্নী ও পুত্রের সঙ্গে বনে চলে আসেন এবং এখন সেখানেই তপস্যা করছেন। তার পুত্র সত্যবান যুবক  হয়েছেন, আমি তাকেই মনে মনে পতিত্বে বরণ করেছি।

নারদ বললেন, কি দুর্ভাগ্য, সাবিত্রী না জেনে সত্যবানকে বরণ করেছে। তার পিতা-মাতা সত্য কথা বলেন, সেজন্য ব্রাহ্মণরা তাদের পুত্রের নাম সত্যবান রেখেছেন। বাল্যকালে সে ঘোড়া ভালোবাসত, মাটি দিয়ে ঘোড়া তৈরী করতো, ঘোড়ার ছবি আঁকতো। সে রন্তিদেবের ন্যায় দাতা, শিবির ন্যায় ব্রাহ্মণসেবক ও সত্যবাদী, চন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন। কিন্তু অত্যন্ত গুণবান এই সত্যবানের এক বছর পরে মৃত্যু হবে।

রাজা বললেন, সাবিত্রী, তুমি আবার যাও, অন্য কাকেও বরণ করো। সাবিত্রী বললেন, পৈতৃক ধনের অংশ একবারই প্রাপ্য হয়, কন্যাদান একবারই হয়, কোনো কিছু দান কোরে একবারই ‘দিলাম’ বলা হয়। এই তিন কার্যই একবার মাত্র করা যায়। দীর্ঘায়ু বা অল্পায়ু, গুণবান বা গুণহীন, যাই হোক না কেন্, আমি একবারই পতি বরণ করেছি, দ্বিতীয় কাউকে বরণ করবো না। লোকে আগে মনে মনে কর্তব্য স্থির করে, তার পর বাক্যে প্রকাশ করে, তার পর কার্য করে। অতএব, আমি সত্যবানকে যেহেতু মনে মনে পতিরূপে বরণ করেছি, সেইহেতু তার সঙ্গেই আমার বিবাহ হবে।

নারদ বললেন, মহারাজ, তোমার কন্যা তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে, তাকে বারণ করা যাবে না। অতএব সত্যবানকেই কন্যাদান করো। নারদ আশীর্বাদ করে চলে গেলেন। রাজা অশ্বপতি বিবাহের উপকরণ সংগ্রহ করলেন এবং শুভদিনে সাবিত্রী ও পুরোহিতাদিকে নিয়ে বনের মধ্যে গিয়ে দ্যুমৎসেনের আশ্রমে উপস্থিত হলেন।

অশ্বপতি বললেন, রাজর্ষি, আমার এই সুন্দরী কন্যাকে আপনি পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করুন। দ্যুমৎসেন বললেন, আমরা রাজ্যচ্যুত হয়ে বনবাসে আছি, আপনার কন্যা কি করে কষ্ট সইবেন? অশ্বপতি বললেন, সুখ বা দুঃখ চিরস্থায়ী নয়, আমার কন্যা আর আমি তা জানি। আমি আশা করে আপনার কাছে এসেছি, আমাকে প্রত্যাখ্যান করবেন না। দ্যুমৎসেন সম্মত হলেন, আশ্রমবাসী ব্রাহ্মণগণের উপস্থিতিতে সাবিত্রী ও সত্যবানের বিবাহ সম্পন্ন হোলো। উপযুক্ত বসনভূষণ সহ কন্যাকে দান করে অশ্বপতি আনন্দিত মনে প্রস্থান করলেন। তারপর সাবিত্রী তার সমস্ত আভরণ খুলে ফেলে গেরুয়া বসন পরলেন এবং সেবার দ্বারা শ্বশুর, শাশুড়ী ও স্বামীকে তুষ্ট করলেন। কিন্তু নারদের বাক্য সর্বদাই তার মনে ছিলো।

এইরূপে অনেক দিন গত হোলো। সাবিত্রী দিন গণনা করে দেখলেন, আর চার দিন পরে তার স্বামীর মৃত্যু হবে। তিনি তিন রাত্রি উপোস থাকার সংকল্প করলেন। দ্যুমৎসেন দুঃখিত হয়ে তাঁকে বললেন, রাজকন্যা, তুমি অতি কঠোর ব্রত আরম্ভ করেছ, তিন রাত্রি উপোস অতি কষ্টকর। সাবিত্রী উত্তর দিলেন, পিতা, আপনি ভাববেন না, আমি ব্রত উদ­যাপন করতে পারবো। সত্যবানের মৃত্যুর নির্দিষ্ট দিনে সাবিত্রী সমস্ত কার্য সম্পন্ন করলেন এবং গুরুজনদের প্রণাম করে হাত জোড় কোরে রইলেন। তপোবনবাসী সকলেই তাকে আশীর্বাদ করলেন, তোমার সিঁদুর অক্ষয় হোক। সাবিত্রী ধ্যানস্থ হয়ে মনে মনে বললেন, তাই যেন হয়। শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে বললেন, তোমার ব্রত সমাপ্ত হয়েছে, এখন আহার করো। সাবিত্রী বললেন, সূর্যাস্তের পর আহার করবো এই সংকল্প করেছি।

সত্যবান কুঠার নিয়ে বনে যাচ্ছেন দেখে সাবিত্রী বললেন, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। সত্যবান বললেন, তুমি আগে কখনও বনে যাওনি, পথও কষ্টকর, তার উপর উপোস করে দুর্বল হয়ে আছ, কি করে যাবে? সাবিত্রী বললেন, উপবাসে আমার কষ্ট হয়নি, যাবার জন্য আমার আগ্রহ হয়েছে, তুমি বারণ করো না। সত্যবান বললেন, তবে আমার পিতামাতার অনুমতি নাও, তা হলে আমার দোষ হবে না। সাবিত্রীর অনুরোধ শুনে দ্যুমৎসেন বললেন, সাবিত্রী আমাদের পুত্রবধু হবার পর কিছু চেয়েছেন বলে মনে পড়ে না, অতএব এঁর ইচ্ছা পূর্ণ হোক। সাবিত্রী, তুমি সত্যবানের সঙ্গে সাবধানে যেয়ো। অনুমতি পেয়ে সাবিত্রী শঙ্কিত হৃদয়ে স্বামীর সঙ্গে গেলেন। যেতে যেতে সাবিত্রী নিরন্তর স্বামীর দিকে চেয়ে রইলেন এবং নারদের বাক্য স্মরণ করে স্বামীর মৃত্যুর কথা ভাবতে লাগলেন।

সত্যবান অনেকগুলি নানা রকম ফল পেড়ে তার পর কাঠ কাটতে লাগলেন। পরিশ্রমে তার ঘাম হোতে লাগল, মাথায় যন্ত্রণা হোতে লাগল। তিনি বললেন, সাবিত্রী, আমি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছি, আমার মাথায় ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা হচ্ছে, আমি দাঁড়াতে পারছি না। সাবিত্রী স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। মুহূর্তকাল পরে তিনি দেখলেন, এক দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণ আরক্ত নয়ন ভয়ংকর পুরুষ এসে সত্যবানকে দেখছেন, তার পরনে রক্তবস্ত্র, হাতে রশি। তাকে দেখে সাবিত্রী ধীরে ধীরে তার স্বামীর মাথা কোল থেকে নামালেন এবং উঠে দাঁড়িয়ে ভগ্নহৃদয়ে হাত জোড় কোরে বললেন, আপনাকে দেখে বুঝেছি আপনি দেবতা। আপনি কে, কি জন্য এসেছেন?

যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি পতিব্রতা তপস্বিনী, তাই তোমার সঙ্গে কথা বলছি। আমি মৃত্যুর দেবতা যম। তোমার স্বামীর আয়ু শেষ হয়েছে, আমি এঁকে রশি দিয়ে বেঁধে সঙ্গে কোরে নিয়ে যাবো। সত্যবান ধার্মিক, গুণবান, সেজন্য আমি অনুচর না পাঠিয়ে নিজেই এসেছি। এই বলে যম সত্যবানের শরীর থেকে আঙ্গুলের মতো ছোট একটি পুরুষকে রশি দিয়ে বেঁধে টেনে নিলেন, সত্যবানের প্রাণশূন্য শরীর পড়ে রইল। যম দক্ষিণ দিকে চললেন। সাবিত্রীকে পিছনে আসতে দেখে যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি স্বামীর ঋণ শোধ করেছ, এখন ফিরে গিয়ে এঁর পারলৌকিক ক্রিয়াদি সম্পন্ন করো। যমের কথায় সাবিত্রী বললেন, আমার স্বামী যেখানে যান অথবা তাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয় আমারও সেখানে যাওয়া কর্তব্য, এই সনাতন ধর্ম। আমার তপস্যা ও পতিপ্রেমের বলে এবং আপনার কৃপায় আমার গতি রুদ্ধ হবে না। পণ্ডিতরা বলেন, একসঙ্গে সাত পা গেলেই মিত্রতা হয়, সেই মিত্রতায় নির্ভর কোরে আপনাকে কিছু বলছি শুনুন। পতিহীনা নারীর পক্ষে বনে বাস করে ধর্মাচরণ করা অসম্ভব। যে ধর্মপথ সাধুজনের সম্মত সকলে তারই অনুসরণ করে, অন্য পথে যায় না। সাধুজন গার্হস্থ্য ধর্মকেই সর্বোত্তম বলেন।

যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি আর এসো না, ফিরে যাও। তোমার বিনম্র ভাষা আর যুক্তিসম্মত কথা শুনে আমি তুষ্ট হয়েছি, তুমি বর চাও। সত্যবানের জীবন ভিন্ন যা চাও তাই দেবো। সাবিত্রী বললেন, আমার শ্বশুর অন্ধ ও রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছেন, আপনার বরে তিনি দৃষ্টিশক্তি লাভ করুন। যম বললেন, তাই হবে। তোমাকে পথশ্রমে ক্লান্ত দেখছি, তুমি ফিরে যাও।

সাবিত্রী বললেন, স্বামীর সঙ্গে থাকলে আমার ক্লান্তি হবে কেন? তার যে গতি আমারও সেই গতি। তা ছাড়া আপনার মতো সজ্জনের সঙ্গে থাকলে পূণ্য অর্জন হয়, সেজন্য সাধুসঙ্গেই থাকা উচিত। যম বললেন, তুমি যে হিতবাক্য বললে তা শ্রুতিমধুর। সত্যবানের জীবন ভিন্ন দ্বিতীয় একটি বর চাও। সাবিত্রী বললেন, আমার শ্বশুর তার রাজ্য পুনর্বার লাভ করুন, তিনি যেন স্বধর্ম পালন করতে পারেন।

যম বললেন, সাবিত্রী, তোমার কামনা পূর্ণ হবে, এখন ফিরে যাও। সাবিত্রী বললেন, আপনি জগতের লোককে নিয়ম অনুসারে সংযত রাখেন এবং আয়ু শেষ হোলে তাদের কর্ম অনুসারে নিয়ে যান, আপনার নিজের ইচ্ছায় নয়, এজন্যই আপনার নাম যম। আমার আর একটি কথা শুনুন। কর্ম মন ও বাক্য দ্বারা কোনও প্রাণীর অনিষ্ট না করা, অনুগ্রহ ও দান করা, এই সনাতন ধর্ম। জগতের লোক সাধারণত অল্পায়ু ও দুর্বল, সেজন্য সাধুজন শরণাগত শত্রুকেও দয়া করেন। যম বললেন, তৃষ্ণার্তের জন্য যেমন জল, তেমনই তোমার বাক্য। কল্যাণী, সত্যবানের জীবন ভিন্ন আর একটি বর চাও।

সাবিত্রী বললেন, আমার পিতা পুত্রহীন, বংশরক্ষার জন্য তাঁর যেন শতপুত্র হয়, এই তৃতীয় বর আমি চাচ্ছি। যম বললেন, তাই হবে। তুমি বহুদূরে এসে পড়েছ, এখন ফিরে যাও। সাবিত্রী বললেন, আমার পক্ষে এ দূর নয়, কারণ আমি স্বামীর নিকটে আছি। আপনি বিবস্বানের (সূর্যের) পুত্র, সেজন্য আপনি বৈবস্বত, আপনি ধর্ম অনুসারে প্রজাশাসন করেন সেজন্য আপনি ধর্মরাজ। আপনি সজ্জন, সজ্জনের উপরে যেমন বিশ্বাস হয় তেমন নিজের উপরেও হয়।

যম বললেন, তুমি যা বলছ তেমন প্রিয় বাক্য আমি কোথাও শুনিনি। তুমি সত্যবানের জীবন ভিন্ন আর একটি বর চাও। সাবিত্রী বললেন, আমার গর্ভে সত্যবানের ঔরসে যেন বলবীর্যশালী শতপুত্র হয়, এই চতুর্থ বর চাচ্ছি। যম বললেন, বলবীর্যশালী শতপুত্র তোমাকে আনন্দিত করবে। সাবিত্রী, তুমি অনেক দূর এসেছ, এখন ফিরে যাও।

সাবিত্রী বললেন, সাধুজন সর্বদাই ধর্মপথে থাকেন, তারা দান করে অনুতপ্ত হন না। তাদের অনুগ্রহ ব্যর্থ হয় না, তাদের কাছে কারও প্রার্থনা বা সম্মান নষ্ট হয় না, তারা সকলেরই রক্ষক। যম বললেন, তোমার ধর্মসম্মত বাক্য শুনে তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধ হয়েছে। পতিব্রতা, তুমি আর একটি বর চাও।

সাবিত্রী বললেন, হে ধর্মরাজ, যে বর আমাকে দিয়েছেন তা আমার পুণ্য না থাকলে আপনি দিতেন না। সেই পুণ্যবলে এই বর চাচ্ছি যে, সত্যবান জীবনলাভ করুন, পতি বিনা আমি মৃতের মতো হয়ে আছি। পতিহীন হয়ে আমি সুখ চাই না, স্বর্গ চাই না, বাঁচতেও চাই না। আপনি শতপুত্রের বর দিয়েছেন, অথচ আমার পতির প্রাণ হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। সত্যবান বেঁচে উঠুন এই বর চাচ্ছি, তাতে আপনার বাক্য সত্য হবে। ধর্মরাজ যম বললেন, তাই হবে। সত্যবানকে বন্ধনমুক্ত করে যম হৃষ্টচিত্তে বললেন, তোমার পতিকে মুক্তি দিলাম, ইনি নীরোগ বলবান ও সফলকাম হবেন, চার শত বৎসর তোমার সঙ্গে জীবিত থাকবেন, যজ্ঞ ও ধর্মকার্য করে খ্যাতিলাভ করবেন।

যম চলে গেলে সাবিত্রী তার স্বামীর মৃতদেহের নিকট ফিরে এলেন। তিনি সত্যবানের মাথা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, রাজপুত্র, তুমি বিশ্রাম করেছ, তোমার নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে, এখন ওঠো। দেখ, রাত্রি গভীর হয়েছে। সত্যবান জ্ঞান লাভ করে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, তারপর বললেন, আমি মাথার যন্ত্রণায় কাতর হয়ে তোমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তুমি আমাকে আলিঙ্গন করে ধরে ছিলে। আমি ঘুমন্ত অবস্থায় ঘোর অন্ধকার এবং এক মহাতেজা পুরুষকে দেখেছি। একি স্বপ্ন না সত্য? সাবিত্রী বললেন, কাল তোমাকে বলবো। এখন রাত্রি গভীর হয়েছে, ওঠো, পিতা-মাতার কাছে চলো। সত্যবান বললেন, এই ভয়ানক বনে ঘন অন্ধকারে পথ দেখতে পাবে না। সাবিত্রী বললেন, এই বনে একটি গাছে আগুন জ্বলছে, তা থেকে আগুন এনে আমাদের চারিদিকে জ্বালব, কাঠ আমাদের কাছেই আছে। তোমাকে দুর্বল দেখাচ্ছে, যদি যেতে না পারো তবে আমরা এখানেই রাত্রিযাপন করবো। সত্যবান বললেন, আমি সুস্থ হয়েছি, ফিরে যেতে চাই। সাবিত্রী তার চুল বেঁধে দুই হাত দিয়ে স্বামীকে তুললেন এবং তার বাঁ হাত নিজের কাঁধে রেখে নিজের ডান হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে চললেন। সত্যবান বললেন, এই পলাশবনের উত্তর দিকের পথ দিয়ে দ্রুত চলো, আমি এখন সুস্থ হয়েছি, পিতামাতাকে শীঘ্র দেখতে চাই।

এই সময়ে দ্যুমৎসেন দৃষ্টিশক্তি লাভ করলেন। সত্যবান না আসায় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর পত্নী শৈব্যার সঙ্গে চারিদিকে তাকে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলেন। আশ্রমবাসী ঋষিরা তাদের ফিরিয়ে এনে নানাভাবে আশ্বাস দিলেন। এমন সময় সাবিত্রী সত্যবানকে নিয়ে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তখন ব্রাহ্মণরা আগুন জ্বাললেন এবং শৈব্যা সত্যবান ও সাবিত্রীর সঙ্গে সকলে রাজা দ্যুমৎসেনের নিকটে বসলেন। সত্যবান জানালেন যে তিনি মাথার যন্ত্রণায়  কাতর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেজন্য ফিরতে বিলম্ব হয়েছে। গৌতম নামে এক ঋষি বললেন, তোমার পিতা হঠাৎ দৃষ্টিশক্তি লাভ করেছেন, তুমি এর কারণ জান না। সাবিত্রী, তুমি বলতে পারবে, তুমি সবই জানো, তোমাকে ভগবতী সাবিত্রী দেবীর সমতুল্য মনে করি। যদি গোপনীয় না হয়, তো বলো।

সাবিত্রী বললেন, নারদের কাছে শুনেছিলাম যে, আমার পতির মৃত্যু হবে। আজ সেইদিন, সেজন্য আমি পতির সঙ্গ ছাড়িনি। তারপর সাবিত্রী যমের আগমন, সত্যবানকে গ্রহণ, এবং স্তবে প্রসন্ন হয়ে পাঁচটি বরদান প্রভৃতি সমস্ত ঘটনা বললেন। ঋষিরা বললেন, সাবিত্রী, তুমি পতিপরায়ণা সতী, সুশীলা এবং বিপদগ্রস্ত রাজবংশকে তুমি উদ্ধার করেছ। তারপর তারা সাবিত্রীর বহু প্রশংসা কোরে হৃষ্টচিত্তে চলে গেলেন। পরদিন সকালে শাম্বদেশের প্রজারা এসে দুমৎসেনকে জানালে যে তার মন্ত্রী শত্রুকে পরাজিত করেছেন এবং রাজাকে নিয়ে যাবার জন্য উপস্থিত হয়েছেন। দ্যুমৎসেন তার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন এবং সত্যবানকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তার পর সাবিত্রীর শত পুত্রের জন্ম হোলো এবং অশ্বপতির ঔরসে মালবীর গর্ভে সাবিত্রীর এক শত ভাইয়ের জন্ম হোলো।

______________

(ক্রমশ)