Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 74

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৭৪

যক্ষ এবং যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নোত্তরের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

যক্ষ এবং যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নোত্তরের কাহিনি

একদিন এক ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বললেন, আমার অরণি আর মন্থ (আগুন জ্বালানোর জন্য দুটি কাঠের টুকরো) গাছে টাঙানো ছিল, এক হরিণ এসে তার শিঙে আটকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। আপনারা তা উদ্ধার করে দিন যাতে আমাদের অগ্নিহোত্র বন্ধ না হয়। যুধিষ্ঠির তখনই তাঁর ভাইদের সঙ্গে হরিণের খোঁজে বেরিয়ে পড়লেন। তারা হরিণকে দেখতে পেয়ে নানাপ্রকার বাণ নিক্ষেপ করলেন কিন্তু সেগুলি হরিণের গায়ে লাগল না। তার পর সেই হরিণকে আর দেখা গেল না। পাণ্ডবগণ শ্রান্ত হয়ে দুঃখিত মনে বনের মধ্যে এক বটগাছের ছায়ায় বসলেন।

নকুল বললেন, আমাদের বংশে কখনও ধর্মলোপ হয়নি, অলসতার জন্য কোনও কার্য বিফল হয়নি, আমারা কোনও প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিই নি। কিন্তু আজ আমাদের শক্তির সম্বন্ধে সংশয় উপস্থিত হোলো কেন? যুধিষ্ঠির বললেন, বিপদ কত প্রকার হয় তার সীমা নেই, কারণও জানা যায় না, ধর্মই পাপ ও পুণ্যের ফল ভাগ করে দেন। ভীম বললেন, দুঃশাসন দ্রৌপদীর অপমান করেছিল তথাপি তাকে আমি বধ করি নি, সেই পাপে আমাদের এই দশা হয়েছে। অর্জুন বললেন, কর্ণের তীক্ষ্ণ কটু কথা সহ্য করেছিলাম, তারই এই ফল। সহদেব বললেন, শকুনি যখন পাশা খেলায় জয়ী হয় তখন আমি তাকে হত্যা করিনি সেজন্য এমন হয়েছে।

পাণ্ডবগণ তৃষ্ণার্ত হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে নকুল বটগাছে উঠে চারিদিক দেখে জানালেন, জলের ধারে জন্মায় এমন অনেক গাছ দেখা যাচ্ছে, সারসের ডাকও শোনা যাচ্ছে, অতএব নিকটেই জল পাওয়া যাবে। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি শীঘ্র গিয়ে জল নিয়ে এসো।

নকুল জলের কাছে উপস্থিত হয়ে পান করতে গেলেন, এমন সময়ে শুনলেন আড়াল থেকে কেউ বলছে - বৎস, এই জল আমার অধিকারে আছে, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তার পর পান কোরো। তৃষ্ণার্ত নকুল সেই কথা না মেনে করে জলপান করলে তখনই মাটিতে পড়ে গেলেন।

নকুল ফিরছে না দেখে যুধিষ্ঠির সহদেবকে পাঠালেন। সহদেবও নকুলের মতো একই বারণ না মেনে জলপান করে মাটিতে পড়ে গেলেন। তারপর যুধিষ্ঠির একে একে অর্জুন ও ভীমকে পাঠালেন, তাঁরাও সহদেব ও নকুলের মতো বারণ না মেনে জলপান করে মাটিতে পড়ে গেলেন। ভাইয়েরা কেউ ফিরে না আসায় যুধিষ্ঠির উদ্বিগ্ন হয়ে সেই নির্জন বনে প্রবেশ করলেন এবং এক পদ্মফুলের শোভিত সরোবর দেখতে পেলেন। সেই সরোবরের তীরে ভাইদের ধনুর্বাণ পড়ে রয়েছে এবং তার ভাইয়েরা প্রাণহীন হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। এই দৃশ্য দেখে যুধিষ্ঠির শোকে আকুল হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। ভাইদের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, মাটিতে অন্য কারও পায়ের চিহ্ন নেই দেখে যুধিষ্ঠির ভাবলেন কোনও মহা বলশালী প্রাণী এঁদের বধ করেছে, অথবা দুর্যোধন বা শকুনি এই গুপ্তহত্যা করিয়েছে।

যুধিষ্ঠির সরোবরে নেমে জলপান করতে গেলেন এমন সময় আড়াল থেকে শুনলেন — আমি মাছ ও শ্যাওলা ভোজনকারী বক, আমিই তোমার ভাইদের পরলোকে পাঠিয়েছি। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যদি জলপান করো তবে তুমিও সেখানে যাবে। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি কি কোনো দেবতা? মহা বলশালী আমার চার ভাইকে আপনি হত্যা করেছেন, আপনার অভিপ্রায় কি তা বুঝতে পারছি না, আমার অত্যন্ত ভয় হচ্ছে, কৌতুহলও হচ্ছে। আপনি কে? যুধিষ্ঠির এই উত্তর শুনলেন — আমি যক্ষ।

তখন তালগাছের মতো বিশাল দেহ ও আগুনের মতো তেজস্বী এক যক্ষ গাছে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, রাজা, আমি বহুবার বারণ করেছিলাম তথাপি তোমার ভাইয়েরা জলপান করতে গিয়েছিল, তাই আমি তাদের মেরেছি। যুধিষ্ঠির, তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তার পর জলপান কোরো। যুধিষ্ঠির বললেন যক্ষ, তোমার অধিকারে থাকা জল আমি পান করতে চাই না। তুমি প্রশ্ন করো, আমি নিজের বুদ্ধি অনুসারে উত্তর দেবো।

তারপর যক্ষ একে একে এই প্রশ্ন করলেন, যুধিষ্ঠিরও তার উত্তর দিলেন —

যক্ষ - কে সূর্যকে আকাশে রেখেছে? কে সূর্যের চারদিকে ভ্রমণ করে? কে তাঁকে অস্তে পাঠায়? কোথায় তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন?

যুধিষ্ঠির - ব্রহ্মা সূর্যকে আকাশে রেখেছেন, দেবতাগণ তাঁর চারদিকে ভ্রমণ করেন, ধর্ম তাকে অস্তে পাঠান, সত্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন।

যক্ষ - ব্রাহ্মণের দেবত্ব কি কারণে হয়? কোন্ ধর্মের জন্য তারা সাধু? তাদের মানুষভাব কেন হয়? অসাধুভাব কেন হয়?

যুধিষ্ঠির – বেদ অধ্যায়নের ফলে তাদের দেবত্ব, তপস্যার ফলে সাধুতা, তাদের মৃত্যু হয় এজন্য তারা মানুষ, পরের নিন্দা করার জন্য তারা অসাধু হন।

যক্ষ - ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব কি? সাধুর ধর্ম কি? মানুষভাব কি? অসাধুভাব কি?

যুধিষ্ঠির – অস্ত্রে দক্ষতা ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব, যজ্ঞ সাধুর ধর্ম, ভয় মানুষভাব, শরণাগতকে পরিত্যাগ করা অসাধুভাব।

যক্ষ - পৃথিবী অপেক্ষা গুরুভার কে? আকাশ অপেক্ষা উচ্চ কে? বায়ু অপেক্ষা দ্রুতগামী কে? তৃণ অপেক্ষা অধিক কে?

যুধিষ্ঠির - মাতা পৃথিবী অপেক্ষা গুরুভার, পিতা আকাশ অপেক্ষা উচ্চ, মন বায়ু অপেক্ষা দ্রুতগামী, চিন্তা তৃণ অপেক্ষা অধিক।

যক্ষ – নিদ্রিত থেকেও কে চোখ বন্ধ করে না? জন্মগ্রহণ করেও কে নড়াচড়া করে না? কার হৃদয় নেই? বেগ দ্বারা কে বৃদ্ধি পায়?

যুধিষ্ঠির - মাছ নিদ্রিত থেকেও চোখ বন্ধ করে না, ডিম জন্মগ্রহণ করেও নড়াচড়া করে না, পাথরের হৃদয় নেই, নদী বেগ দ্বারা বৃদ্ধি পায়।

যক্ষ - প্রবাসী, আতুর ও মুমূর্য—এদের মিত্র কারা ?

যুধিষ্ঠির - প্রবাসীর মিত্র সঙ্গী, আতুরের মিত্র চিকিৎসক, মুমূর্যুর মিত্র দান।

যক্ষ - কি ত্যাগ করলে মানুষের প্রিয় হওয়া যায়? কি ত্যাগ করলে শোক হয় না? কি ত্যাগ করলে মানুষ ধনী হয়? কি ত্যাগ করলে সুখী হয়?

যুধিষ্ঠির - অভিমান ত্যাগ করলে মানুষের প্রিয় হওয়া যায়, ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক হয় না, কামনা ত্যাগ করলে লোকে ধনী হয়, লোভ ত্যাগ করলে সুখী হয়।

তার পর যক্ষ বললেন, আশ্চর্য কি? পন্থা কি? সুখী কে? আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জলপান করো। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন - প্রাণিগণের প্রত্যহ মৃত্যু হচ্ছে, তথাপি অবশিষ্ট সকলে চিরজীবী হোতে চায়, এর চেয়ে আশ্চর্য কি আছে? বেদ বিভিন্ন, স্মৃতি বিভিন্ন, বিভিন্ন মুনির মত বিভিন্ন। ধর্মের তত্ত্ব অত্যন্ত গভীর, অতএব বিখ্যাত সাধু ব্যক্তিরা যে পথে গেছেন তাই পন্থা। যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে সন্ধ্যাকালে শাক রন্ধন কোরে ভোজন করে সেই সুখী।

যক্ষ বললেন, তুমি আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছ। এখন বলো, পুরুষ কে? সমস্ত ধনের অধীশ্বর কে?

যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন - পুণ্যকর্মের প্রশংসা স্বর্গ ও পৃথিবী স্পর্শ করে আর যত কাল সেই প্রশংসা বজায় থাকে তত কালই লোকে পুরুষরূপে গণ্য হয়। প্রিয়-অপ্রিয়, সুখ-দুঃখ, অতীত ও ভবিষ্যৎ যিনি সমান ভাবে গণ্য করেন তিনিই সমস্ত ধনের অধীশ্বর।

যক্ষ বললেন, রাজা, তুমি এক ভাইয়ের নাম বলো যাকে বাঁচাতে চাও। যুধিষ্ঠির বললেন নকুল জীবনলাভ করুক।

যক্ষ বললেন, ভীমসেন তোমার প্রিয় এবং অর্জুন তোমার অবলম্বন, এঁদের ছেড়ে দিয়ে, বৈমাত্রেয় ভাই নকুলের জীবন চাইছ কেন?

যুধিষ্ঠির বললেন, যদি আমি ধর্ম পালন না করি তবে ধর্মই আমাকে বিনষ্ট করবেন। কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেই আমার পিতার স্ত্রী, এঁদের দুজনেরই পুত্র থাকুক এই আমার ইচ্ছা, আমি দুই মাতাকেই সমান জ্ঞান করি।

যক্ষ বললেন, যুধিষ্ঠির তুমি অর্থ ও কাম অপেক্ষা অহিংসাকে শ্রেষ্ঠ মনে করো, অতএব তোমার সকল ভাইয়েরাই জীবনলাভ করুক।

যক্ষের কথায় ভীম, অর্জুন, সহদেব ও নকুল সকলেই বেঁচে উঠলেন, তাদের ক্ষধা ও পিপাসা দূর হোলো। যুধিষ্ঠির যক্ষকে বললেন, আপনি অপরাজিত হয়ে এই সরোবরের তীরে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনি কোন্ দেবতা? আমার এই মহাবীর ভাইদের বধ করতে পারেন এমন যোদ্ধা আমি দেখি না। এঁরা সুখে অক্ষতদেহে বেঁচে উঠেছেন।

যক্ষ বললেন, বৎস, আমি তোমার পিতা ধর্মরাজ যম। তুমি বর চাও। যুধিষ্ঠির বললেন, যার অরণি ও মন্থ হরিণ নিয়ে গেছে সেই ব্রাহ্মণের অগ্নিহোত্র যেন বন্ধ না হয়। ধর্ম বললেন, তোমাকে পরীক্ষা করবার জন্য আমিই হরিণের রূপে অরণি ও মন্থ হরণ করেছিলাম, এখন তা ফিরিয়ে দিচ্ছি। তুমি অন্য বর চাও। যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের বারো বছর বনে অতিবাহিত হয়েছে, এখন তেরোতম বছর। আমরা যেখানেই থাকি, কোনও লোক যেন আমাদের চিনতে না পারে। ধর্ম বললেন, তাই হবে, তোমার নিজ রূপে বিচরণ করলেও কেউ চিনতে পারবে না। তোমরা তেরোতম বছর বিরাট রাজার নগরে অজ্ঞাত হয়ে থেকো, তোমরা যেমন ইচ্ছা সেইপ্রকার রূপ ধারণ করতে পারবে।

তার পর পাণ্ডবগণ আশ্রমে ফিরে গিয়ে ব্রাহ্মণকে অরণি ও মন্থ দিলেন।

______________

(ক্রমশ)