মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৭৭
কীচক দ্বারা দ্রৌপদীকে পদাঘাত করার কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
কীচক দ্বারা দ্রৌপদীকে পদাঘাত করার কাহিনি
পাণ্ডবরা বিরাট রাজার রাজধানীতে দশ মাস অজ্ঞাতবাসে কাটানোর পার একদিন বিরাটের সেনাপতি কীচক তার বোন রানী সুদেষ্ণার ভবনে অপরূপা দ্রৌপদীকে দেখতে পেলেন। তিনি কামার্ত হয়ে সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, বিরাট রাজার ভবনে এই রমণীকে আমি পূর্বে দেখিনি। মদিরার গন্ধ যেমন পাগল কোরে দেয়, এই রমণীর রূপ তেমন আমাকে পাগল করেছে। এই মনোহারিণী সুন্দরী কে, কোথা থেকে এসেছে? তোমার এই পরিচারিকা যে কাজ করছে তা তার যোগ্য নয়, সে আমার ভবনে এসে আমার সমস্ত সম্পত্তির হকদার হোক এবং আমার ভবনের শোভা বর্ধন করুক।
শিয়াল যেমন সিংহীর কাছে যায় তেমন কীচক দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, সুন্দরী, তোমার রূপ ও যৌবন বৃথা নষ্ট হচ্ছে। বিধুমুখী, আমার পুরাতন স্ত্রীদের আমি ত্যাগ করবো, তারা তোমার দাসী হবে, আমি তোমার দাস হবো। দ্রৌপদী উত্তর দিলেন, আমি নিম্নবর্ণের সৈরিন্ধ্রী, কেশ বিন্যাসের মতো সামান্য কাজ করি, আপনার কামনার যোগ্য নই। আমি পরের পত্নী, বীরগণ আমাকে রক্ষা করেন। যদি আমাকে পাবার চেষ্টা করেন তবে আমার গন্ধর্ব পতিগণ আপনাকে বধ করবেন। অবোধ বালক যেমন নদীর এক তীরে থেকে অন্য তীরে যেতে চায়, রোগার্ত যেমন মৃত্যুর কামনা করে, মায়ের কোলের শিশু যেমন চাঁদ পেতে চায়, আপনি সেইরূপ আমাকে চাইছেন।
দ্রৌপদী প্রত্যাখ্যান করায় কীচক সুদেষ্ণার কাছে গিয়ে বললেন, সৈরিন্ধ্রী যাতে আমার কাছে আসে সেই উপায় করো, তবেই আমার জীবনরক্ষা হবে। সুদেষ্ণা তার ভাই কীচকের ইচ্ছা, নিজের কল্যাণ এবং দ্রৌপদীর উদ্বেগ সম্বন্ধে চিন্তা করে বললেন, তুমি কোনও উপলক্ষ্যে নিজের ভবনে মদিরা ও অন্নাদি প্রস্তুত করাও, আমি সুরা আনবার জন্য সৈরিন্ধ্রীকে তোমার কাছে পাঠাব, তখন তুমি নির্জন স্থানে তাকে মিষ্টির কথায় রাজি করিও।
উত্তম মদিরা, ছাগল শূকর প্রভৃতির মাংস এবং অন্যান্য খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত করিয়ে কীচক সুদেষ্ণাকে নিমন্ত্রণ করলেন। সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি কীচকের ভবন থেকে পানীয় নিয়ে এসো, আমার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। দ্রৌপদী বললেন, রানী, আমি কীচকের কাছে যাব না, তিনি নির্লজ্জ। আমি ব্যভিচারিণী হোতে পারব না, আপনার কাছে কাজে নিযুক্ত হবার কালে যে সমস্ত অঙ্গিকার করেছিলাম তা আপনি জানেন। আপনার অনেক দাসী আছে, তাদের কাউকে পাঠান। সুদেষ্ণা বললেন, আমি তোমাকে পাঠালে কীচক তোমার কোনও অনিষ্ট করবেন না। এই বলে তিনি দ্রৌপদীকে একটি ঢাকনিযুক্ত স্বর্ণময় পানপাত্র দিলেন।
দ্রৌপদী শঙ্কিতমনে কীচকের ভবনে গেলেন এবং ক্ষণকাল সূর্যের আরাধনা করলেন। সূর্যের আদেশে এক রাক্ষস অদৃশ্যভাবে দ্রৌপদীকে রক্ষা করতে লাগল।
দ্রৌপদীকে দেখে কীচক আনন্দে ব্যস্ত হয়ে উঠে বললেন, সুন্দরী, আজ আমার জন্য অত্যন্ত ভালো দিন, তুমি আমার আরাধ্যা, তোমাকে আমি সোনার হার, শাঁখা, কুণ্ডল, কেয়ূর, মণিরত্ন ও উত্তম বস্ত্রাদি দেবো। তোমার জন্য আরামদায়ক শয্যা প্রস্তুত আছে, সেখানে চলো, আমার সঙ্গে মাধ্বী পান করো। দ্রৌপদী বললেন, রাজমহিষী আমাকে মদিরা নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। কীচক বললেন, দাসীরা তা নিয়ে যাবে। এই বলে তিনি দ্রৌপদীর হাত এবং আঁচল ধরলেন, দ্রৌপদী ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলেন। কীচক আবার সবলে ধরলে, দ্রৌপদী তাকে প্রবল ধাক্কা দিলেন, পাপাত্মা কীচক মাটিতে পড়ে গেলেন। দ্রৌপদী দ্রুতবেগে বিরাট রাজার সভায় এলেন, কীচক সঙ্গে সঙ্গে এসে রাজার সামনেই দ্রৌপদীর চুল ধরে তাঁকে পদাঘাত করলেন। তখন সেই সূর্য দ্বারা নিযুক্ত রাক্ষস অদৃশ্য থেকে কীচককে আঘাত করলে, কীচক ঘুরতে ঘুরতে উপড়ে পড়া গাছের মতো মাটিতে পড়ে গেলেন।
রাজসভায় যুধিষ্ঠির ও ভীম উপস্থিত ছিলেন। দ্রৌপদীর অপমান দেখে কীচককে বধ করবার ইচ্ছায় ভীম দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগলেন। পাছে লোকে তাদের চিনে ফেলে এই ভয়ে যুধিষ্ঠির ইশারায় ভীমকে নিবারণ করলেন। দ্রৌপদী তাঁদের দিকে একবার কঠিনভাবে তাকিয়ে বিরাট রাজাকে উদ্দেশ্যে কোরে বললেন, যাঁদের শত্রু বহুদূর দেশে বাস করেও ভয়ে ঘুমাতে পারেনা, তাঁদেরই আমি স্ত্রী, সেই আমাকে কীচক পদাঘাত করেছে! যাঁরা শরণাপন্নকে রক্ষা করেন সেই মহাবীরগণ আজ কোথায় আছেন? বিরাট যদি কীচককে ক্ষমা করে ধর্ম নষ্ট করেন তবে আমি কি করতে পারি? রাজা, আপনি কীচকের প্রতি রাজার মতো আচরণ করছেন না, আপনার ধর্ম দস্যুর ধর্ম, তা এই রাজসভায় শোভা পাচ্ছে না। কীচক ধার্মিক নয়, মহারাজ বিরাটও ধার্মিক নন, উপস্থিত সভাসদগণও ধার্মিক নন।
ক্রন্দনরতা দ্রৌপদীর তিরস্কার শুনে বিরাট বললেন, সৈরিন্ধ্রী, আমার অজ্ঞাতে তোমাদের কি বিবাদ হয়েছে তা আমি জানি না। সঠিক তথ্য না জেনে আমি কি কোরে বিচার করবো? সভাসদ্গণ দ্রৌপদীর প্রশংসা এবং কীচকের নিন্দা করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী যার স্ত্রী তিনি মহাভাগ্যবান। এরূপ অপরূপা সুন্দরী মনুষ্যলোকে দেখা যায় না, বোধ হয় ইনি দেবী।
ভীষণ রাগে যুধিষ্ঠিরের কপাল ঘর্মাক্ত হোলো। তিনি বললেন, সৈরিন্ধ্রী, তুমি এখানে থেকো না, দেবী সুদেষ্ণার ভবনে যাও। আমার মনে হয় তোমার গন্ধর্ব পতিদের বিবেচনায় এই সময় রাগ প্রকাশের উপযুক্ত নয়, নতুবা তারা প্রতিশোধের জন্য দ্রুতবেগে উপস্থিত হতেন। তুমি আর এখানে কান্নাকাটি করো না, তাতে এই রাজসভায় যাঁরা পাশা খেলছেন তাদের বিঘ্ন হবে। তুমি যাও, গন্ধর্বগণ তোমার দুঃখ দূর করবেন।
দ্রৌপদী বললেন, যাঁদের বড় ভাই পাশা খেলায় আসক্ত সেই অতীব দয়ালুর জন্যই আমাকে ব্রতচারিণী হতে হয়েছে। আমার অপমানকারীদের বধ করাই তাদের উচিত ছিলো। এই কথা বলে দ্রৌপদী অন্দরে চলে গেলেন। তার কান্নার কারণ শুনে সুদেষ্ণা বললেন, আমার কথাতেই তুমি কীচকের কাছে মদিরা আনতে গিয়ে অপমানিত হয়েছ, যদি চাও তবে রাজাকে বলে তাকে প্রাণদণ্ড দেওয়াব। দ্রৌপদী বললেন, কীচক যাঁদের কাছে অপরাধী তাঁরাই তাকে বধ করবেন, সে আজই পরলোকে যাবে।
দ্রৌপদী নিজের কক্ষে গিয়ে স্নান কোরে বসন ধুয়ে ফেললেন। তিনি দুঃখে কাতর হয়ে স্থির করলেন, ভীম ভিন্ন আর কেউ কীচককে শাস্তি দিতে পারবেন না। রাতে তিনি বিছানা থেকে উঠে ভীমের কক্ষে গেলেন এবং সিংহী যেমন সিংহকে আলিঙ্গন করে তেমন ভীমকে আলিঙ্গন কোরে বললেন, ভীম ওঠো, মৃতের মতো শুয়ে আছ কেন? যে জীবিত, তার স্ত্রীকে স্পর্শ করে কোনও পাপী বাঁচতে পারে না। পাপিষ্ঠ সেনাপতি কীচক আমাকে পদাঘাত করে এখনও বেঁচে আছে, তুমি কি করে ঘুমিয়ে আছো?
ভীম জেগে উঠে বললেন, তুমি ব্যস্ত হয়ে কেন এসেছ? সুখ দুঃখ প্রিয় অপ্রিয় যা ঘটেছে সব বলো। দ্রৌপদী, তুমি সব বিষয়ে আমাকে বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে সর্বদা বিপদ থেকে মুক্ত করবো। তোমার বক্তব্য বলে শীঘ্র নিজের ঘরে চলে যাও, যাতে কেউ জানতে না পারে।
______________
(ক্রমশ)