Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 80

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৮০

সুশর্মা কর্তৃক মত্স্যরাজ্যের দক্ষিণ দিক আক্রমণ ও পরাজয়ের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

সুশর্মা কর্তৃক মত্স্যরাজ্যের দক্ষিণ দিক আক্রমণ ও পরাজয়ের কাহিনি

দুর্যোধনাদির সঙ্গে মন্ত্রণা কোরে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর দিন সুশর্মা সসৈন্যে বিরাটরাজ্যের দক্ষিণ দিকে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবগণের নির্বাসনের তেরো বছর যেদিন পূর্ণ হোলো সেইদিন সুশর্মা বিরাটের কয়েক হাজার গরু হরণ করলে, একজন গোপ দ্রুত রাজসভায় গিয়ে বিরাটকে সেই সংবাদ জানালো। বিরাট তখনই তার সেনাদলকে প্রস্তুত হতে আদেশ দিলেন। বিরাট, তার ভাই শতানীক এবং জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র শঙ্খ যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হলেন। বিরাট বললেন, কঙ্ক, বল্লভ, তন্তিপাল ও গ্রন্থিক এঁরাও বলবান এবং যুদ্ধ করতে সমর্থ, এঁদেরও অস্ত্রশস্ত্র, কবচ আর রথ দাও। রাজার আদেশ অনুসারে শতানীক যুধিষ্ঠিরাদিকে অস্ত্র, রথ ইত্যাদি দিলে তারা আনন্দিত হয়ে মৎস্যরাজের বাহিনীর সঙ্গে যাত্রা করলেন। দুপুর পার হোলে মৎস্যরাজ্যের সেনারা সুশর্মার সেনাদের কাছে পৌঁছে গেল।

দুই পক্ষের সেনাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হতে লাগল। সুশর্মার সঙ্গে বিরাটের বহুক্ষণ যুদ্ধের পর সুশর্মা বিরাটকে পরাজিত করে তাকে বন্দী করে নিজের রথে তুলে নিয়ে দ্রুতবেগে চললেন। মৎস্যদেশের সেনা ভয়ে পালাতে লাগল। তখন যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, তুমি বিরাটকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করো, আমরা তাঁর রাজভবনে সসম্মানে বাস করেছি তার প্রতিদান দেওয়া আমাদের কর্তব্য। ভীম একটি বিশাল গাছ উপড়ে নিতে যাচ্ছেন দেখে যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি গাছ নিয়ে যুদ্ধ করো না, লোকে তোমাকে চিনে ফেলবে, তুমি ধনু, তরবারি, কুঠার প্রভৃতি সাধারণ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করো।

পাণ্ডবগণ রথ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন দেখে বিরাটের সৈন্যরাও ফিরে এসে যুদ্ধ করতে লাগল। যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব সকলেই সুশর্মার বহুশত যোদ্ধাকে বিনাশ করলেন। তার পর যুধিষ্ঠির সুশর্মার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। ভীম সুশর্মার ঘোড়া, সারথি ও দেহরক্ষীদের বধ করলেন। বন্দী বিরাট সুশর্মার রথ থেকে লাফিয়ে নামলেন এবং সুশর্মার গদা কেড়ে নিয়ে তাকে আঘাত করলেন। বিরাট বৃদ্ধ হলেও গদা হাতে নিয়ে যুবকের মতো যুদ্ধ করতে লাগলেন। ভীম সুশর্মার চুল ধরে মাটিতে ফেলে তার মাথায় পদাঘাত করলে সুশৰ্মা মূৰ্ছিত হলেন। তাই দেখে সুশর্মার সেনা ভয়ে পালাতে লাগল।

সুশর্মাকে বন্দী কোরে এবং গরু উদ্ধার কোরে পাণ্ডবরা বিরাটের কাছে গেলেন। ভীম ভাবলেন, এই পাপী সুশর্মা জীবিত থাকার যোগ্য নয়, কিন্তু আমি কি করতে পারি, রাজা যুধিষ্ঠির সর্বদাই দয়ালু। রথের উপরে সুশৰ্মা বন্দী হয়ে ছটফট করছেন দেখে যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, নরাধমকে মুক্তি দাও। ভীম সুশর্মাকে বললেন, যদি বাঁচতে চাও তবে সবার কাছে বলবে - আমি বিরাট রাজার দাস। যুধিষ্ঠির বললেন, এ তো বিরাট রাজার দাস হয়েছেই, এখন একে ছেড়ে দাও। সুশৰ্মা, তুমি চলে যাও, এমন কাজ আর করো না। সুশৰ্মা লজ্জায় নতমুখে নমস্কার কোরে চলে গেলেন।

পাণ্ডবগণ যুদ্ধস্থানের কাছেই সেই রাতে থেকে গেলেন। পরদিন বিরাট তাদের বললেন, আপনাদের আমি সালংকারা কন্যা, বহু ধন এবং আরও যা চান তা দিচ্ছি, আপনাদের বিক্রমেই আমি মুক্ত হয়ে নিরাপদে আছি, আপনারাই এখন মৎস্যরাজ্যের রাজা। পাণ্ডবগণ হাত জোড় কোরে বললেন, মহারাজ, আপনার কথায় আমরা আনন্দিত হয়েছি, আপনি যে মুক্তিলাভ করেছেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। বিরাট পুনর্বার যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনি আসুন, আপনাকে এই রাজ্যের রাজপদে অভিষিক্ত করবো। আপনার জন্যই আমার রাজ্য ও প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। যুধিষ্ঠির বললেন, মৎস্যরাজ, আপনার মধুর কথায় আমি আনন্দিত হয়েছি, আপনি দয়ালু হয়ে নিশ্চিন্তে প্রজাপালন করুন, আপনার বিজয়সংবাদ ঘোষণার জন্য সত্বর রাজধানীতে দূত পাঠান।

______________

(ক্রমশ)