Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 83

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৮৩

কৃষ্ণের কাছে দুর্যোধন ও অর্জুন এবং বলরামের কাছে দুর্যোধনের আগমনের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কৃষ্ণের কাছে দুর্যোধন ও অর্জুন এবং বলরামের কাছে দুর্যোধনের আগমনের কাহিনি

কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সৈন্যসংগ্রহ ও সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠির, বিরাট ও দ্রুপদ নানা দেশের রাজাদের নিকট দূত পাঠালেন। বিভিন্ন দেশে দূত পাঠাবার পর অর্জুন নিজে দ্বারকায় যাত্রা করলেন। পাণ্ডবগণ কি করছেন তার সমস্ত সংবাদ দুর্যোধন তার গুপ্তচরদের কাছে পেতেন। কৃষ্ণ ও বলরাম প্রভৃতি দ্বারকায় ফিরে গেছেন শুনে দুর্যোধন অল্প সৈন্য নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুতবেগে দ্বারকায় এলেন। অর্জুনও সেই দিন সেখানে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ তখন ঘুমিয়ে আছেন জেনে দুর্যোধন ও অর্জুন তার শয়নকক্ষে গেলেন। প্রথমে দুর্যোধন এসে কৃষ্ণের মাথার দিকে একটি মহার্ঘ আসনে বসলেন তার পর অর্জুন এসে কৃষ্ণের পায়ের দিকে বিনীতভাবে বসে রইলেন।

ঘুম থেকে জেগে উঠে কৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে দেখলেন তারপর পিছন দিকে তাকিয়ে দুর্যোধনকে মহার্ঘ আসনে বসে থাকতে দেখলেন। তিনি দুজনের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে দুর্যোধন সহাস্যে বললেন, কৃষ্ণ, আসন্ন যুদ্ধে তুমি আমার সহায় হও। আমার আর অর্জুনের সঙ্গে তোমার সমান বন্ধুত্ব, সমান সম্বন্ধ। আমি আগে তোমার কাছে এসেছি, সাধু ব্যক্তিরা প্রথমে যে আসে তাকেই বরণ করেন, তুমি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, অতএব তুমি আমার অনুরোধ রক্ষা করো।

কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন, তুমি প্রথমে এসেছ তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি অর্জুনকে প্রথমে দেখেছি, অতএব দুজনকেই সাহায্য করবো। যারা বয়সে ছোটো তাদের ইচ্ছা আগে পূরণ করা উচিত, সেজন্য প্রথমে অর্জুনকে বলছি - নারায়ণী নামে বিখ্যাত আমার দশ কোটি যোদ্ধা আছে, তাদের শক্তি আমারই মতো। অর্জুন, তুমি সেই দুর্ধর্ষ নারায়ণী সেনা চাও, না যুদ্ধ অংশগ্রহণ না করা নিরস্ত্র আমাকে চাও? তুমি বার বার ভেবে দেখ, যুদ্ধে সাহায্যের জন্য দশ কোটি যোদ্ধা নেবে কিংবা কেবল উপদেষ্টা রূপে আমাকে নেবে?

কৃষ্ণ যুদ্ধ করবেন না জেনেও অর্জুন তাকেই চাইলেন। দুর্যোধান দশ কোটি যোদ্ধা নিলেন এবং পরম আনন্দে মনে করলেন তিনিই লাভবান হয়েছেন। তার পর বলরামের কাছে গিয়ে দুর্যোধন তার আসবার কারণ জানালেন। বলরাম বললেন, তুমি আমাদের মামাতো ভাই, আমাদের বোন সুভদ্রা অর্জুনের পত্নী, কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব তোমার জামাতা। বিরাট রাজার কন্যা উত্তরার সঙ্গে অভিমন্যুর বিবাহের পর আমি যা বলেছিলাম তা বোধ হয় তুমি জানো। তোমার জন্যই আমি বার বার কৃষ্ণকে বাধা দিয়ে বলেছিলাম যে দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের সমান সম্বন্ধ। কিন্তু তিনি আমার মত গ্রহণ করেননি, আমিও তাকে ছেড়ে থাকতে পারি না। কৃষ্ণের মতিগতি দেখে আমি স্থির করেছি যে আমি অর্জুনের সহায় হব না, তোমারও সহায় হব না। তুমি মহান ভরতবংশে জন্মেছ, ক্ষত্রধর্ম অনুসারে যুদ্ধ করো। দুর্যোধন বলরামকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন। তিনি মনে করলেন যে কৃষ্ণ তার পক্ষে এসেছেন, যুদ্ধেও তার জয় হয়েছে। তার পর তিনি কৃতবর্মার সঙ্গে দেখা করলেন এবং তার কাছে লক্ষাধিক সৈন্য লাভ করলেন।

দুর্যোধন চলে গেলে কৃষ্ণ অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি যুদ্ধ করবো না জেনেও তুমি আমাকে নিলে কেন? অর্জুন বললেন, তুমি একাই অমাদের সমস্ত শত্ৰু সংহার করতে পারো এবং তোমার খ্যাতি ত্রিভূবন বিখ্যাত। আমিও শত্ৰুসংহারে সমর্থ এবং খ্যাতির প্রত্যাশা করি, এই কারণেই তোমাকে নিয়েছি। আমার চিরকালের ইচ্ছা তুমি আমার সারথি হবে, এই কাজে তুমি সম্মত হও। কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তুমি আমার সঙ্গে যে স্পর্ধা প্রদর্শন করো তা তোমারই উপযুক্ত। আমি সারথি হয়ে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করবো। তার পর কৃষ্ণ ও অন্যান্য যাদব বীরগণের কাছে বিদায় নিয়ে অর্জুন আনন্দিতমনে যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে এলেন।

______________

(ক্রমশ)