Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 85

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৮৫

কৌরব ও পাণ্ডবদের সেনা সংগ্রহ এবং দ্রুপদের পুরোহিত কর্তৃক দৌত্যের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কৌরব ও পাণ্ডবদের সেনা সংগ্রহ এবং দ্রুপদের পুরোহিত কর্তৃক দৌত্যের কাহিনি

পাণ্ডবদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে নানা দেশের রাজারা বিশাল সৈন্যদল নিয়ে পাণ্ডব পক্ষে যোগ দিতে এলেন। ছোটো ছোটো নদী যেমন সাগরে এসে মিশে যায়, তেমন বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য সৈন্য যুধিষ্ঠিরের বাহিনীতে এসে যোগ দিয়ে এক বিশাল সেনাবাহিনীতে পরিণত হোলো। মহারথ সাত্যকি, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু, মগধরাজ জয়ৎসেন, সাগর তীরবর্তী বহু যোদ্ধা সহ পাণ্ড্যরাজ, কেকয় রাজবংশীয় পাঁচ ভাই, পুত্রদের সঙ্গে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, মৎস্যরাজ বিরাট এবং আরও বহু দেশের রাজারা সসৈন্যে যুধিষ্ঠিরের বাহিনীতে যোগ দিলেন।

অন্য দিকে দুর্যোধনের পক্ষেও বহু রাজা বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে যোগ দিলেন। চীন ও কিরাত সৈন্য সহ ভগদত্ত, ভুরিশ্ৰবা, মদ্ররাজ শল্য, ভোজ ও অন্ধক সৈন্য সহ কৃতবর্মা, সৌবীররাজ জয়দ্রথ প্রভৃতি রাজারা, শক ও যবন সৈন্য সহ মাহিষ্মতীরাজ নীল, অবন্তী দেশের দুই রাজা এবং অন্যান্য রাজারা সসৈন্যে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেওয়া অসংখ্য সেনাদেরকে হস্তিনাপুরে রাখা সম্ভব হোলো না, তাই তাদেরকে পঞ্চনদ, কুরুজাঙ্গাল, রোহিতকারণ্য, মরুপ্রদেশ, অহিচ্ছত্র, কালকূট, গঙ্গাতীর, বারণ, বাটধান ও যমুনাতীরে থাকতে দেওয়া হোলো।

উভয় পক্ষ যখন সৈন্য সংগ্রহ করছিল, তখন দ্রুপদের পুরোহিত হস্তিনাপুরে এলে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম ও বিদুর তাঁর সংবর্ধনা করলেন। কুশল জিজ্ঞাসার পর পুরোহিত বললেন, আপনারা সকলেই সনাতন রাজধর্ম জানেন, তথাপি আমি আপনাদেরকে কিছু বলবো। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু একজনেরই পুত্র, পৈতৃক ধনে তাদের সমান অধিকার। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ তাদের পৈতৃক ধন পেলেন, কিন্তু পাণ্ডুপুত্রগণ পেলেন না কেন? আপনারা জানেন, দুর্যোধন তা অধিকার করে রেখেছেন। তিনি পাণ্ডবগণকে হত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছেন এবং শকুনির সাহায্যে তাদের রাজ্য হরণ করেছেন। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পুত্রের কাজ অনুমোদন কোরে পাণ্ডবগণকে তেরো বছর নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। পাশা খেলার সভায়, বনবাসে এবং বিরাটনগরে পাণ্ডবগণ ও তাদের স্ত্রী বহু কষ্ট পেয়েছেন। সমস্ত নির্যাতন ভুলে গিয়ে তাঁরা কৌরবগণের সঙ্গে সন্ধি করতে ইচ্ছা করেন। এখানে যে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা রয়েছেন তারা পাণ্ডবদের ও দুর্যোধনের আচরণ বিচার করে ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করুন। পাণ্ডবরা বিবাদ করতে চান না, লোকক্ষয় না করেই নিজেদের প্রাপ্য চান।

দুর্যোধন যে ভরসায় যুদ্ধ করতে চান তা মূর্খতা, কারণ পাণ্ডবরাই অধিকতর বলশালী। তাদের সাত অক্ষৌহিণী সেনা প্রস্তুত আছে, তার উপর শুধুমাত্র সাত্যকি, ভীম, নকুল আর সহদেব সহস্র অক্ষৌহিণী সেনার সমান। আপনাদের পক্ষে যেমন এগার অক্ষৌহিণী সেনা আছে, অপর পক্ষে তেমন অর্জুন আছেন। একা অর্জুন ও কৃষ্ণ সমস্ত সেনার থেকেও অধিক। অর্জুনের বিক্রম এবং কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তা জেনে কোন্ লোক পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে? অতএব আপনারা কালক্ষেপ করবেন না, ধর্ম ও নিয়ম অনুসারে যা পাণ্ডবগণের প্রাপ্য তা দিন।

পুরোহিতের কথা শুনে ভীষ্ম বললেন, ভাগ্যক্রমে পাণ্ডবগণ ও কৃষ্ণ কুশলে আছেন এবং ধর্মপথে থেকে সন্ধি চেয়েছেন। আপনি যা বলেছেন সবই সত্য, আপনার বাক্য কঠোর হলেও সত্য। পাণ্ডবদের বহু কষ্ট দেওয়া হয়েছে এবং ধর্ম অনুসারে তারা পিতৃধনের অধিকারী এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অর্জুন অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত মহারথ, স্বয়ং ইন্দ্রও যুদ্ধে তার সমকক্ষ নন।

কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বাধা দিয়ে দ্রুপদের পুরোহিতকে বললেন, ব্রাহ্মণ, যা হয়ে গেছে তা সকলেই জানে, বার বার সে কথা বলে লাভ কি? দুর্যোধনের জন্যই শকুনি পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছিলেন এবং যুধিষ্ঠির পণ রক্ষার জন্য বনে গিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী সময়ের মধ্যে তিনি মূর্খের মতো রাজ্য চাইতে পারেন না। দুর্যোধন ধর্ম অনুসারে শত্রুকে সমস্ত পৃথিবী দান করতে পারেন, কিন্তু ভয় পেয়ে এক পা পরিমাণ ভূমিও দেবেন না। পাণ্ডবরা যদি পৈতৃক রাজ্য চান তবে অবশিষ্ট কাল বনবাসে কাটিয়ে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন, তার পর নির্ভয়ে দুর্যোধনের কাছে আশ্রয় নিন।

ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, অহংকার করে লাভ কি, অর্জুন একাকী ছয়জন রথীকে জয় করেছিলেন তা স্মরণ করো। এই ব্রাহ্মণ যা বললেন তা যদি আমরা না করি তবে অর্জুন কর্তৃক নিহত হয়ে আমরা রণভূমিতে শয্যা গ্রহণ করবো।

কর্ণকে ভর্ৎসনা করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভীষ্ম যা বলেছেন তা সকলের পক্ষে হিতকর। ব্রাহ্মণ, আমি চিন্তা করে পাণ্ডবগণের নিকট সঞ্জয়কে পাঠাবো, আপনি আজই ফিরে যান। তার পর ধৃতরাষ্ট্র দ্রুপদ পুরোহিতকে সসম্মানে বিদায় দিলেন।

______________

(ক্রমশ)