Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 89

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯০

পাণ্ডবদের পক্ষে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে কৃষ্ণের হস্তিনাপুর গমনের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

পাণ্ডবদের পক্ষে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে কৃষ্ণের হস্তিনাপুর গমনের কাহিনি

কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিষয়ে কৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবগণ আলোচনা করার পর একদিন সকালে শুভ মুহূর্তে কৃষ্ণ শুভযাত্রার জন্য ব্রাহ্মণদের অভিবাদন এবং আগুন প্রদক্ষিণ করে সাত্যকিকে বললেন, শঙ্খ, চক্র, গদা, তুণীর, শক্তি ও অন্যান্য সব রকমের অস্ত্র আমার রথে রাখো, কারণ শত্রুকে অবজ্ঞা কার উচিত নয়। কৃষ্ণের পরিচারকগণ তার রথ প্রস্তুত করলে কৃষ্ণ সাত্যকিকে রথে তুলে নিলেন। বশিষ্ঠ, বামদেব, শুক্র, নারদ প্রভৃতি দেবর্ষি ও মহর্ষিগণ কৃষ্ণের ডান পাশে দাঁড়ালেন। পাণ্ডবগণ এবং দ্রুপদ বিরাট প্রভৃতি কিছুদূর পর্যন্ত কৃষ্ণের অনুগমন করলেন।

যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, যিনি আমাদের বাল্যকাল থেকে লালন-পালন করেছেন, দুর্যোধনের ভয় ও মৃত্যুসংকট থেকে রক্ষা করেছেন, আমাদের জন্য বহু দুঃখ ভোগ করেছেন, আমাদের সেই মাকে তুমি অভিবাদন ও আলিঙ্গন করে আশ্বস্ত কোরো। আমরা যখন বনে যাই তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে আমাদের পিছনে দৌড়ে এসেছিলেন, আমরা তাকে ছেড়ে বনে প্রস্থান করেছিলাম। তুমি ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও অশ্বত্থামা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ রাজাগণকে আমাদের হয়ে অভিবাদন কোরো, মহাপ্রাজ্ঞ বিদুরকে আলিঙ্গন কোরো।

অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, দুর্যোধন যদি তোমার কথায় রাজি হয়ে অর্ধেক রাজ্য আমাদের দেয় তবে আমরা সুখী হবো, তা যদি না করে তবে তার পক্ষের সকল ক্ষত্রিয়কে আমি বিনষ্ট করবো। এই কথা শুনে ভীম আনন্দিত হয়ে সগর্বে গর্জন করে উঠলেন।

কৃষ্ণের সারথি দারুক দ্রুতবেগে রথ চালালেন। কিছুদূর যাবার পর নারদ, কেবল, মৈত্রেয়, বেদব্যাস, পরশুরাম প্রভৃতি মহর্ষিগণ কৃষ্ণের কাছে এসে বললেন, মহামতি কৃষ্ণ, আমরা তোমার বক্তব্য ও কৌরবদের কাছ থেকে তার উত্তর শোনবার জন্য কৌরবসভায় যাচ্ছি। তুমি নির্বিঘ্নে এগিয়ে যাও, কৌরবসভায় আবার আমরা তোমাকে দেখবো।

কৃষ্ণ আসছেন এই সংবাদ দূতমুখে শুনে ধৃতরাষ্ট্র খুশি হয়ে তার উপযুক্ত আপ্যায়নের জন্য পুত্রকে আদেশ দিলেন। দুর্যোধন নানা স্থানে সুসজ্জিত মণ্ডপ নির্মাণ এবং সুস্বাদু খাদ্য পানীয় প্রভৃতির আয়োজন করলেন। কৃষ্ণ সে সকল উপেক্ষা করে হস্তিনাপুরের দিকে চললেন।

ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, আমি কৃষ্ণকে ঘোড়া সহ ষোলটি স্বর্ণভূষিত রথ, আটটি মহাবল হাতি, এক শত রূপবতী দাসী, এক শত দাস এবং বহু মৃগচর্ম উপহার দেবো। এই উজ্জ্বল বিমল মণি যা দিনে ও রাতে আলো বিচ্ছুরণ করে, এটিও দেবো। দুর্যোধন ভিন্ন আমার সকল পুত্র ও পৌত্র, সালংকারা কল্যাণীয়া কন্যাগণ কৃষ্ণের অভ্যর্থনার জন্য যাবে।

বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনি সরল পথে চলুন, আমি বুঝতে পারছি আপনি ধর্মের জন্য বা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য উপহার দিচ্ছেন না, আপনার এই উপহার এক মিথ্যা ছল। পাণ্ডবরা পাঁচটি গ্রাম চান, আপনি তাও দিতে প্রস্তুত নন, অথচ উপহার দিয়ে কৃষ্ণকে আপনার পক্ষে আনবার ইচ্ছা করছেন। উপহার দিয়ে বা নিন্দা কোরে বা অন্য উপায়ে আপনি কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে বিভেদ ঘটাতে পারবেন না। পা ধোয়ার জন্য জল এবং কুশল প্রশ্ন ভিন্ন কৃষ্ণ কিছুই গ্রহণ করবেন না। তিনি কুরুপাণ্ডবের মঙ্গল কামনায় আসছেন, আপনি তার সেই কামনা পূর্ণ করুন।

দুর্যোধন বললেন, বিদুর সত্য বলেছেন, কৃষ্ণ পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেন, তাকে আমাদের পক্ষে আনা যাবে না। তিনি নিশ্চয়ই পূজনীয়, কিন্তু দেশ কাল বিবেচনা করে তাকে এখন মূল্যবান উপহার দেওয়া উচিত নয়, তিনি মনে করবেন আমরা ভয় পেয়েছি। আমরা যুদ্ধে উদ্যোগী হয়েছি, যুদ্ধ ভিন্ন শান্তি হবে না।

কুরুপিতামহ ভীষ্ম বললেন, তোমরা কৃষ্ণের সমাদর করো বা না করো তিনি ক্রুদ্ধ হবেন না, কিন্তু তাঁকে যেন অবহেলা করা না হয়। তিনি যা বলবেন তোমাদের তাই করা উচিত। তিনি ধর্মসংগত ন্যায্য কথাই বলবেন, তোমরাও তাকে ন্যায়সঙ্গত কথা বলো।

দুর্যোধন বললেন, আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজ্যভোগ করতে পারব না। যা স্থির করেছি শুনুন,আমি কৃষ্ণকে বন্দী করে রাখবো, তা হলে যাদবগণ, পাণ্ডবগণ এবং সমস্ত পৃথিবী আমার বশে আসবে।

দুর্যোধনের এই দুরভিসন্ধি শুনে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, এমন ধর্মবিরুদ্ধ কথা বলো না, কৃষ্ণ দূত হয়ে আসছেন, তার উপর তিনি তোমার আত্মীয়, আমাদের প্রিয় এবং নিরপরাধ। ভীষ্ম বললেন, ধৃতরাষ্ট্র, তোমার দুর্বুদ্ধি পুত্র কেবল অনর্থ ডেকে আনে, তুমিও এই পাপাত্মার অনুসরণ করো। কৃষ্ণকে বন্দী করলে দুর্যোধন তার অমাত্য সহ মূহুর্তের মধ্যে বিনষ্ট হবে। এই বলে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সভা ত্যাগ করে চলে গেলেন।

সকালবেলা কৃষ্ণ হস্তিনাপুরে এসে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধনের ভাইয়েরা এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি এগিয়ে গিয়ে তাকে সংবর্ধনা জানালেন। রাজপথে বহু লোক কৃষ্ণের নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল, অন্তঃপুরের নারীগণ উপর থেকে তাকে দেখতে লাগলেন। তিনটি মহল পার হয়ে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্রাদি সকলেই উঠে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকে সংবর্ধনা করলেন। পুরোহিতগণ যথাবিধি কৃষ্ণের অর্চনা করলেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর কৃষ্ণ বিদুরের ভবনে গেলেন এবং বিকালে পিসি কুন্তীর সঙ্গে দেখা করলেন।

______________

(ক্রমশ)