Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 93

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৯৩

পরশুরাম বর্ণিত রাজা দম্ভোদ্ভব ও কণ্ব বর্ণিত সুমুখ ও গরুড়ের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

পরশুরাম বর্ণিত রাজা দম্ভোদ্ভব ও কণ্ব বর্ণিত সুমুখ ও গরুড়ের কাহিনি

কৌরবসভায় যে সমস্ত রাজারা উপস্থিত ছিলেন তারা সকলেই মনে মনে কৃষ্ণের বক্তব্যের প্রশংসা করলেন, কিন্তু কিছুই না বলে নীরব হয়ে রইলেন। তখন জামদগ্ন্য পরশুরাম বললেন, আমি সকলের উদ্দেশ্যে একটি সত্য ঘটনার কথা বলছি শুনুন - পুরাকালে দম্ভোদ্ভব নামে এক মহাবল রাজা ছিলেন, তিনি সকলকে এই প্রশ্ন করতেন যে আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বা আমার সমান যোদ্ধা কেউ আছে কিনা। এক তপস্বী ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে বলেলন, গন্ধমাদন পর্বতে নর ও নারায়ণ নামে দুই পুরুষশ্রেষ্ঠ তপস্যা করছেন, তুমি কখনও তাদের সমান নও, তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করো।

তপস্বীর কথা শুনে দম্ভোদ্ভব বিশাল সৈন্য নিয়ে গন্ধমাদন পর্বতে গিয়ে শীর্ণদেহী দুই ঋষিকে দেখে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন। নর ও নারায়ণ বললেন, এই আশ্রমে ক্রোধ, লোভ, অস্ত্রশস্ত্র বা কুটিলতা নেই, এখানে যুদ্ধ হতে পারে না, তুমি চলে যাও, পৃথিবীতে বহু ক্ষত্রিয় আছে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো। দম্ভোদ্ভব শুনলেন না, বার বার যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন নর ঋষি এক মুঠো কাশ তৃণ নিয়ে বললেন, যুদ্ধকামী ক্ষত্রিয়, তোমার অস্ত্র আর সৈন্যদল নিয়ে এসো। তখন রাজা নর ও নারায়ণের উপর শরবর্ষণ করতে লাগলেন, কিন্তু তার আক্রমণ ব্যর্থ হোলো। নর ঋষি কাশ তৃণ ছুঁড়ে দম্ভোদ্ভবের সৈন্যদের চোখ, কান, নাক বিদ্ধ করতে লাগলেন। কাশ তৃণতে ঢেকে গিয়ে আকাশ শ্বেতবর্ণ হয়ে গেছে দেখে রাজা নর ঋষির চরণে পড়লেন। নর বললেন, আর এমন করো না, তুমি ব্রাহ্মণের হিতকামী এবং নির্লোভ নিরহংকার জিতেন্দ্রিয় ক্ষমাশীল হয়ে প্রজাপালন করো, অপরের শক্তি না জেনে কাউকে আক্রমণ কোরো না। তখন রাজা দম্ভোদ্ভব ঋষিদ্বয়কে প্রণাম করে চলে গেলেন।

কাহিনি শেষ করে পরশুরাম বললেন, নারায়ণ ঋষি নর অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, নর ও নারায়ণই অর্জুন ও কৃষ্ণ হয়ে জন্মেছেন। আপনি সুবুদ্ধি অবলম্বন কোরে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করুন, যুদ্ধে মত দেবেন না।

মহর্ষি কণ্ব বললেন, দুর্যোধন, মনে কোরো না যে তুমিই বলবান, বলবান অপেক্ষাও বলবান থাকে। একটি প্রাচীন ঘটনা বলছি শোন – ইন্দ্রের সারথি মাতলির একটি অতুলনীয়া রূপবতী কন্যা ছিল, তার নাম গুণকেশী। মাতলি তার কন্যার যোগ্য বর কোথাও না পেয়ে পাতালে গেলেন। সেই সময়ে নারদ বরুণের কাছে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, আমরা তোমার কন্যার জন্য বর নির্বাচন করে দেবো। নারদ মাতলিকে নাগলোকে নিয়ে গিয়ে বিবিধ আশ্চর্য বস্তু দেখালেন। মাতলি বললেন, এখানে আমার কন্যার যোগ্য বর কেউ নেই, অন্যত্র চলুন। নারদ মাতলিকে দানবদের নিবাস হিরণ্যপুরে নিয়ে গিয়ে বললেন এখানকার কোনও পুরুষকে নির্বাচন করতে পারো। মাতলি বললেন, দানবদের সঙ্গে আমি সম্বন্ধ করতে পারি না, তারা দেবগণের শত্রু, অন্যত্র চলুন। তার পর নারদ গরুড়বংশীয় পাখিদের বাসস্থানে এসে বললেন, এরা নির্দয় সর্পভোজী, কিন্তু ক্ষত্রিয় এবং বিষ্ণুর উপাসক। মাতলি সেখানেও বর নির্বাচন করলেন না। তখন নারদ তাকে রসাতল নামক পৃথিবীর সপ্তম তলে নিয়ে গেলেন, যেখানে গোমাতা সুরভি বাস করেন যাঁর ক্ষীরধারা থেকে ক্ষীরোদ সাগরের উৎপত্তি, কিন্তু মাতলি সেখানেও তার কন্যার উপযুক্ত বর পেলেন না।

তারপর তারা অনন্ত নাগ বাসুকির পুরীতে গেলেন। সেখানে একটি নাগকে বহুক্ষণ দেখে মাতলি প্রশ্ন করলেন, এই সুদর্শন নাগ কার বংশধর? একে গুণকেশীর যোগ্য মনে করি। নারদ বললেন, ইনি ঐরাবত নাগের বংশজাত আর্যকের পৌত্র, এঁর নাম সুমুখ। কিছুকাল পূর্বে এঁর পিতা চিকুরু গরুড় কর্তৃক নিহত হয়েছেন। মাতলি প্রীত হয়ে বললেন, এই সুমুখই আমার জামাতা হবেন। সুমুখের পিতামহ আর্যকের কাছে গিয়ে নারদ মাতলির ইচ্ছা জানালেন। আর্যক বললেন, দেবর্ষি, ইন্দ্রের সখা মাতলির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ কে না চায়? কিন্তু গরুড় আমার পুত্র চিকুরুকে খেয়ে ফেলেছে এবং বলেছে এক মাস পরে সুমুখকেও খাবে, এই কারণে আমার মনে সুখ নেই। মাতলি বললেন, সুমুখ আমার সঙ্গে ইন্দ্রের কাছে চলুন, ইন্দ্র গরুড়ের কাছ থেকে সুমুখকে বাঁচাবেন।

নারদ ও মাতলি সুমুখকে নিয়ে দেবরাজের কাছে গেলেন, সেখানে ভগবান বিষ্ণুও ছিলেন। নারদের মুখে সকল ঘটনা শুনে বিষ্ণু ইন্দ্রকে বললেন, সুমুখকে অমৃত পান করিয়ে অমর করো। ইন্দ্র সুমুখকে দীর্ঘায়ু দান করলেন, কিন্তু অমৃত পান করালেন না। তার পর সুমুখ ও মাতলিকন্যা গুণকেশীর বিবাহ হোলো।

সুমুখ দীর্ঘায়ু পেয়েছেন জেনে গরুড় ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে বললেন, তুমি আমাকে নাগভোজনের বর দিয়েছিলে, এখন বাধা দিলে কেন? ইন্দ্র বললেন, আমি বাধা দিইনি, বিষ্ণুই সুমুখকে অভয় দিয়েছেন। গরুড় বললেন, দেবরাজ, আমি ত্রিভুবনের অধীশ্বর হবার যোগ্য, তবুও পরের দাস হয়েছি। তুমি থাকতে বিষ্ণু আমার খাদ্যে বাধা দিতে পারেন না, তুমি আর বিষ্ণুই আমার গৌরব নষ্ট করেছ। তার পর গরুড় বিষ্ণুকে বললেন, আমার পাখার এক ক্ষুদ্র অংশ দিয়েই তোমাকে আমি অক্লেশে বইতে পারি, ভেবে দেখ কে অধিক বলবান। বিষ্ণু বললেন, তুমি অতি দুর্বল হয়েও নিজেকে বলবান মনে করছ। গরুড়, তুমি আমার কাছে অহংকার কোরো না। আমি নিজেই নিজেকে বহন করি, তোমাকেও ধারণ করি। তুমি যদি আমার বাম বাহুর ভার সইতে পারো তবেই তোমার অহংকার সার্থক হবে। এই বলে বিষ্ণু তাঁর বাম বাহু গরুড়ের কাঁধে রাখলে অচেতন হয়ে গরুড় পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে চেতনা ফিরে পেয়ে গরুড় বিষ্ণুকে প্রণাম কোরে বললেন, প্রভু, আমি তোমার পতাকাবাসী পাখি মাত্র, আমাকে ক্ষমা করো। তোমার শক্তি জানতাম না তাই মনে করতাম আমার শক্তির তুলনা নেই। তখন বিষ্ণু তার পায়ের আঙ্গুল দিয়ে সুমুখকে গরুড়ের বুকে নিক্ষেপ করলেন। সেই অবধি সুমুখের সঙ্গে গরুড় শান্তিতে বাস করেন।

কাহিনি শেষ করে কণ্ব বললেন, গরুড়ের অহংকার এইরূপে নষ্ট হয়েছিল। বৎস দুর্যোধন, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি যুদ্ধে পাণ্ডবদের সম্মুখীন না হবে ততক্ষণ পর্যন্তই তুমি জীবিত থাকবে। তুমি বিরোধ ত্যাগ করো, বাসুদেবের উপদেশ পালন কোরে নিজের কুল রক্ষা করো। সর্বদর্শী নারদ জানেন, এই কৃষ্ণই স্বয়ং বিষ্ণু। দুর্যোধন কণ্বের দিকে চেয়ে জোরে হাসলেন এবং নিজের ঊরুতে চপেটাঘাত করে বললেন, মহর্ষি, ঈশ্বর আমাকে যেমন সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আমার যা হবে আমি সেই ভাবেই চলছি, কেন প্রলাপ বকছেন?

______________

(ক্রমশ)