মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০০
কৌরবসভা থেকে কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তন এবং পাণ্ডবদের যুদ্ধের প্রস্তুতির কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
কৌরবসভা থেকে কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তন এবং পাণ্ডবদের যুদ্ধের প্রস্তুতির কাহিনি
কৌরবসভা থেকে উপপ্লব্য নগরে ফিরে এসে কৃষ্ণ তার দৌত্যের বিবরণ যুধিষ্ঠিরকে জানিয়ে বললেন, আমি দুর্যোধনকে সবিনয়ে অনুরোধ করেছি, সভায় উপস্থিত রাজাদের ভর্ৎসনা করেছি, দুর্যোধনকে অবজ্ঞা করে কর্ণ ও শকুনিকে ভয় দেখিয়েছি, পাশা খেলার সভায় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের আচরণের বহু নিন্দা করেছি। অবশেষে দুর্যোধনকে বলেছি, পাণ্ডবদের অন্তত পাঁচটি গ্রাম দাও, পাণ্ডবগণ অভিমান ত্যাগ কোরে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুরের আজ্ঞাধীন হয়ে থাকবেন, নিজের রাজ্যাংশ শাসনের ভারও তোমার হাতে দেবেন। ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুর তোমাকে যে হিতকর উপদেশ দিয়েছেন তা পালন করো। তার পর কৃষ্ণ বললেন, আপনাদের জন্য আমি কৌরব সভায় সাম দান ও ভেদ নীতি অনুসারে বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। এখন চতুর্থ নীতি দণ্ড ছাড়া আর কোনও উপায় দেখি না। কৌরবপক্ষের রাজারা বোধ হয় এখন বিনাশের জন্য কুরুক্ষেত্রে যাত্রা করেছেন। দুর্যোধনাদি বিনা যুদ্ধে আপনাকে রাজ্য দেবেন না।
কৃষ্ণের বক্তব্য শেষ হোলে যুধিষ্ঠির তার ভাইদের বললেন, তোমরা কৃষ্ণের কথা শুনলে, এখন সেনাদেরকে সঠিক ভাবে বিভাজন করো। সাত অক্ষৌহিণী সেনা এখানে সমবেত হয়েছে, তাদের পরিচালনা করবেন দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, সাত্যকি, চেকিতান ও ভীম। এঁরা সকলেই যুদ্ধবিশারদ বীর এবং প্রাণ দিতে প্রস্তুত। সহদেব, তোমার মতে যিনি এই সাত জনের নেতা হবার যোগ্য, যিনি সেনাবিভাগ করতে জানেন এবং যুদ্ধে ভীষ্মের প্রতাপ সইতে পারবেন, তার নাম বলো।
সহদেব বললেন, মৎস্যরাজ বিরাটই এই কাজের যোগ্য। ইনি আমাদের সুখে সুখী দুঃখে দুঃখী, বলবান ও অস্ত্রবিশারদ, এঁর সাহায্যেই আমরা রাজ্য উদ্ধার করবো। নকুল বললেন, আমাদের শ্বশুর দ্রপদই সেনানায়ক হবার যোগ্য, ইনি বয়সে ও কুলমর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, ভরদ্বাজের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন এবং সর্বদা দ্রোণ ও ভীষ্মের সহিত স্পর্ধা করেন। দ্রোণের বিনাশকামনায় ইনি স্ত্রীর সাথে ঘোর তপস্যা করেছিলেন। অর্জুন বললেন, যে দিব্য পুরুষ তপস্যার প্রভাবে এবং ঋষিগণের অনুগ্রহে উৎপন্ন হয়েছিলেন, যিনি ধনু ও কবচ ধারণ কোরে রথে চড়ে অগ্নিকুণ্ড থেকে উঠেছিলেন, সেই ধৃষ্টদ্যুম্নই সেনাপতিত্বের যোগ্য। ভীম বললেন, সিদ্ধগণ ও মহর্ষিগণ বলেন যে, দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী ভীষ্মকে বধের জন্য জন্মেছেন, ইনি রামের ন্যায় রূপবান, এমন কেউ নেই যে এঁকে আহত করতে পারে, এঁকেই সেনাপতি করুন।
যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণই আমাদের জয়পরাজয়ের মূল, আমাদের জীবন রাজ্য সুখদুঃখ, সবই এঁর অধীন, ইনিই বলুন কে আমাদের সেনাপতি হবেন। এখন রাত হয়েছে, কাল সকালে আমরা অধিবাস ও মঙ্গলাচরণ কোরে যুদ্ধযাত্রা করবো।
অর্জুনের দিকে চেয়ে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, যাঁদের নাম করা হোলো তাঁরা সকলেই নেতৃত্ব করবার যোগ্য। আপনি এখন সেনা বিন্যাস করুন, আপনার পক্ষে যে বীরগণ আছেন তাদের সম্মুখে দুর্যোধনাদি কখনও দাঁড়াতে পারবেন না। আমি ধৃষ্টদ্যুম্নকেই সেনাপতি মনোনীত করছি। কৃষ্ণের কথায় পাণ্ডবগণ আনন্দিত হলেন।
যুদ্ধসজ্জা আরম্ভ হোলো, সৈন্যগণ উৎসাহিত হয়ে কোলাহল করতে লাগল, হাতি ও ঘোড়ার ডাক, রথের চাকার ঘর্ঘর শব্দ, শঙ্খ আর দুন্দুভির আওয়াজে চার দিক মুখরিত হোলো। বর্ম ও অস্ত্রে সজ্জিত যোদ্ধারা উৎসাহিত হয়ে চলতে লাগলো, যুধিষ্ঠির তাদের মধ্যভাগে রইলেন, দুর্বল সৈন্য ও পরিচারকগণও তাঁর সঙ্গে চললো। বিভিন্ন যান-বাহন, রসদ, অস্ত্র-শস্ত্র ও চিকিৎসকগণ তাদের সঙ্গে গেল। দ্রৌপদী তার দাসদাসী ও অন্যান্য স্ত্রীদের নিয়ে উপপ্লব্য নগরেই রইলেন।
পাণ্ডববাহিনী কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হোলো। যুধিষ্ঠির শ্মশান, দেবালয়, মহর্ষিদের আশ্রম ও তীর্থস্থান বাদ দিয়ে যেখানে প্রচুর ঘাস ও কাঠ পাওয়া যায় এমন এক সমতল স্থানে সেনা সন্নিবেশ করলেন। হিরন্বতী নদীর কাছে পরিখা খনন করিয়ে কৃষ্ণ সেখানে রাজাদের শিবির স্থাপন করলেন। শত শত বেতনভোগী শিল্পী এবং চিকিৎসার উপকরণ সহ চিকিৎসকগণ শিবিরে রইলেন। প্রতি শিবিরে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, জল, ঘাস, তুষ ও কয়লা রাখা হোলো।
কৌরবসভায় যে কথাবার্তা হয়েছিল তার সম্বন্ধে যুধিষ্ঠির আরও জানতে চাইলে কৃষ্ণ বললেন, দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন আপনার প্রস্তাব এবং ভীষ্ম বিদুর ও আমার কথা সমস্তই অগ্রাহ্য করেছে, কর্ণের ভরসায় সে মনে করে তার জয়লাভ হবেই। সে আমাকে বন্দী করবার আদেশ দিয়েছিল, কিন্তু তার ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। ভীষ্ম ও দ্রোণও যথেষ্ট ন্যায়সংগত কথা বলেন নি, বিদুর ছাড়া সকলেই দুর্যোধনের ইচ্ছাধিন।
যুধিষ্ঠির দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ কোরে বললেন, যে অনর্থ না ঘটার জন্য আমি বনবাস স্বীকার কোরে বহু দুঃখ পেয়েছি, সেই মহা অনর্থই উপস্থিত হোলো। যাঁরা অবধ্য তাঁদের সঙ্গে কি করে যুদ্ধ করবো? গুরুজন ও বৃদ্ধদের হত্যা করে আমাদের কি লাভ হবে? অর্জুন বললেন, মহারাজ, কৃষ্ণ কুন্তী ও বিদুর কখনও অধর্ম করতে বলবেন না। যুদ্ধ না কোরে ফিরে যাওয়া আপনার কর্তব্য নয়। ঈষৎ হেসে কৃষ্ণ বললেন, ঠিক কথা।
দ্রুপদ বিরাট সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ধৃষ্টকেতু শিখণ্ডী ও মগধরাজ সহদেব - এই সাত জনকে যুধিষ্ঠির যথাবিধি অভিষিক্ত করে সেনাপতির পদ দিলেন। তার পর তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রধান সেনাপতি, অর্জুনকে সমস্ত সেনাপতি ও প্রধান সেনাপতির অধ্যক্ষ এবং কৃষ্ণকে অর্জুনের নিয়ন্তা ও রথচালক নিযুক্ত করলেন।
______________
(ক্রমশ)