Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 102

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০২

কৌরবদের যুদ্ধের প্রস্তুতির কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কৌরবদের যুদ্ধের প্রস্তুতির কাহিনি

কৃষ্ণ হস্তিনাপুর থেকে চলে যাওয়ার পর দুর্যোধন কর্ণ প্রভৃতিকে বললেন, কৃষ্ণ অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেছেন, তিনি নিশ্চয় ক্রুদ্ধ হয়ে পাণ্ডবগণকে যুদ্ধে উত্তেজিত করবেন। তিনি যুদ্ধই চান, ভীম অর্জুনও তাঁর মতে চলেন। দ্রুপদ আর বিরাটের সঙ্গেও আমি শত্রুতা করেছি, তারাও কৃষ্ণের কথা শুনে চলবেন। অতএব কৌরব ও পাণ্ডবের মধ্যে তুমুল বিনাশকারী যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। তোমরা না ঘুমিয়ে যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন করো। কুরুক্ষেত্রে হাজার হাজার শিবির স্থাপন করাও, সবদিকে যেন প্রচুর খোলা জায়গা রাখা হয়। শিবিরের মধ্যে জল, কাঠ, বিবিধ অস্ত্র এবং উপরে পতাকা থাকবে। খাদ্যদ্রব্য ও রসদ নিয়ে আসবার পথ যেন শত্রুরা আটকাতে না পারে।

দুর্যোধনের আদেশে কুরুক্ষেত্রে সেনাশিবির স্থাপিত হোলো। সমাগত রাজারা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হলেন। রথী, অশ্বারোহী, গজারোহী ও পদাতিক সৈন্যগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোলো। সকাল হলে দুর্যোধন এগারো অক্ষৌহিণী সেনা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করলেন। প্রত্যেক রথে চারটি কোরে ঘোড়া যুক্ত করা হোলো এবং দুʼজন ব্যক্তি ঘোড়ার রক্ষক ও দুʼজন ব্যক্তি রথীদের রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হোলো। প্রত্যেক হাতিতে দুই অঙ্কুশধারী, দুই ধনুর্ধারী এবং একজন শক্তি ও পতাকাধারী রইল।

দুর্যোধন হাত জোড় কোরে ভীষ্মকে বললেন, সেনাপতি না থাকলে বিশাল সেনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুনেছি এক সময় ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্র এই তিন বর্ণের লোক হৈহয় ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যায়, কিন্তু তারা বার বার পরাজিত হয়। তার পর ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের পরাজয়ের কারণ কি? ধর্মজ্ঞ ক্ষত্রিয়গণ উত্তর দিলেন - আমরা সকলে একত্রিত হয়ে একজন মহাবুদ্ধিমানের মতে চলি আর আপনারা প্রত্যেকে নিজের বুদ্ধিতে পৃথক পৃথক চলেন। তখন ব্রাহ্মণরা একজন যুদ্ধনিপুণ ব্রাহ্মণকে সেনাপতি করলেন এবং ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হলেন।

তার পর দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আপনি শুক্রাচার্য তুল্য যুদ্ধনিপুণ, ধর্মে নিরত এবং আমার হিতৈষী, আপনিই আমাদের সেনাপতি হন। বাছুর যেমন ষাঁড়কে অনুসরণ করে আমরাও তেমন আপনার পিছনে অনুগমন করবো। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, আমার কাছে তোমরা যেমন পাণ্ডবরাও তেমন, তথাপি প্রতিজ্ঞা অনুসারে তোমার জন্যই যুদ্ধ করবো। অর্জুন ভিন্ন আমার সমান যোদ্ধা কেউ নেই, তাঁর অনেক দিব্যাস্ত্রও আছে। কিন্তু অর্জুন আমার সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করবে না। পাণ্ডুপুত্রদের বিনাশ করা আমারও কর্তব্য নয়। যত দিন তাদের হাতে আমি না মরি তত দিন আমি প্রত্যেক দিন পাণ্ডবপক্ষের দশ হাজার যোদ্ধাকে বধ করবো। কিন্তু কর্ণ সর্বদাই আমার সঙ্গে বিরোধিতা করে, অতএব প্রথম সেনাপতি আমি না হয়ে সেই হতে পারত। কর্ণ বললেন, ভীষ্ম জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করবো না, এঁর মৃত্যুর পর আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবো।

দুর্যোধন রাশি রাশি উপহার দিয়ে ভীষ্মকে সেনাপতির পদে অভিষিক্ত করলেন। এই সময়ে নানাপ্রকার অশুভ লক্ষণ দেখা গেল, বিনা মেঘে বাজ পড়তে থাকলো, ভূমিকম্প হোলো, উল্কাপাত ও রক্তবৃষ্টি হোলো। যোদ্ধারা ভীত হয়ে পড়লেন। তার পর ভীষ্মকে সামনে রেখে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সহ দুর্যোধন প্রভৃতি কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।

______________

(ক্রমশ)