Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 104

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০৪

রথী, মহারথ, অতিরথ গণনা এবং ভীষ্ম ও কর্ণের বিবাদের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

 

রথী, মহারথ, অতিরথ গণনা এবং ভীষ্ম ও কর্ণের বিবাদের কাহিনি

কৌরব পক্ষের সেনাপতির পদে নিযুক্ত হয়ে ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, দেবসেনাপতি মহাশক্তিধর কুমার কার্তিকেয়কে নমস্কার করে আমি সেনাপতিত্বের দায়িত্ব নিলাম। তুমি দুশ্চিন্তা দূর করো, আমি শাস্ত্র অনুসারে যথাসাধ্য যুদ্ধ এবং তোমার সৈন্যদের রক্ষা করবো।

দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আপনি গণনায় দক্ষ, উভয় পক্ষে রথী, মহারথ ও অতিরথ কে কে আছেন আমরা শুনতে ইচ্ছা করি।

ভীষ্ম বললেন, তুমি ও তোমার ভাইয়েরা সকলেই শ্রেষ্ঠ রথী। ভোজবংশীয় কৃতবর্মা, মদ্ররাজ শল্য যিনি নিজের ভাগ্নেদের ছেড়ে তোমার পক্ষে এসেছেন, সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা — এঁরা অতিরথ। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ দুই রথীর সমান। কম্বোজরাজ সুদক্ষিণ, মাহিষ্মতীর রাজা নীল, অবন্তিদেশের বিন্দ ও অনুবিন্দ, ত্রিগর্তদেশীয় সত্যরথ সহ পাঁচ ভাই, তোমার পুত্র লক্ষ্মণ, দুঃশাসনের পুত্র, কৌশলরাজ বৃহদ্বল, তোমার মাতুল শকুনি, রাজা পৌরব, কর্ণপুত্র বৃষসেন, মধুবংশীয় জলসন্ধ, গান্ধারবাসী অচল ও বৃষক — এরা রথী। কৃপাচার্য অতিরথ। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মহারথ, কিন্তু একটি মহা দোষের জন্য আমি তাকে রথী বা অতিরথ মনে করতে পারি না কারণ ইনি নিজের জীবন অত্যন্ত প্রিয় জ্ঞান করেন, নতুবা ইনি অদ্বিতীয় বীর হতেন। দ্রোণাচার্য একজন শ্রেষ্ঠ অতিরথ, ইনি দেবতা, গন্ধর্ব, মানুষ সকলকেই বিনষ্ট করতে পারেন, কিন্তু স্নেহবশে অর্জুনকে বধ করবেন না। বাহ্নীক অতিরথ। তোমার সেনাপতি সত্যবান, মহাবল মায়াবী রাক্ষস অলম্বুষ, প্রাগজ্যোতিষরাজ ভগদত্ত - এঁরা মহারথ। তোমার প্রিয় সখা ও মন্ত্রণাদাতা নীচপ্রকৃতি অত্যন্ত গর্বিত এই কর্ণ অতিরথ নয়, পূর্ণরথীও নয়। এ সর্বদাই পরনিন্দা করে, এর সহজাত কবচকুণ্ডল এখন নেই, পরশুরামের শাপে এর শক্তিরও ক্ষয় হয়েছে। আমার মতে কর্ণ অর্ধরথ, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করলে জীবিত অবস্থায় ফিরবে না।

দ্রোণ বললেন, ভীষ্মের কথা সত্য, কর্ণের অভিমান আছে, অথচ এঁকে যুদ্ধ থেকে পালাতেও দেখা যায়। কর্ণ দয়ালু ও অসাবধান, সেজন্য আমিও এঁকে অর্ধরথ মনে করি।

ক্রোধে চোখ লাল করে কর্ণ বললেন, পিতামহ, আপনি বিনা অপরাধে আমাকে কটুকথা বলেন, দুর্যোধনের জন্যই আমি তা সহ্য করি। আমার মতে আপনিই অর্ধরথ। লোকে আবার বলে ভীষ্ম মিথ্যা কথা বলেন না! আপনি ইচ্ছামত রথী আর অতিরথ বলে যোদ্ধাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করছেন। ভীষ্ম সব সময় সর্বদাই কৌরবগণের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেন, কিন্তু দুর্যোধন তা বোঝে না। ভীষ্মের অভিসন্ধি ভাল নয়, তুমি এঁকে ত্যাগ করো। ইনি সকলের সঙ্গেই স্পর্ধা করেন, কাউকে পুরুষ বলে গণ্য করেন না, অথচ এঁকে দেখলে সব পণ্ড হয়। বৃদ্ধের বচন শোনা উচিত, কিন্তু অতিবৃদ্ধের নয়, তারা বালকের সমান। ভীষ্ম জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করবো না, এঁর মৃত্যুর পর আমি বিপক্ষের সকল মহারথের সঙ্গেই যুদ্ধ করবো।

ভীষ্ম কর্ণকে বললেন, যুদ্ধ আসন্ন, এ সময়ে আমাদের মধ্যে ভেদ হওয়া অনুচিত, সেই কারণেই তুমি জীবিত রইলে। স্বয়ং পরশুরাম আমাকে অস্ত্রাঘাতে আহত করতে পারেননি, তুমি আমার কি করবে?

দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আমার কিসে শুভ হবে সেই চিন্তা করুন, আপনাদের দুজনকেই মহৎ কর্ম করতে হবে। এখন বলুন পাণ্ডবপক্ষে রথী, মহারথ ও অতিরথ কে কে আছেন।।

ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির নকুল সহদেব প্রত্যেকেই রথী। ভীম আট রথীর সমান। স্বয়ং নারায়ণ যাঁর সহায় সেই অর্জুনের সমান বীর ও রথী উভয় পক্ষের সৈন্যের মধ্যে নেই, কেবল আমি আর দ্রোণাচার্য তার সম্মুখীন হতে পারি। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র সকলেই মহারথ। বিরাট পুত্র উত্তর, উত্তমৌজা, যুধামন্যু এবং দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী — এরা উত্তম রথী। অভিমন্যু, সাত্যকি ও দ্রোণশিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন — এরা অতিরথ। বৃদ্ধ হলেও দ্রুপদ ও বিরাটকে আমি মহারথ মনে করি। ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র ক্ষত্ৰধর্মা এখনও বালক সেজন্য অর্ধরথ। শিশুপালপুত্র ধৃষ্টকেতু, জয়ন্ত অমিতৌজা, সত্রাজিৎ, অজ, ভোজ ও রোমান - এরা মহারথ। কেকয়দেশীয় পাঁচ ভাই, কাশীরাজ কুমার, নীল, সূর্যদত্ত, শঙ্খ, মদিরা, ব্যাঘ্ৰসেন, চন্দ্রদত্ত, সেনাবিন্দু, ক্রোধহন্তা, কাশ্য — এরা সকলেই রথী। দ্রুপদপুত্র সত্যজিৎ, শ্রেণিমান ও বসুদান, পাণ্ডবদের মামা কুন্তিভোজ দেশের পুরুজিৎ এবং ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র মায়াবী ঘটোৎকচ — এরা সকলেই অতিরথ।

তার পর ভীষ্ম বললেন, আমি তোমার জন্য যথাসাধ্য যুদ্ধ করবো, কিন্তু শিখণ্ডী আমার প্রতি বাণ নিক্ষেপ করলেও আমি তাকে বধ করবো না, কারণ সে পূর্বে নারী ছিলো এবং পরে পুরুষ হয়েছে। পাণ্ডবগণকেও আমি বধ করবো না।

______________

(ক্রমশ)