Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 106

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১০৬

কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষের যুদ্ধযাত্রা এবং যুদ্ধের নিয়ম নির্ধারণের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষের যুদ্ধযাত্রা এবং যুদ্ধের নিয়ম নির্ধারণের কাহিনি

ভীষ্মকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করার পরদিন সকালে দুর্যোধন ভীষ্ম প্রভৃতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম, অর্জুন, ধৃষ্টদ্যুম্নাদি দ্বারা পরিচালিত এই বিশাল পাণ্ডববাহিনী আপনারা কত দিনে বিনষ্ট করতে পারবেন?

ভীষ্ম বললেন, আমি প্রতিদিন দশ হাজার সৈন্য এবং এক হাজার রথীকে বধ করবো, তাতে এক মাসে সমস্ত বিনষ্ট হবে। দ্রোণ বললেন, আমি বৃদ্ধ হয়েছি, শক্তিও কমে গেছে, তথাপি আমিও ভীষ্মের মতো এক মাসে পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করতে পারবো। কৃপ বললেন, আমি দুই মাসে পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করতে পারবো। অশ্বত্থামা বললেন, আমি দশ দিনে পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করতে পারবো। কর্ণ বললেন, আমি পাঁচ দিনে পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করতে পারবো।

কর্ণের কথায় ভীষ্ম জোরে হাসতে হাসতে বললেন, এখন পর্যন্ত তুমি কৃষ্ণের সঙ্গে রথারোহী অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে মিলিত হওনি তাই এমন মনে করছ। তুমি যা ইচ্ছা হয় তাই বলতে পারো।

যুধিষ্ঠির তার গুপ্তচরদের কাছে কৌরবগণের এই আলোচনার সংবাদ পেয়ে তিনি তার ভাইদের জানালে অর্জুন বললেন, কৌরবপক্ষের অস্ত্রবিশারদ যোদ্ধারা নিজেদের সামর্থ্য সম্বন্ধে যা বলেছেন তা সত্য। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি কৃষ্ণের সহায়তায় একাই মূহুর্তের মধ্যে ত্রিলোক সংহার করতে পারি, কারণ, কিরাতরূপী মহাদেবের দেওয়া ভয়ঙ্কর অস্ত্র আমার কাছে আছে। কিন্তু এই দিব্য অস্ত্র দ্বারা যুদ্ধে লোকহত্যা অনুচিত, অতএব আমরা সরল উপায়েই শত্রু জয় করবো, পরাক্রান্ত মহারথগণ আমাদের সহায় আছেন।

সকালবেলায় কৌরবপক্ষীয় রাজাগণ স্নানের পর মালা ও শুভ্র বসন পরলেন, তারপর হোম ও স্বস্তিবাচন করে দুর্যোধনের আদেশে পাণ্ডবগণের অভিমুখে যাত্রা করলেন। দ্রোণাচার্য প্রথম দলের, ভীষ্ম দ্বিতীয় দলের এবং দুর্যোধন তৃতীয় দলের অগ্রভাগে চললেন। কৌরবপক্ষের বীরগণ কুরুক্ষেত্রের পশ্চিম দিকে সমবেত হলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণও সুসজ্জিত হয়ে যাত্রা করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রথম সৈন্যদলের, ভীম সাত্যকি ও অর্জুন দ্বিতীয় দলের এবং বিরাট দ্রুপদ প্রভৃতির সঙ্গে যুধিষ্ঠির তৃতীয় দলের অগ্রভাগে চললেন। হাজার হাজার সৈন্য গর্জন করতে করতে এবং ভেরী ও শঙ্খ বাজাতে বাজাতে পাণ্ডবদের পশ্চাতে চললো।

পাণ্ডবগণ কুরুক্ষেত্রের পশ্চিম দিকে সসৈন্যে পূর্বমুখ হয়ে অবস্থান করলেন। নিজেদের সৈন্যদের যাতে চেনা যায় সেই জন্য যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন নিজ নিজ সৈন্যদলের বিভিন্ন নাম রাখলেন এবং পরিচয়সূচক পোশাক দিলেন।

তারপর রথে আসীন হয়ে কৃষ্ণ ও অর্জুন তাদের পাঞ্চজন্য ও দেবদত্ত নামক দিব্য শঙ্খ বাজালেন। সেই শঙ্খের আওয়াজ শুনে পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যরা উল্লসিত হোলো আর বিপক্ষ সৈন্য ও তাদের বাহনগণ আতঙ্কিত হোলো। কুরুক্ষেত্রে দুই পক্ষের বিপুল সৈন্যসমাবেশের ফলে মনে হোলো যেন পৃথিবীর অন্য কোথাও বালক, বৃদ্ধ ও স্ত্রী ভিন্ন অন্য কোনো মানুষ, ঘোড়া, রথ, হাতি অবশিষ্ট নেই।

যুদ্ধ আরম্ভের আগে উভয় পক্ষের সম্মতিতে এইসকল নিয়ম নির্ধারিত হোলো - যুদ্ধ শেষ হলে উভয় দলের মধ্যে যথাসম্ভব সুসম্পর্ক স্থাপিত হবে আর কারোর মধ্যে কোনো ছলনা থাকবে না। এক পক্ষ বাগযুদ্ধ শুরু করলে অপর পক্ষও বাক্য দ্বারা জবাব দেবেন। যারা সৈন্যদল থেকে বেরিয়ে আসবে তাদের হত্যা করা হবে না। রথীর সঙ্গে রথী, গজারোহীর সঙ্গে গজারোহী, অশ্বারোহীর সঙ্গে অশ্বারোহী, এবং পদাতিকের সঙ্গে পদাতিক যুদ্ধ করবে। বিপক্ষকে আগে জানাতে হবে, তারপর নিজের যোগ্যতা ইচ্ছা উৎসাহ ও শক্তি অনুসারে আক্রমণ করা যেতে পারবে, কিন্তু বিশ্বস্ত বা শঙ্কিত লোককে প্রহার করা হবে না। অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত, শরণাগত, যুদ্ধে বিমুখ, অস্ত্রহীন বা বর্মহীন লোককে কখনও মারা হবে না। স্তুতিপাঠক, রথচালক, ভারবাহক, অস্ত্রের যোগানদার এবং ভেরী প্রভৃতির বাদ্যকারকে প্রহার করা হবে না।

______________

(ক্রমশ)