Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 113

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১১৩

যুদ্ধের তৃতীয় দিনে কৃষ্ণের ক্রোধ প্রকাশের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

যুদ্ধের তৃতীয় দিনে কৃষ্ণের ক্রোধ প্রকাশের কাহিনি

দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধের পরদিন সকালে ভীষ্ম গারুড় ব্যূহ এবং পাণ্ডবগণ অর্ধচন্দ্র ব্যূহ রচনা করলেন। দুই পক্ষের যুদ্ধ আরম্ভ হোলো, দ্রোণ দ্বারা রক্ষিত কৌরবব্যূহ এবং ভীম ও অর্জুন দ্বারা রক্ষিত পাণ্ডবব্যূহ কোনওটি বিচ্ছিন্ন হোলো না, সৈন্যগণ ব্যূহের অগ্রভাগ থেকে বেরিয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। সৈনিক, ঘোড়া ও হাতির মৃতদেহে এবং মাংস ও রক্তের কাদায় রণভূমি চলাচলের অযোগ্য হয়ে উঠল। কৌরবদের পক্ষে ভীষ্ম, দ্রোণ, জয়দ্রথ, পুরুমিত্র, বিকর্ণ ও শকুনি এবং পাণ্ডবপক্ষে ভীম, ঘটোৎকচ, সাত্যকি, চেকিতান ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ পরস্পর বিপক্ষের সৈন্য বিনাশ করতে লাগলেন। ভীমের তীরের আঘাতে দুর্যোধন অচেতন হয়ে রথের উপর পড়ে গেলে তাঁর সারথি তাঁকে সত্বর রণভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল, তাঁর সৈন্যরাও ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল।

চেতনা ফিরে পেয়ে দুর্যোধন ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, আপনি, অস্ত্রজ্ঞগণের শ্রেষ্ঠ দ্রোণ এবং মহাধনুর্ধর কৃপ জীবিত থাকতে আমাদের সৈন্য পালাচ্ছে, এ অতি অসংগত মনে করি। পাণ্ডবগণ কখনও আপনাদের সমান নয়, তারা নিশ্চয় আপনার অনুগ্রহভাজন তাই আমাদের সৈন্যক্ষয় আপনি উপেক্ষা করছেন। আপনার উচিত ছিল পূর্বেই আমাকে বলা যে পাণ্ডব, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে আপনি যুদ্ধ করবেন না। আপনার দ্রোণের ও কৃপের মনোভাব পূর্বে জানতে পারলে আমি কর্ণের সঙ্গেই কর্তব্য স্থির করতাম। যদি আপনারা আমাকে ত্যাগ না করে থাকেন তবে এখন যথাশক্তি যুদ্ধ করুন।

ক্রোধ দমন কোরে ভীষ্ম সহাস্যে দুর্যোধনকে বললেন, তোমাকে আমি বহুবার বলেছি যে পাণ্ডবগণ ইন্দ্রাদি দেবতারও অজেয়। আমি বৃদ্ধ, তথাপি যথাশক্তি যুদ্ধ করবো, আজ আমি একাকীই পাণ্ডবগণকে তাদের সৈন্য ও বন্ধু সমেত প্রতিহত করবো। ভীষ্মের এই প্রতিজ্ঞা শুনে দুর্যোধন ও তার ভাইয়েরা আনন্দিত হয়ে শঙ্খ ও ভেরী বাজালেন।

সেই দিনে দুপুরবেলা ভীষ্ম বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে এবং দুর্যোধনাদি কর্তৃক রক্ষিত হয়ে পাণ্ডবসৈন্যের প্রতি ধাবিত হলেন। তাঁর শরবর্ষণে পীড়িত হয়ে পাণ্ডবগণের সৈন্যেরা ভীত হোলো, মহারথগণ পালাতে লাগলেন, অর্জুন প্রভৃতি চেষ্টা করেও তাদের নিবারণ করতে পারলেন না। পাণ্ডবসেনা পালাতে লাগল আর পালাবার সময়ে সকলে হাহাকার করতে লাগল।

কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, তোমার আকাঙ্ক্ষিত সময় উপস্থিত হয়েছে, যদি মোহগ্রস্ত না হও তবে ভীষ্মকে প্রহার করো। অর্জুনের অনুরোধে কৃষ্ণ ভীষ্মের কাছে রথ নিয়ে গেলেন। তখন ভীষ্ম ও অর্জুনের ঘোর যুদ্ধ হতে লাগল। অর্জুনের তীর চালনা দেখে ভীষ্ম বললেন, সাধু সাধু পাণ্ডুপুত্র! বৎস, আমি অতিশয় প্রীত হয়েছি, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো। এই সময়ে কৃষ্ণ অশ্বচালনায় পরম কৌশল দেখালেন, তিনি ভীষ্মের বাণ ব্যর্থ করে দ্রুতবেগে মণ্ডলাকারে রথ চালাতে লাগলেন।

ভীষ্মের পরাক্রম এবং অর্জুনের সরল যুদ্ধ দেখে কৃষ্ণ চিন্তা করলেন - যুধিষ্ঠির বলহীন হয়েছেন, তাঁর মহাসৈন্য পালাচ্ছে এবং কৌরবগণ খুশি হয়ে দ্রুতবেগে আসছে। তীক্ষ্ম শরে আহত হয়েও অর্জুন নিজের কর্তব্য বুঝছেন না, ভীষ্মের গৌরব তাকে মোহগ্রস্ত করেছে। আজ আমিই ভীষ্মকে বধ করে পাণ্ডবদের ভার হরণ করবো।

সাত্যকি দেখলেন, কৌরবগণের হাজার হাজার অশ্বারোহী, গজারোহী, রথী ও পদাতিক অর্জুনকে ঘিরে ফেলেছে এবং ভীষ্মের বাণের আঘাতে আহত হয়ে বহু পাণ্ডবসৈন্য পালিয়ে যাচ্ছে। সাত্যকি বললেন, ক্ষত্রিয়গণ, কোথায় যাচ্ছ? পলায়ন ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয়, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ কোরো না, বীরধর্ম পালন করো। কৃষ্ণ বললেন, সাত্যকি, যারা যাচ্ছে তারা যাক, যারা আছে তারাও যাক। দেখো, আজ আমিই অনুচর সহ ভীষ্ম ও দ্রোণকে নিহত করবো। আজ আমার কাছে কোনও কৌরব নিস্তার পাবে না, আজ আমি ভীষ্ম ও দ্রোণাদি এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে বধ করে অজাতশত্রু যুধিষ্ঠিরকে রাজপদে বসাবো।

তারপর স্মরণ করা মাত্র কৃষ্ণের হাতে সুদর্শন চক্র উপস্থিত হোলো। তিনি রথ থেকে লাফিয়ে নেমে সেই ক্ষুরধার সূর্য মতো উজ্জ্বল হাজার বজ্রতুল্য চক্র ঘোরালেন এবং সিংহ যেমন মত্ত হাতিকে বধ করতে যায় কৃষ্ণ তেমন ভীষ্মের দিকে ধাবিত হলেন। কৃষ্ণের বুকের উপর লম্বমান হলুদ রং-এর উত্তরীয়, তিনি বিদ্যু চমকিত মেঘের মতো গর্জন কোরে সক্রোধে চক্র হাতে আসছেন দেখে কৌরবগণের বিনাশের ভয়ে সকলে আর্তনাদ কোরে উঠল। ভীষ্ম তাঁর ধনু রেখে দিয়ে ধীরভাবে কৃষ্ণকে বললেন, হে দেবেশ চক্রপাণি কৃষ্ণ, এসো, তোমাকে নমস্কার করি। সকল শরণাগতের লোকনাথ, আমাকে রথ থেকে নিপাতিত করো। কৃষ্ণ, তোমার হাতে নিহত হলে আমি ইহলোকে ও পরলোকে শ্ৰেষ্ঠত্ব লাভ করব। তুমি আমার প্রতি ধাবিত হয়েছ তাতেই আমি সকলের কাছে সম্মানিত হয়েছি।

অর্জুন রথ থেকে লাফিয়ে নেমে কৃষ্ণের দুই বাহু ধরলেন এবং প্রবল বাতাসে শুকনো পাতা যেমন চালিত হয় তেমন কৃষ্ণ কর্তৃক কিছুদূর পর্যন্ত বেগে চালিত হলেন, তার পর কৃষ্ণের দুই পা ধরে তাকে সবলে আটকালেন। অর্জুন কৃষ্ণকে প্রণাম কোরে বললেন, তুমিই পাণ্ডবদের গতি, ক্রোধ সংবরণ করো। আমি পুত্র ও ভাইদের নামে শপথ করছি, আমার প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করবো না, আমি কৌরবগণকে বধ করবো। কৃষ্ণ প্রসন্ন হয়ে আবার রথে উঠলেন এবং পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজিয়ে সমস্ত দিক ও আকাশ মুখরিত করলেন।

তার পর অর্জুন অতি ভয়ংকর মাহেন্দ্র অস্ত্র প্রয়োগ করলে কৌরবপক্ষের বহু পদাতিক সৈন্য, ঘোড়া, রথ ও হাতি বিনষ্ট হোলো, রণভূমিতে রক্তের নদী বইতে লাগল। তারপর সূর্যাস্ত হলে ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন প্রভৃতি যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হলেন। কৌরব সৈন্যগণ বলতে লাগল, আজ অর্জুন দশ হাজার রথী, সাত শত হাতি এবং সমস্ত প্রাচ্য, সৌবীর, ক্ষুদ্র ও মালব সৈন্যদের বিনাশ করেছেন, তিনি একাকীই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, ভূরিশ্রবা, শল্য প্রভৃতি বীরগণকে জয় করেছেন। এই বলে তারা বহু সহস্র মশাল জ্বেলে শিবিরে চলে গেল।

______________

(ক্রমশ)