মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১১৭
যুদ্ধের অষ্টম দিনে ইরাবানের মৃত্যু এবং ঘটোৎকচের মায়ার কাহিনি
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
যুদ্ধের অষ্টম দিনে ইরাবানের মৃত্যু এবং ঘটোৎকচের মায়ার কাহিনি
অষ্টম দিনের যুদ্ধে সৈন্যদেরকে ভীষ্ম কচ্ছ্প ব্যূহ এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন গণ্ডার ব্যূহ রচনা করলেন। যোদ্ধারা পরস্পরের নাম ধরে ডেকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন। ভীষ্ম পাণ্ডবদের সৈন্য বিনাশ করতে লাগলেন। এই দিনের যুদ্ধে দুর্যোধনের ভাই সুনাভ, অপরাজিত, কুণ্ডধার, পণ্ডিত, বিশালাক্ষ, মহোদর, আদিত্যকেতু ও বহাশী ভীমের হাতে নিহত হলেন। ভাইদের শোকে কাতর হয়ে দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে বিলাপ করতে লাগলেন। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, আমি, দ্রোণ, বিদুর ও গান্ধারী আগেই তোমাকে সাবধান করেছিলাম, কিন্তু তুমি আমাদের কথা শোনোনি। এ কথাও তোমাকে আগে বলেছি যে আমি বা আচার্য দ্রোণ পাণ্ডবদের হাত থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারব না। ভীম ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের যাকে পাবে তাকেই বধ করবে। অতএব তুমি স্থিরভাবে দৃঢ়চিত্তে স্বৰ্গকামনায় যুদ্ধ করো।
অর্জুনপুত্র ইরাবান কৌরবসেনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলেন, কম্বোজ, সিন্ধু প্রভৃতি বহু দেশের দ্রুতগামী ঘোড়া সুসজ্জিত হয়ে তাঁকে ঘিরে চললো। এই ইরাবান নাগরাজ ঐরাবতের কন্যার গর্ভে অর্জুনের ঔরসে জন্মেছিলেন। ঐরাবতের কন্যার আগের পতি গরুড় কর্তৃক নিহত হন। তার পর ঐরাবত তার শোকাতুরা বিধবা কন্যাকে অর্জুনের হাতে অর্পণ করেন। কর্তব্যবোধে অর্জুন সেই পরপত্নীর গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। এই পুত্রই ইরাবান। ইনি নাগলোকে মায়ের কাছে পালিত হন। অর্জুনের প্রতি বিদ্বেষবশত ইরাবানের কাকা দুরাত্মা অশ্বসেন তাকে ত্যাগ করেন। অর্জুন যখন দেবলোকে অস্ত্রশিক্ষা করছিলেন তখন ইরাবান তার কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। অর্জুন তাকে বলেছিলেন, যুদ্ধকালে আমাদের সাহায্য কোরো।
গজ, গবাক্ষ, বৃষক, চর্মবান, আর্জক ও শুক - শকুনির এই ছয় ভাইয়ের সঙ্গে ইরাবানের যুদ্ধ হোলো। ইরাবানের অনুগামী যোদ্ধারা গান্ধারদের সৈন্য বিনাশ করতে লাগলেন এবং শকুনির ছয় ভাইকেই বধ করলেন। তখন দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে অলম্বুষ রাক্ষসকে বললেন, অর্জুনের এই মায়াবী পুত্র আমার ঘোর ক্ষতি করছে, তুমি ওকে বধ করো। বহু যোদ্ধা পরিবেষ্টিত হয়ে অলম্বুষ ইরাবানকে আক্রমণ করলে দুজনে মায়াযুদ্ধ হতে লাগল। ইরাবান অনন্তনাগের মতো বিশাল মূর্তি ধারণ করলে ইরাবানের মাতৃকুলের বহু নাগ তাকে ঘিরে রইল। অলম্বুষ গরুড়ের রূপ ধরে সেই নাগদের খেয়ে ফেললে ইরাবান মোহগ্রস্ত হওয়ায় অলম্বুষ খড়গাঘাতে তাকে বধ করলো।
ইরাবানকে নিহত দেখে ঘটোৎকচ ক্রোধে গর্জন করে উঠলেন, তাতে কুরুসৈন্যরা ভীষণ আতঙ্কিত হোলো। দুর্যোধন ঘটোৎকচের দিকে ধাবিত হলেন আর বঙ্গরাজ্যের অধিপতি দশ হাজার হাতি নিয়ে তার পিছনে গেলেন। দুর্যোধনের উপর ঘটোৎকচ অসংখ্য শরবর্ষণ করতে লাগলেন, তার শক্তির আঘাতে বঙ্গরাজ্যের অধিপতির বাহন হাতি নিহত হোলো। ঘটোৎকচ দ্রোণের ধনু ভেঙ্গে ফেললেন, বাহ্লীক, চিত্রসেন ও বিকর্ণকে আহত করলেন এবং বৃহদ্বলের বুক চীরে ফেললেন। এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে কৌরবসৈন্য পরাস্ত হোলো।
অশ্বত্থামা দ্রুত এসে ঘটোৎকচ ও তাঁর অনুচর রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ঘটোৎকচ এক দারুণ মায়া প্রয়োগ করলেন, যার প্রভাবে কৌরবপক্ষের সকলে দেখল দ্রোণ, দুর্যোধন, শল্য ও অশ্বত্থামা রক্তাক্ত হয়ে ছিন্নদেহে ছটফট করছেন, কৌরববীরগণ প্রায় সকলে নিহত হয়েছেন এবং বহু হাজার ঘোড়া ও আরোহী খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে কৌরব সৈন্যগণ শিবিরের দিকে ধাবিত হোলো। তখন ভীষ্ম বললেন, তোমরা পালিও না, যুদ্ধ করো, যা দেখছ তা রাক্ষসী মায়া। সৈন্যরা বিশ্বাস না কোরে পালিয়ে গেল।
দুর্যোধনের মুখে এই পরাজয় সংবাদ শুনে ভীষ্ম বললেন, তুমি সর্বদা আত্মরক্ষায় সতর্ক থেকে যুধিষ্ঠির বা তার কোনও ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, কারণ রাজধর্ম অনুসারে রাজার সঙ্গেই রাজা যুদ্ধ করেন। তার পর ভীষ্ম ভগদত্তকে বললেন, আপনি শীঘ্র হিড়িম্বাপুত্ৰ ঘটোৎকচের কাছে সসৈন্যে গিয়ে তাকে বধ করুন, আপনিই তার উপযুক্ত প্রতিযোদ্ধা।
ঘটোৎকচের সঙ্গে ভীম, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, চেদিরাজ, দশার্ণরাজ প্রভৃতি ছিলেন। ভগদত্ত সুপ্রতীক নামক বৃহৎ হাতিতে চড়ে এলেন এবং ভীষণ শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করলে ঘটোৎকচ তা ভেঙে ফেললেন। তখন ভগদত্ত সকলের উপর বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। এই সময়ে অর্জুন তাঁর পুত্র ইরাবানের মৃত্যুসংবাদ শুনে শোকার্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ভীষ্ম, কৃপ প্রভৃতিকে আক্রমণ করলেন। ভীমের শরাঘাতে দুর্যোধনের সাত ভাই অনাধৃষ্টি, কুণ্ডভেদী, বিরাজ, দীপ্তলোচন, দীর্ঘবাহু, সুবাহু ও কনকধ্বজ মারা গেলে তাদের অন্য ভাইয়েরা ভয়ে পালিয়ে গেলেন।।
সন্ধ্যায় যুদ্ধের বিরাম হোলে কৌরব ও পাণ্ডবগণ নিজ নিজ শিবিরে চলে গেলেন।
______________
(ক্রমশ)