Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 121

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২১

ভীষ্মের শরশয্যার কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভীষ্মের শরশয্যার কাহিনি

ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করলে কৌরব ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধ বন্ধ করলেন। সকলে বলতে লাগলেন, ইনি ব্রহ্মবিদগণের শ্রেষ্ঠ, এই মহাপুরুষ পিতা শান্তনুকে কামার্ত জেনে নিজে বিয়ে করেননি। পাণ্ডব সৈন্যদের মধ্যে হাজার হাজার তূর্য ও শঙ্খ বাজতে লাগল, ভীম মহাহর্ষে ক্রীড়া করতে লাগলেন। দুঃশাসনের মুখে ভীষ্মের পতনের সংবাদ শুনে দ্রোণ মূৰ্ছিত হলেন এবং চেতনা লাভের পর নিজের অধিনস্থ সৈন্যগণকে যুদ্ধ থেকে নিরস্ত করলেন। রাজারা বর্ম ত্যাগ করে ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন, কৌরব ও পাণ্ডবগণ তাঁকে প্রণাম করে সম্মুখে দাঁড়ালেন।

সকলকে স্বাগত সম্ভাষণ করে ভীষ্ম বললেন, মহারথগণ, তোমাদের দর্শন করে আমি তুষ্ট হয়েছি। আমার মাথা ঝুলছে, একটি বালিশ দাও। রাজারা কোমল উত্তম বালিশ নিয়ে এলে ভীষ্ম সহাস্যে বললেন, এসব বালিশ বীরশয্যার উপযুক্ত নয়। তিনি অর্জুনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে অর্জুন সজল নয়নে বললেন, পিতামহ, আদেশ করুন কি করতে হবে। ভীষ্ম বললেন, বৎস, তুমি ক্ষত্রধর্ম জানো, বীরশয্যার উপযুক্ত বালিশ আমাকে দাও। তখন অর্জুন তিন বাণ গাণ্ডীব ধনু দ্বারা নিক্ষেপ কোরে অর্জুন ভীষ্মের মাথা তুলে দিলেন। ভীষ্ম তুষ্ট হয়ে বললেন, রাজাগণ, অর্জুন আমাকে কিরূপ বালিশ দিয়েছেন দেখো। উত্তরায়ণের আরম্ভ পর্যন্ত আমি এই শয্যায় শুয়ে থাকব, সূর্য যখন উত্তর দিকে গিয়ে সর্বলোক আলোকিত করবে তখন আমি প্রাণ ত্যাগ করবো। তোমরা আমার চার দিকে পরিখা খনন করিয়ে দাও।

শল্যচিকিৎসায় নিপুণ বৈদ্যগণ চিকিৎসার উপকরণ নিয়ে উপস্থিত হলেন। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, তুমি এঁদের উপযুক্ত ধন দিয়ে সসম্মানে বিদায় করো। বৈদ্যের প্রয়োজন নেই, আমি ক্ষত্রিয়ের প্রশস্ত গতি লাভ করেছি, এইসকল তীর সমেত যেন আমাকে দাহ করা হয়। সমাগত রাজারা এবং কৌরব ও পাণ্ডবগণ ভীষ্মকে অভিবাদন ও তিন বার প্রদক্ষিণ করলেন, তার পর তার রক্ষার ব্যবস্থা করে শোকার্ত মনে নিজ নিজ শিবিরে চলে গেলেন।

পরদিন সকালে সবাই আবার ভীষ্মের নিকটে এলেন। কয়েক হাজার কন্যা ভীষ্মের দেহে চন্দনচুর্ণ ও মালা পরিয়ে দিলো। কৌরব ও পাণ্ডবগণ বর্ম ও অস্ত্র ত্যাগ কোরে আগের মতো ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হলেন। শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য কোরে ভীষ্ম রাজাদের জল চাইলেন। সকলে নানাপ্রকার খাদ্য ও শীতল জলের কলস নিয়ে এলেন। ভীষ্ম বললেন, বৎসগণ, আমি মানুষের ভোগ্য বস্তু নিতে পারি না। তার পর তিনি অর্জুনকে বললেন, তোমার বাণে আমার শরীর বিদ্ধ হয়েছে, যন্ত্রণায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, তুমি আমাকে উপযুক্ত জল দাও।

ভীষ্মকে প্রদক্ষিণ করে অর্জুন রথে উঠলেন এবং মন্ত্রপাঠের পর গাণ্ডীবে পর্জনাস্ত্র বাণ নিক্ষেপ কোরে ভীষ্মের দক্ষিণ পাশের ভূমি বিদ্ধ করলে সেখান থেকে অমৃততুল্য দিব্যগন্ধ স্বাদু নির্মল শীতল জলধারা উঠলে অর্জুন সেই জলে ভীষ্মকে তৃপ্ত করলেন। রাজারা বিস্মিত হয়ে উত্তরীয় নাড়তে লাগলেন, চতুর্দিকে তুমুল রবে শঙ্খ ও দুন্দুভি বেজে উঠল।

ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, বৎস, তুমি অর্জুনকে জয় করতে পারবে না, তার সঙ্গে সন্ধি করো। পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার সুসম্পর্ক হোক, তুমি তাদের অর্ধেক রাজ্য দাও, যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে যান, তুমি জ্ঞাতিদ্রোহী হয়ে অকীর্তি ভোগ কোরো না। আমার মৃত্যুতেই প্রজাদের শান্তি হোক, রাজারা প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করুন। পিতা পুত্রকে, মামা ভাগ্নেকে, ভাই ভাইকে লাভ করুন। কিন্তু মুমূর্ষ লোকের যেমন ঔষধে রুচি হয় না, দুর্যোধনের সেইরূপ ভীষ্মবাক্যে রুচি হোলো না।

কৌরব ও পাণ্ডব পক্ষীয় ক্ষত্রিয়গণ শরশয্যায় শয়ান ভীষ্মের রক্ষার ব্যবস্থা কোরে তাঁকে সসম্মানে প্রদক্ষিণ করলেন এবং পরস্পর আলাপের পর আবার যুদ্ধের জন্য উদ্যোগী হলেন। শ্বাপদসংকুল বনে অরক্ষিত ছাগল ও মেষের দল যেমন হয়, ভীষ্মের অভাবে কৌরবগণ সেইরূপ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। তারা বলতে লাগলেন, মহাযশা কর্ণ এবং তার অমাত্য ও বন্ধুগণ দশ দিন যুদ্ধ করনেনি। যিনি অতিরথের দ্বিগুণ সেই কর্ণকে ভীষ্ম সকল ক্ষত্রিয়ের সামনে অর্ধরথ বলে গণনা করেছিলেন। সেজন্য ক্রুদ্ধ হয়ে কর্ণ ভীষ্মকে বলেছিলেন, আপনি জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করবো না, আপনি যদি পাণ্ডবগণকে বধ করতে পারেন তবে আমি যুর্যোধনের অনুমতি নিয়ে বনে যাব। আর যদি পাণ্ডবগণের হাতে আপনার স্বর্গলাভ হয় তবে আপনি যাদের রথী মনে করেন তাদের সকলকেই আমি বধ করবো। এখন ভীষ্ম নিপাতিত হয়েছেন, অথএব কর্ণের যুদ্ধ করবার সময় এসেছে। এই বলে কৌবরগণ কর্ণকে ডাকতে লাগলেন।

সকলকে আশ্বাস দিয়ে কর্ণ বললেন, মহাত্মা ভীষ্ম এই কৌরবগণকে যেমন রক্ষা করতেন আমিও সেইরূপ করবো। আমি পাণ্ডবদের যমালয়ে পাঠিয়ে যশস্বী হবো, অথবা শত্রুর হাতে নিহত হবো।

______________

(ক্রমশ)