Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 125

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২৫

সংশপ্তকগণের শপথের কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

সংশপ্তকগণের শপথের কাহিনি

একাদশ দিনের যুদ্ধের শেষে দুই পক্ষের যোদ্ধারা নিজ নিজ শিবিরে ফিরে এলেন। দ্রোণ দুঃখিত ও লজ্জিত হয়ে দুর্যোধনকে বললেন, আমি আগেই বলেছি যে অর্জুন উপস্থিত থাকলে দেবতারাও যুধিষ্ঠিরকে ধরতে পারবেন না। কৃষ্ণ ও অর্জুন অজেয়, এ বিষয়ে তুমি সন্দেহ কোরো না। কোনও উপায়ে অর্জুনকে সরাতে পারলেই যুধিষ্ঠির তোমার বশে আসবেন। কেউ যদি অৰ্জুনকে যুদ্ধে অন্য কোথাও ব্যস্ত রাখে তবে অর্জুন জয়লাভ না কোরে কখনই ফিরবেন না, সেই অবকাশে আমি পাণ্ডবসৈন্য ভেদ করে ধৃষ্টদ্যুম্নের সামনেই যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনবো।

দ্রোণাচার্যের কথা শুনে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তার ভাইয়েরা বললেন অকারণে আমাদের অপমান করেন। তারপর দুর্যোধনকে বললেন, যে কাজ আপনার প্রিয় এবং আমাদের জন্য যশের তা আমরা করবো এবং অর্জুনকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বধ করবো। আমরা প্রতিজ্ঞা করছি — পৃথিবী অর্জুনহীন অথবা সুশর্মাহীন হবে।

অযুত রথারোহী যোদ্ধার সঙ্গে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা ও তার পাঁচ ভাই সত্যরথ, সত্যবর্মা, সত্যব্রত, সত্যেষু ও সত্যকর্মা, তিন অযুত রথের সঙ্গে মালব ও তুণ্ডিকের রাজাগণ, অযুত রথের সঙ্গে মাবেল্লক, ললিথ ও মদ্রকগণ, এবং নানা জনপদ হতে আসা অযুত রথী শপথ গ্রহণে উদ্যোগী হলেন। তারা পৃথক পৃথক ভাবে আগুনে হোম করে কুশনির্মিত কৌপীন ও বিচিত্র কবচ পরলেন এবং ব্রাহ্মণগণকে সোনা, গাই ও বস্ত্র দান করলেন। তারপর আগুন জ্বেলে উচ্চস্বরে এই প্রতিজ্ঞা করলেন - যদি আমরা অর্জুন বধ না করে যুদ্ধ থেকে ফিরি, যদি তার নিপীড়নে ভীত হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করি তবে মিথ্যাবাদী ব্রহ্মঘাতী মদ্যপ গুরুদারগামী ও পরস্বহারকের যে নরক সেই নরকে আমার যাবো। যারা রাজবৃত্তি হরণ করে, শরণাগতকে ত্যাগ করে, প্রার্থীকে হত্যা করে, গৃহদাহ করে, গোহত্যা করে, অন্যের অপকার করে, বেদের বিরোধিতা করে, ঋতুকালে ভার্ষাকে প্রত্যাখ্যান করে, শ্রাদ্ধের দিনে স্ত্রীগমন করে, অন্যের গচ্ছিত রাখা ধন হরণ করে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, দুর্বলের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং নাস্তিক, অগ্নিহোত্রবর্জিত, পিতৃমাতৃত্যাগী ও অন্যবিধ পাপকারিগণ যে নরকে যায়, সেই নরকে আমরা যাবো। আর যদি আমরা যুদ্ধে কঠিন কাজ করতে পারি তবে অবশ্যই স্বর্গলোক লাভ করবো।

সুশৰ্মা প্রভৃতি এইরূপ শপথ করে দক্ষিণ দিকে গিয়ে অর্জুনকে য়ুদ্ধে আহ্বান করতে লাগলেন। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমাকে যুদ্ধে আহ্বান করলে আমি বিমুখ হই না, এই আমার ব্রত। সুশৰ্মা, তাঁর ভাইয়েরা ও অন্য সংশপ্তকগণ আমাকে ডাকছে, এই আহ্বান আমি উপেক্ষা করতে পারছি না, আপনি আজ্ঞা দিন আমি ওঁদের বধ করতে যাই। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি জান যে দ্রোণ আমাকে ধরতে চান, তাঁর এই অভিপ্রায় যাতে সিদ্ধ না হয় তাই করো। অর্জুন বললেন, এই পাঞ্চালবীর সত্যজিৎ আজ যুদ্ধে আপনাকে রক্ষা করবে, এ জীবিত থাকতে দ্রোণের ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। যদি সত্যজিৎ নিহত হয় তবে সকলের সঙ্গে মিলিত হয়েও আপনি রণস্থলে থাকবেন না।

রাত্রি প্রভাত হলে যুধিষ্ঠির সস্নেহে অর্জুনকে আলিঙ্গন ও আশীর্বাদ করে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন।

______________

(ক্রমশ)