Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 128

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২৮

বেদব্যাস বর্ণিত সুবর্ণষ্ঠীবীর কাহিনি

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

বেদব্যাস বর্ণিত সুবর্ণষ্ঠীবীর কাহিনি

অভিমন্যু নিহত হওয়ার পর বেদব্যাস যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতে এলে যুধিষ্ঠির বেদব্যাসের কাছে ইন্দ্রের মতো বিক্রমশালী নিস্পাপ সত্যবাদী পুণ্যবান রাজর্ষিদের কথা জানতে চাইলে, বেদব্যাস এই কাহিনি বললেন - একদিন দেবর্ষি নারদ ও পর্বত তাঁদের সখা রাজা সৃঞ্জয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তারা বসবার পরে একটি সুদর্শনা সুহাসিনী কন্যা তাদের কাছে এলেন। পর্বত ঋষি জিজ্ঞাসা করলেন, এই সর্বলক্ষণযুক্তা কন্যাটি কার? এর সৌন্দর্য সূর্যের কিরণ, আগুনের শিখা এবং চাঁদের প্রভার সঙ্গে তুলনীয়। সৃঞ্জয় বললেন এ আমারই কন্যা। নারদ সৃঞ্জয়কে বললেন, যদি তুমি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে চাও তবে এই কন্যাকে আমার সঙ্গে বিবাহ দাও। তখন পর্বত ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে নারদকে বললেন, আমি আগেই যাকে মনে মনে স্ত্রীরূপে বরণ করেছি তাকেই তুমি চাইছ? নারদ, তুমি আর নিজের ইচ্ছানুসারে স্বর্গে যেতে পারবে না। নারদ বললেন, মন্ত্রপাঠাদির দ্বারা বিবাহ সম্পূর্ণ হয় না, সপ্তপদীগমনেই সম্পূর্ণ হয়। এই কন্যা আমার স্ত্রী হবার আগেই তুমি আমাকে শাপ দিয়েছ, অতএব তুমিও আমার সঙ্গে ছাড়া স্বর্গে যেতে পারবে না। পরস্পর অভিশাপের পর নারদ ও পর্বত সৃঞ্জয়ের ভবনেই বাস করতে লাগলেন।

রাজা সৃঞ্জয় তপস্যাপরায়ণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণকে সেবা দ্বারা তুষ্ট কোরে বর চাইলেন, যেন তার গুণবান যশস্বী কীর্তিমান তেজস্বী ও শত্রুনাশকারী পুত্র হয়। বর পেয়ে যথাকালে তার একটি পুত্র হোলো। এই পুত্রের মল-মুত্র ও ঘাম সুবর্ণময়, সেজন্য তার নাম হল সুবর্ণষ্ঠীবী। এই শিশুপুত্র কোনো কিছু স্পর্শ করলে তা সোনায় রূপান্তরিত হয়ে যেত। রাজা সৃঞ্জয় তার ইচ্ছা মতো সকল বস্তু স্বর্ণে রূপান্তরিত করাতে লাগলেন, কালক্রমে তাঁর ভবন প্রাচীর দুর্গ ব্রাহ্মণাবাস শয্যা আসন যান প্রভৃতি সবই স্বর্ণময় হোলো। এক দল দস্যু লোভের বশবর্তী হয়ে সোনার খনির মতো এই রাজপুত্রকে হরণ করে বনে নিয়ে গেল। তারা সুবর্ণষ্ঠীবীকে কেটে খণ্ড খণ্ড করলো, কিন্তু তাদের কোনও অর্থলাভ হোলো না। এদিকে রাজপুত্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রাজার সমস্ত সোনা লুপ্ত হোলো, মূর্খ দস্যুরাও বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পরস্পরকে বধ করে নরকে গেল।

সৃঞ্জয় পুত্রশোকে মৃতপ্রায় হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। নারদ তাকে বললেন, আমরা ব্রহ্মবাদী ঋষি তোমার ভবনে বাস করছি, আর তুমি কাঙ্খিত বিষয়ের ভোগে অতৃপ্ত থেকেই মরবে। যজ্ঞ বেদাধ্যয়ন দান আর তপস্যায় যারা তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ এমন বহু রাজার মৃত্যু হয়েছে, অতএব অযজ্ঞকারী অদাতা পুত্রের মৃত্যুর জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়। তারপর নারদ উদাহরণ স্বরূপ ষোল জন মহাত্মার কথা বললেন।

রাজর্ষি মরুত্ত, যাঁর ভবনে দেবতারা পরিবেশন করতেন। রাজা সুহোত্র, যাঁর জন্য পর্জন্যদেব সোনা বর্ষণ করতেন। পুরুর পুত্র জনমেজয়, যিনি প্রতি বার যজ্ঞকালে দশ হাজার স্বর্ণভূষিত হাতি কয়েক হাজার সালংকারা কন্যা এবং কোটি বলদ দক্ষিণা দিতেন। উশীনরপুত্র শিবি, যাঁর যজ্ঞে দধিদুগ্ধের মহাহ্রদ এবং অন্নের পর্বত থাকত। দশরথপুত্র রাম, যিনি সুরাসুরের অবধ্য দেবব্রাহ্মণের কণ্টক রাবণকে বধ কোরে এবং এগার হাজার বৎসর রাজত্ব কোরে প্রজাদের নিয়ে স্বর্গে গিয়েছিলেন। ভগীরথ, যাঁকে গঙ্গা পিতা বলে স্বীকার করেছিলেন। দিলীপ, যিনি যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে বসুধা দান করেছিলেন, যুবনাশ্বের পুত্র মান্ধাতা, যিনি আসমুদ্র পৃথিবী ব্রাহ্মণগণকে দান কোরে পুণ্যলোকে গিয়েছিলেন। নহুষের পুত্র যযাতি, যিনি বহুবিধ যজ্ঞ করেছিলেন এবং দ্বিতীয় ইন্দ্রের ন্যায় ইচ্ছানুসারে স্বর্গোদ্যানে বিহার করতেন। নাভাগের পুত্র অম্বরীষ, যিনি যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণাস্বরূপ রাজকোষ ও সৈন্য সহ এক লক্ষ রাজ্য দান করেছিলেন। রাজা শশবিন্দু, যাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞে এক ক্রোশ উঁচু তেরটা খাদ্যের পর্বত প্রস্তুত হয়েছিল। অমূর্তরয়ার পুত্র গয়, যিনি অশ্বমেধ যজ্ঞে মণিখচিত স্বর্ণময় পৃথিবী নির্মাণ করে ব্রাহ্মণগণকে দান করেছিলেন এবং অক্ষয় বট ও পবিত্র ব্রহ্মসরোবরের জন্য বিখ্যাত হয়েছেন। সংস্কৃতের পুত্র রন্তিদেব, যাঁর দু লক্ষ পাচক ছিল, যাঁর কাছে পশুর দল স্বর্গলাভের জন্য নিজেরাই আসত, যাঁর গৃহে অতিথি এলে একুশ হাজার বৃষ হত্যা করা হতো, কিন্তু তাতেও পর্যাপ্ত হতো না, ভোজনের সময় পাচকরা বলতো আজ মাংস কম আপনারা বেশী কোরে দাল খান। দুষ্মন্তের পুত্র ভরত, যিনি অত্যন্ত বলবান ছিলেন এবং যমুনা সরস্বতী ও গঙ্গার তীরে বহু সহস্র যজ্ঞ করেছিলেন। বেণ রাজার পুত্র পৃথু যাঁর আদেশে পৃথিবীকে দোহন করে বৃক্ষ পর্বত দেবাসুর মনুষ্য প্রভৃতি অভীষ্ট বিষয় লাভ করেছিলেন। এই মহাত্মারা সকলেই মরেছেন। জমদগ্নিপুত্র পরশুরামও মরবেন, যিনি একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন এবং কশ্যপকে সপ্তদ্বীপা বসুমতী দান করে মহেন্দ্র পর্বতে বাস করছেন।

নারদ সৃঞ্জয়কে বললেন, আমার কথা তুমি শুনলে কি? না কি আমার বাক্য নিষ্ফল হোলো? সৃঞ্জয় করজোড়ে বললেন, সূর্যের কিরণে যেমন অন্ধকার দূর হয় সেইরূপ আপনার বর্ণিত কাহিনি শুনে আমার পুত্রশোক দূর হয়েছে। নারদ বললেন, তুমি অভীষ্ট বর চাও, আমাদের কথা মিথ্যা হবে না। সৃঞ্জয় বললেন, আপনি প্রসন্ন হয়েছেন তাতেই আমি হৃষ্ট হয়েছি। নারদ বললেন, তোমার পুত্র দস্যুহস্তে বৃথা নিহত হয়েছে, তাকে কষ্টময় নরক থেকে উদ্ধার করে তোমাকে দান করছি। তখন নারদের বরে সুবর্ণষ্ঠীবী পুনর্জীবিত হোলো।

কাহিনি শেষ কোরে বেদব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বললেন, সৃঞ্জয়ের পুত্র বালক, সে ভয়ার্ত ও যুদ্ধে অক্ষম ছিলো, কৃতকর্মা না হয়ে যজ্ঞ না করে নিঃসন্তান অবস্থায় মরেছিল, এজন্যই সে পুনর্জীবন পেয়েছিল। কিন্তু অভিমন্যু মহাবীর ও কৃতকর্মা, সে বহু হাজার শত্রুকে বিনাশ কোরে সম্মুখ সমরে নিহত হয়ে অক্ষয় স্বর্গলোকে গেছে, সেখান থেকে কেউ মর্ত্যে আসতে চায় না। অতএব অর্জুনের পুত্রকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। সে অমৃতকিরণে উদ্ভাসিত হয়ে চাঁদের মতো বিরাজ করছে, তার জন্য শোক করা উচিত নয়। যুধিষ্ঠির, তুমি ধৈর্য ধারণ করে শত্রু জয় করো। এই বলে বেদব্যাস চলে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)