Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 133

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৩৩

চতুর্দশ দিনে কর্ণের হাতে ভীমের পরাজয় এবং ভূরিশ্রবা বধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

চতুর্দশ দিনে কর্ণের হাতে ভীমের পরাজয় এবং ভূরিশ্রবা বধ

কৃষ্ণ ও অর্জুনকে দেখতে না পেয়ে এবং গাণ্ডীবের শব্দ শুনতে না পেয়ে যুধিষ্ঠির উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি ভীমকে বললেন, অর্জুনের কোনও চিহ্ন আমি দেখতে পাচ্ছি না, কৃষ্ণও পাঞ্চজন্য বাজাচ্ছেন না। নিশ্চয় অর্জুন নিহত হয়েছে এবং কৃষ্ণ স্বয়ং যুদ্ধ করছেন। তুমি সত্বর অর্জুন আর সাত্যকির কাছে যাও। ভীম বললো, কৃষ্ণ ও অর্জুনের কোনও ভয় নেই, তথাপি আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য করে আমি যাচ্ছি। যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করবার ভার ধৃষ্টদ্যুম্নকে দিয়ে ভীম অর্জুনের অভিমুখে যাত্রা করলো, পাঞ্চল ও সোমক সৈন্যগণ তার সঙ্গে গেল।

ভীমের কপালে বাণ দিয়ে আঘাত কোরে দ্রোণ সহাস্যে বললেন, আজ আমি তোমার শত্রু, আমাকে পরাস্ত না কোরে তুমি এই বাহিনী ভেদ করতে পারবে না। ভীম বললো, নীচ ব্রাহ্মণ, আপনার অনুমতি না পেয়েও অর্জুন এই বাহিনী ভেদ করে গেছে। আমি আপনার শত্রু ভীম, অর্জুনের মত দয়ালু নই, আপনাকে সম্মানও করি না। এই বলে ভীম গদাঘাতে দ্রোণের ঘোড়া, সারথি ও রথ বিনষ্ট করলেন। দ্রোণ অন্য রথে উঠে ব্যূহদ্বারে চলে গেলেন। ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে দুর্যোধনের ভ্রাতা বিন্দ, অনুবিন্দ, সুবর্মা ও সুদর্শন নিহত হলেন। কৌরবগণকে পরাস্ত করে ভীম সত্বর অগ্রসর হলেন এবং কিছু দূর গিয়ে অর্জুনকে দেখতে পেয়ে গর্জন করলেন। কৃষ্ণ ও অর্জুনও গর্জন করে উত্তর দিলেন। এই গর্জন শুনে যুধিষ্ঠির আনন্দিত হলেন।

দুর্যোধন দ্রোণের কাছে এসে বললেন, অর্জুন সাত্যকি ও ভীম আপনাকে অতিক্রম করে জয়দ্রথের অভিমুখে গেছে। আমাদের যোদ্ধারা বলছে, ধনুর্বেদের শ্রেষ্ঠ গুরু দ্রোণের এই পরাজয় বিশ্বাস করা যায় না। আমি মন্দভাগ্য, এই যুদ্ধে নিশ্চয় আমার নাশ হবে। আপনার অভিপ্রায় কি বলুন। দ্রোণ বললেন, পাণ্ডবপক্ষের তিন মহারথ আমাদের অতিক্রম কোরে গেছেন, আমাদের সেনা সামনে ও পিছনে আক্রান্ত হয়েছে। এখন জয়দ্রথকে রক্ষা করাই প্রধান কর্তব্য। বৎস, শকুনির বুদ্ধিতে যে পাশা খেলা হয়েছিল তাতে জয়-পরাজয় কিছুই হয়নি, এই রণস্থলেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে। তোমরা জীবনের মমতা ত্যাগ করে জয়দ্রথকে রক্ষা করো। দ্রোণের উপদেশে দুর্যোধন তাঁর অনুচরদের নিয়ে সত্বর প্রস্থান করলেন।

কৃষ্ণ ও অর্জুনের অভিমুখে ভীমকে যেতে দেখে কর্ণ তাকে যুদ্ধে আহ্বান কোরে বললেন, ভীম, তোমার শত্রুরা যা স্বপ্নেও ভাবেনি তুমি সেই কাজ করছ, তুমি পালিয়ে যাচ্ছ। ভীম ফিরে এসে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। কর্ণ মৃদুভাবে এবং ভীম পূর্বের শত্রুতা স্মরণ করে ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের আদেশে তার নয় ভাই দুর্জয়, দুর্মুখ, চিত্ৰ, উপচিত্র, চিত্রাক্ষ, চারুচিত্র, শরাসন, চিত্রায়ু ও চিত্রবর্মা কর্ণকে সাহায্য করতে এলেন, কিন্তু ভীম সকলকেই বধ করলেন। তারপর দুর্যোধনের আরও সাত ভাই যুদ্ধ করতে এলেন এবং তারাও নিহত হলেন। এইভাবে ভীম দুর্যোধনের একত্রিশ জন ভাইকে বধ করলেন।

কর্ণের শরাঘাতে ভীমের ধনু ছিন্ন হোলো এবং রথের অশ্বসকল নিহত হোলো। ভীম রথ থেকে নেমে খড়্গ ও চর্ম নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কর্ণ ভীমের চর্ম ছেদন করলেন, ক্রুদ্ধ ভীম তার খড়্গ নিক্ষেপ করে কর্ণের ধনু ভেঙ্গে ফেললেন। কর্ণ অন্য ধনু নিলেন, নিরস্ত্র ভীম হাতির মৃতদেহ ও ভগ্ন রথের স্তুপের মধ্যে আশ্রয় নিলেন এবং মৃত হাতির দেহ নিক্ষেপ করে যুদ্ধ করতে লাগলেন। কর্ণের শরাঘাতে ভীম মূৰ্ছিতপ্রায় হলেন। কুন্তীর বাক্য স্মরণ করে কর্ণ ভীমকে বধ করলেন না, কেবল ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে স্পর্শ করে বার বার সহাস্যে বললেন, ওরে মূর্খ ভোজনাবিলাসী, তুমি অস্ত্রবিদ্যা জান না, আর যুদ্ধ করো না। যেখানে নানা রকম খাদ্যপানীয় থাকে সেখানেই তোমার স্থান, তুমি রণভূমির অযোগ্য। বৎস ভীম, তুমি বনে গিয়ে মুনি হয়ে ফলমূল খাও, কিংবা ঘরে ফিরে গিয়ে পাচক আর পরিচারকদের পরিচালনা করো। আমার মত লোকের সঙ্গে যুদ্ধ করলে তোমাকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হবে। তুমি কৃষ্ণ ও অর্জুনের কাছে যাও, কিংবা ঘরে ফিরে যাও। বালক, তোমার যুদ্ধের প্রয়োজন কি? ভীম বললো, কেন মিথ্যা গর্ব করছ, আমি তোমাকে বহুবার পরাজিত করেছি। ইন্দ্রেরও জয়-পরাজয় হয়েছিল। নীচকুলজাত কর্ণ, তুমি আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করো, আমি তোমাকে কীচকের মতো বধ করবো।

এই সময়ে অর্জুন কর্ণের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। ভীমকে ত্যাগ করে কর্ণ দুর্যোধনাদির কাছে গেলেন, ভীমও সাত্যকির রথে উঠে অর্জুনের অভিমুখে চললেন। ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে বাধা দিতে এলেন এবং কিছু কাল ঘোর যুদ্ধের পর সাত্যকিকে ভূপাতিত করে তাকে পদাঘাত করলেন এবং মুণ্ডচ্ছেদের উদ্দেশ্যে তাঁর চুল ধরলেন। তখন কৃষ্ণের উপদেশে অর্জুন তীক্ষ্ম বাণে ভূরিশ্রবার ডান হাত কেটে ফেললেন। ভূরিশ্রবা অর্জুনকে বললেন, তুমি অতি নৃশংস কাজ করলে, আমি অন্যের সঙ্গে যুদ্ধে রত ছিলাম, সেই সময়ে আমার হাত কেটে ফেললে। এরূপ অস্ত্রের ব্যবহার কে তোমাকে শিখিয়েছেন, ইন্দ্র, রুদ্র, দ্রোণ না কৃপ? তুমি কৃষ্ণের উপদেশে সাত্যকিকে বাঁচাবার জন্য এরূপ করেছ। বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশের লোকেরা ব্রাত্য, নিন্দনীয় কাজ করাই ওদের স্বভাব, সেই বংশে জাত কৃষ্ণের কথা তুমি শুনলে কেন? এই বলে মহাযশা ভূরিশ্রবা বাঁ হাতে ভূমিতে তীর বিছিয়ে অনশনে বসলেন এবং ব্রহ্মলোকে যাবার ইচ্ছায় যোগস্থ হয়ে ধ্যান করতে লাগলেন। অর্জুন তাকে বললেন, তুমি নিরস্ত্র সাত্যকিকে বধ করতে গিয়েছিলে, নিরস্ত্র বালক অভিমন্যুকে তোমরা হত্যা করেছ, কোন ধার্মিক লোক এমন কাজের প্রশংসা করেন?

ভূরিশ্রবা ভূমিতে মস্তক স্পর্শ করলেন এবং ছিন্ন ডান হাত বাম হাতে ধরে অর্জুনের দিকে নিক্ষেপ করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, আমার ভাইদের উপর যেমন প্রীতি, তোমার উপরেও সেইরূপ প্রীতি আছে। তুমি উশীনরপুত্র শিবি রাজার ন্যায় পুণ্যলোকে যাও। কৃষ্ণ বললেন, ভূরিশ্রবা, তুমি দেবগণের বাঞ্ছিত আমার লোকে যাও, গরুড়ে আরোহণ করে বিচরণ করো। এই সময়ে সাত্যকি চেতনা লাভ কোরে ভূমি থেকে উঠলেন এবং খড়্গ নিয়ে ভূরিশ্রবার শিরচ্ছেদ করতে উদ্যত হলেন। সমস্ত সৈন্য নিন্দা করতে লাগল, কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীম, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, জয়দ্রথ প্রভৃতি উচ্চস্বরে বারণ করতে লাগলেন, তথাপি সাত্যকি যোগমগ্ন ভূরিশ্রবার মাথা কেটে ফেললেন।

সাত্যকি বললেন, ওহে অধার্মিকগণ, তোমরা আমাকে ‘মেরো না, মেরো না’ বলে নিষেধ করছিলে, কিন্তু সুভদ্রার বালক পুত্র যখন নিহত হয় তখন তোমাদের ধর্ম কোথায় ছিল? আমার এই প্রতিজ্ঞা আছে — যে আমাকে যুদ্ধে পদাঘাত করবে সে মুনির ন্যায় তপস্বী হলেও তাকে আমি বধ করবো। আমি ভূরিশ্রবাকে বধ কোরে উচিত কাজ করেছি, অর্জুন এঁর হাত কেটে আমাকে বঞ্চিত করেছেন।

যুদ্ধের বিবরণ শুনতে শুনতে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, বহুযুদ্ধজয়ী সাত্যকিকে ভূরিশ্রবা কি কোরে ভূপাতিত করতে পেরেছিলেন? সঞ্জয় বললেন, যযাতির জ্যেষ্ঠপুত্র যদুর বংশে দেবমীঢ় জন্মগ্রহণ করেন। তার পুত্রের নাম শূর, শূরের পুত্র মহাযশা বসুদেব। যদুর বংশে মহাবীর শিনিও জন্মেছিলেন। দেবকের কন্যা দেবকীর যখন স্বয়ংবর হয় তখন শিনি সেই কন্যাকে বসুদেবের জন্য সবলে হরণ করেন। কুরুবংশীয় সোমদত্ত তা সইলেন না, শিনির সঙ্গে বাহুযুদ্ধ করলে শিনি সোমদত্তকে ভূপাতিত করে পদাঘাত করলেন এবং তরবারি উদ্যত কোরে চুল ধরলেন, কিন্তু শেষে দয়া করে ছেড়ে দিলেন। তার পর সোমদত্ত মহাদেবকে আরাধনায় তুষ্ট কোরে বর চাইলেন - ভগবান, আমাকে এমন পুত্র দিন যে শিনির বংশধরকে ভূমিতে ফেলে পদাঘাত করবে। মহাদেবের বরে সোমদত্ত ভূরিশ্রবাকে পুত্ররূপে পেলেন। এই কারণেই ভূরিশ্রবা শিনির পৌত্র সাত্যকিকে নিগৃহীত করতে পেরেছিলেন।

______________

(ক্রমশ)