Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 135

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৩৫

চতুর্দশ দিনের রাত্রে সোমদত্ত ও বাহ্বীক বধ এবং কৃপ কর্ণ আর অশ্বত্থামার বিবাদ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

চতুর্দশ দিনের রাত্রে সোমদত্ত ও বাহ্বীক বধ এবং কৃপ কর্ণ আর অশ্বত্থামার বিবাদ

চতুর্দশ দিনের সন্ধ্যায় ভয়ঙ্কর রাত্রিযুদ্ধ আরম্ভ হোলো, পাণ্ডব, পাঞ্চাল ও সৃঞ্জয়গণ মিলিত হয়ে দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন।

ভূরিশ্রবার পিতা সোমদত্ত সাত্যকিকে বললেন, তুমি ক্ষত্রধর্ম ত্যাগ করে দস্যুর ধর্ম অবলম্বন করেছিলে কেন? বৃষ্ণিবংশে দুজন মহারথ বলে খ্যাত, প্রদ্যুম্ন ও তুমি। ডান হাত কাটা অবস্থায় অনশনে উপবিষ্ট ভূরিশ্রবাকে তুমি কেন হত্যা করলে? আমি শপথ করছি, অর্জুন যদি রক্ষা না করেন তবে এই রাত্রি সকাল হওয়ার আগে তোমাকে বধ করবো নতুবা ঘোর নরকে যাবো। সাত্যকির সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়ে সোমদত্ত মূৰ্ছিত হলেন, তার সারথি তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

অশ্বত্থামার সঙ্গে ঘটোৎকচের ভীষণ যুদ্ধ হতে লাগল। ঘটোৎকচের পুত্র অঞ্জনপর্বা অশ্বত্থামার হাতে নিহত হলেন। ঘটোৎকচ বললেন, দ্রোণপুত্র, তুমি আজ আমার হাতে রক্ষা পাবে না। অশ্বত্থামা বললেন, বৎস, আমি তোমার পিতার তুল্য, তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। ঘটোৎকচ ক্রুদ্ধ হয়ে মায়াযুদ্ধ করতে লাগলেন। তার অনুচর এক অক্ষৌহিণী রাক্ষসকে অশ্বত্থামা বিনাশ করলেন। সোমদত্ত আবার যুদ্ধ করতে এসে ভীমের পরিঘ ও সাত্যকির বাণের আঘাতে নিহত হলেন। সোমদত্তের পিতা বাহ্লীকরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভীমকে আক্রমণ করলে গদাঘাতে ভীম তাঁকে বধ করলেন।

দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণ আমার যোদ্ধাদের ঘিরে ধরেছে, তুমি ওঁদের রক্ষা করো। কর্ণ বললেন, আমি জীবিত থাকতে তুমি বিষাদগ্রস্ত হয়ো না, সমস্ত পাণ্ডবদের আমি জয় করবো। কৃপাচার্য ঈযৎ হেসে বললেন, ভাল ভাল! কেবল কথাতেই যদি কার্যসিদ্ধি হতো তবে তুমি দুর্যোধনের সেনা রক্ষা করতে পারতে। কর্ণ, তুমি সর্বত্রই পাণ্ডবদের হাতে পরাজিত হয়েছ, এখন বৃথা গর্জন না করে যুদ্ধ করো। কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, বীরগণ বর্ষার মেঘের ন্যায় গর্জন করেন এবং যথাকালে বারিবর্ষণ করেন। তারা যদি যুদ্ধের ভার নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন তাতে আমি দোষ দেখি না। ব্রাহ্মণ, পাণ্ডব ও কৃষ্ণ প্রভৃতিকে মারবার সংকল্প কোরে যদি আমি গর্জন করি তবে আপনার তাতে কি ক্ষতি? আপনি আমার গর্জনের ফল দেখতে পাবেন, আমি শত্রুবধ করে দুর্যোধনকে নিষ্কণ্টক রাজ্য দেবো। কৃপ বললেন, তুমি প্রলাপ বকছো, কৃষ্ণ ও অর্জুন যে পক্ষে আছেন সেই পক্ষে নিশ্চয় জয় হবে। কর্ণ  বললেন, ব্রাহ্মণ, আমার কাছে ইন্দ্রদত্ত অমোঘ শক্তি অস্ত্র আছে, তার দ্বারাই আমি অর্জুনকে বধ করবো। আপনি বৃদ্ধ, যুদ্ধে অক্ষম, পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহপরায়ণ, সেজন্য মোহবশে আমাকে অবজ্ঞা করেন। দুর্মতি ব্রাহ্মণ, যদি পুনর্বার আমাকে অপ্রিয় বাক্য বলেন তবে খড়্গ দিয়ে আপনার জিহ্বা ছেদন করবো। আপনি রণস্থলে কৌরবসেনাকে ভয় দেখিয়ে পাণ্ডবদের প্রশংসা করছেন!

মামা কৃপাচার্যকে কর্ণ ভর্ৎসনা করছেন দেখে অশ্বত্থামা খড়্গ উদ্যত করে বেগে উপস্থিত হলেন। তিনি দুর্যোধনের সামনেই কর্ণকে বললেন, নরাধম, তুমি নিজের বীরত্বের দর্পে অন্য কোনও ধনুর্ধরকে গণনা করো না! অর্জুন যখন তোমাকে পরাস্ত করে জয়দ্রথকে বধ করেছিলেন তখন তোমার বীরত্ব আর অস্ত্র কোথায় ছিলো? আমার মামা অর্জুন সম্বন্ধে যথার্থ বলেছেন তাই তুমি ভৎর্সনা করছো! দুর্মতি, আজ আমি তোমার শিরচ্ছেদ করবো। এই বলে অশ্বত্থামা কর্ণের প্রতি ধাবিত হলেন, তখন দুর্যোধন ও কৃপ তাঁকে নিবারণ করলেন। দুর্যোধন বললেন, অশ্বত্থামা, প্রসন্ন হও, কর্ণকে ক্ষমা করো। কর্ণ, কৃপ, দ্রোণ, শল্য, শকুনি আর তোমার উপর গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার রয়েছে। শান্তস্বভাব কৃপাচার্য বললেন, দুর্মতি কর্ণ, আমরা তোমাকে ক্ষমা করলাম, কিন্তু অর্জুন তোমার দর্প চূর্ণ করবেন।

তার পর কর্ণ ও দুর্যোধন পাণ্ডবযোদ্ধাদের সঙ্গে ঘোর যুদ্ধে রত হলেন। অশ্বত্থামা দুর্যোধনকে বললেন, আমি জীবিত থাকতে তোমার যুদ্ধ করা উচিত নয়। তুমি ব্যস্ত হয়ো না, আমিই অর্জুনকে নিবারণ করবো। দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে বললেন, দ্রোণাচার্য পুত্রের ন্যায় পাণ্ডবদের রক্ষা করেন, তুমিও তাদের উপেক্ষা করে থাকো। অশ্বত্থামা, প্রসন্ন হও, আমার শত্রুদের নাশ করো। অশ্বত্থামা বললেন, তোমার কথা সত্য, পাণ্ডবরা আমার ও আমার পিতার প্রিয়। আমরাও তাদের প্রিয়, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়। আমরা প্রাণের ভয় ত্যাগ কোরে যথাশক্তি যুদ্ধ করি। দুর্যোধনকে আশ্বস্ত করে অশ্বত্থামা রণস্থলে গেলেন এবং বিপক্ষ যোদ্ধাদেরকে নিপীড়িত করতে লাগলেন।

______________

(ক্রমশ)