Love Unlocked :2
Pritha 🎀:
"কিরে তখন থেকে কি ভাবছিস বলতো ?" ক্লাস শেষের পর ক্যান্টিনে এসে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে শেষে আরিয়ার উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই ফেলল দিশা। কিন্তু ওপর পাশে বসা মেয়েটার কানে তার বলা কথাটা ঢুকলো কিনা সেই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে ওর। সে নিজের ভাবনায় ব্যস্ত। কেবল মাঝে মধ্যে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছে তারপর আবার নিজের মতো ভাবছে।
দিশা আবার একটু ঠেলা মেরে জিজ্ঞেস করলো "শুনছিস ! কি এত ভাবছিস তুই ? ক্লাসগুলোও তো ঠিক ভাবে করলি না।"
"ভাবছি টাকাটার কথা বুঝলি !" একই ভাবে গালে হাত রেখে জবাব দিলো আরিয়া।
"কোন টাকা?" কিছুক্ষণ ভাবার পর...."ও আচ্ছা যেটা মিসকাকে দিয়ে দিলি? আমিও বলব ভাবছিলাম ! তুই অতগুলো টাকা কোথায় পেলি ? এই ওতে আদেও দশ হাজার আছে তো ?" বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরিয়ার দিকে আরেকটু ঝুঁকে বলে উঠলো দিশা।
"তোর কি আমায় জোচ্চোর মনে হচ্ছে ? বেশি সন্দেহ থাকলে যা জিজ্ঞেস করে আয় ওই মিসকা না পিসকা কি নাম ওর কাছ থেকে। যা না যা বেশি দরদ তো তোর।" রাগে দাঁতে দাঁত চেপে আরিয়া কথাগুলো বললেও এবার দিশার বসা চেয়ারে ধাক্কা মারতে লাগলো।
"আরেহ আরেহ পড়ে যাব তো। করিস না ! করিস না। শান্ত হ! শান্ত। " কোনোরকমে দিশা বন্ধুকে থামালো।
"দিশা আমায় একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারবি রে ? খুব দরকার আমার। নইলে আমি খুব বিপদে পরে যাবো।" এবার বেশ কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলো আরিয়া।
"চাকরি ? চাকরি নিয়ে তুই কি করবি ?" বেশ অবাক স্বরে বলল দিশা। তার পাশে বসে থাকা বন্ধুটির সঙ্গে ওর খুব স্বল্প দিনের আলাপ। কলেজে ফ্রমফিলাপ করতে এসেই দেখেছিল। আরিয়া সেদিন কোনো অভিভাবক ছাড়া একাই এসেছিল। তাই বেশির ভাগ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। পরে ফ্রমজমা দেওয়ার দিনেও দেখা হয় সেইদিনই প্রথম কথা আর তারপর কন্টাক্ট নম্বর নিয়ে নেওয়া। তারপর এই আজ দেখা হলো কলেজের প্রথম দিন। মাঝে টুকটাক ফোনে কথা। আর তাতেই ওদের সম্পর্কটা তুমি থেকে তুই এ বদলে গেছে। তবে বলতে গেলে দিশা আরিয়ার সম্পর্কে কিছুই জানে না। জিজ্ঞেস করলেও আরিয়া বেশিরভাগ এড়িয়ে যায়।
"একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করিস তো ?!"
"হুম" ছোট করে উত্তর দিলো আরিয়া।
"দেখ আমি কিছু নিয়েই তোকে জাজ করবো না। তুই ফ্রি ভাবে শেয়ার করতে পারিস। আন্টি আংকেল কি তোর কলেজ বা টিউশনের খরচ দিতে পারেননা ? মানে তোকে আমি অনেক ভাবে সেভিংস করতে দেখেছি। তাছাড়া তুই তো প্রচুর টিউশনস ও করাস। এর প্রয়োজন কি ?" বেশ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো দিশা।
"এই প্রশ্নের মুখোমুখি যে হতে হবে জানতাম। সামনাসামনি উত্তরটা দিতে চেয়েছিলাম। দেখ এই কয়েকদিনে তোকে বন্ধু হিসাবে অনেকটাই বিশ্বাস করে ফেলেছি বলতে দ্বিধা নেই। আমার বাবা মা নেই। থাকলে বোধহয় এতটা ভাবতে হতো না। থাকার মধ্যে আছে আমার দাভাই। সেই আমার সব। আর তার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।"(আরিয়া)
"তোর দাদা তাহলে তোর পড়াশোনার খরচ চালায় ?"(দিশা)
"না দাদা প্যারালাইজড পেশেন্ট। দু বছর ধরে হাসপাতালের বেড এ পড়ে আছে।"ছোটর মধ্যেই উত্তর দিলো আরিয়া।
"What ! মানে কি বলছিস কি তুই ? আর এই কলেজ ভর্তির টাকা...তোর আনুষাঙ্গিক খরচ...দাদার হাসপাতালের বিল ! এসব কে দিচ্ছে ? আংকেলের ফিক্সড ডিপোজিট তো সবই ভেঙে ফেলতে হচ্ছে তবে !" (দিশা)
"বাবার কোনো ফিক্সড ডিপোজিট ছিল না। বাবা বিসনেস করত। শুনেছিলাম বাবার খুব বিশ্বস্ত কেউ বাবার কোম্পানি থেকে বাবাকেই সরিয়ে দিয়েছিল। প্রচুর দেনা হয়ে গেছিল। বাবা খুব ভেঙ্গেও পড়েছিল তখন। সেগুলো মেটানোর আগেই ভগবান আমার বাবা মায়ের অস্তিত্ব মিটিয়ে দিলো। আমার কপাল ভালো দাদাভাইকে অন্তত আমার কাছে রেখে দিয়েছে।"(আরিয়া)
"তাহলে তুই এত খরচ চালাস কিভাবে ! আর আংকেলের মৃত্যুই বা হলো কিভাবে ?!"
"সবটা রহস্য! এই রহস্য সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার জন্যই আমার দাভাই এর আজ এই অবস্থা। আমিও চেয়েছিলাম ওর অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করতে। তবে দাভাই সেটা চায়না। যতবারই এগিয়েছি ততবার ওর শরীর খারাপ বেড়ে গেছে কখনও ও ভীষণ প্যানিক করে শরীর খারাপ আরও বাড়িয়েছে। এখন এসব থেকে আমি দূরেই থাকতে চাই। দাভাই ও তাই চায়। এখন খালি ওর সুস্থতা ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই আমার।"
"বুঝলাম ! তারমানে তোর টিউশনের টাকা তেই এত কিছু চালাস ! খুব হার্ড ওয়ার্ক করিস রে ! কিন্তু সবে তো আমরা ফার্স্ট ইয়ার। কোথায় কাজ পাবি ?!"
"না রে আমি এর আগে একটা বেকারীতে পার্ট টাইম জব করতাম। সাথে টিউশন তো ছিল। কদিন আগেই কাজটা চলে গেছে। মালিকের ইচ্ছা দোকানে আরও সময় দিতে হবে। সেটা করতে গেলে আমায় পড়াশোনাটা ছেড়ে দিতে হবে। যেটা সম্ভব নয় রে। কয়েকদিন আগে তাই একটা কফি শপে কাজের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম। ওনারা আজ যেতে বলল। আজকেই প্রথম দিন যাব। কিন্তু এই কাজগুলো পার্মানেন্ট তো হবে না। কোনো কোম্পানিতে যদি কাজ পাই তবে ভালো হয়। জানি গ্র্যাজুয়েশনের আগে জব পাওয়াটা মুসকিল তবে চেষ্টা করে দেখতে তো কোনো ক্ষতি নেই। যতই হোক কাজটা আমার খুব দরকার। এই যেমন আজই বেড়িয়েছিলাম কিছু টাকা নিয়ে।হাসপাতালে জমা দিতে হতো। সব তো সেই চুন্নিটাকে দিয়ে দিতে হলো। কত মাসের টাকা বাকি হাসপাতালে। এবার টাকা না দিলে ওরা হয়তো দাভাই কে আর রাখবে না রে !" শেষের কথাগুলো রাগ আর অসহায়ত্ব মিশিয়ে বলে উঠলো আরিয়া। চোখটাও ছলছল করছে।
দিশা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরলো। "চুপ কর আরু কাদিস না। আমি তোকে হেল্প করব। কত টাকা বাকি বল আমি কালই হাসপাতালে বাপিকে পাঠিয়ে দিতে বলব। জাস্ট টেল মি ! টেনশন করিস না তুই।"
"না রে দিশা আমি হাত পেতে টাকা নিতে পারবো না। আমার কাছে আত্মসম্মানটা আগে। তুই যে বলেছিস এই অনেক ! আজ আসি রে অনেক দেরি হয়ে গেল। আবার কফিশপে যেতে হবে। প্রথম দিনেই দেরি করলে হবে না।"
"কিসে যাবি ? আমি গাড়ি করে ছেড়ে দিই?"
"না না লাগবে না। ও আমি ঠিক চলে যাবো।" কথাটা বলে ব্যাগটা টেবিল থেকে তুলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো আরিয়া।
"আরে আসতে যা ! উফ এত ছটফট করে।" ___________________________________________
পরেরদিন সকালে,
অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে হাই তুলতে তুলতে সাদা নরম বিছানা থেকে উঠে বসলো বছর ছাব্বিশের ছেলেটি।জানলার পর্দা গুলো ভেদ করে মিঠে রোদটা মেদবিহীন সুঠাম জিম করা শক্ত পুরুষালী শরীরের উপর পড়ছে। তার ফর্সা ত্বক টাকে যেন আরো উজ্জ্বল করে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকার পর অ্যালার্মটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। পাশে থাকা টি শার্টটা তুলে পড়তে পড়তে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে বেডসাইট টেবিলের দিকে একবার তাকিয়ে চুপচাপ ঢুকে পড়ল ঘরের সঙ্গে এটাচড আরেকটা রুমে। এখানে জিমের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ভর্তি। রুমে ঢুকেই শুরু করে দিলো তার প্রতিদিনের শরীরচর্চা। রোজকার কাজের মধ্যেই তার এই দু ঘণ্টার শরীরচর্চাও পরে। বড় বড় ডাম্বেল গুলোকে খুব সহজেই তুলে ফেলছে এবং হাতটাকে ওঠা নামা করাচ্ছে। এতে ফুলে উঠছে তার হাতের উপরে অংশ।
হঠাৎ দরজায় নক করার শব্দ হওয়ায় ডাম্বেলটা হাত থেকে নামিয়ে ঘুরে তাকালো দরজার দিকে। দরজায় দাঁড়ানো ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো "আবির তোমার চাকরিটা বোধহয় আর প্রয়োজন নেই না ?ভাবছি আমার জন্য নতুন একটা পি.এ হায়ার করতে হবে।"
"সরি স্যার। আর হবে না। আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। আসলে শীতকাল তো তাই এত সকালে....পরের দিন থেকে আপনার ঘুম থেকে ওঠার আগেই বেডসাইড টেবিলে লেবুজল পেয়ে যাবেন।"
আবিরের কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ছেলেটি বলে উঠলো "তাহলে পুরো বছরটাই ঘরে শুয়ে থাকো। তার ব্যবস্থা করে দেয় ! নাকি ?"
"না স্যার এমন করবেন না। এক্সট্রিমলি সরি আর হবে না।" কথাটা বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আবির।
"ঠিক আছে। Any news ?"
"স্যার লাস্ট ডিলটা ক্র্যাক করার পর আমাদের কোম্পানি প্রচুর ডিল পাচ্ছে। এই পত্রিকায় আপনার ছবিও বেরিয়েছে। নিচে বড় বড় করে আপনার নাম লেখা বিসনেস টাইক্যুন দেবর্ষি সিংহ রায়। দেখুন দেখুন ! আপনার সোশ্যাল মিডিয়ার প্রোফাইলেও প্রচুর মেয়েদের রিকোয়েস্টের ছড়াছড়ি। প্রত্যেকের ক্রাশ আইকন ...." বেশ উত্তেজিত হয়ে আবির কথাগুলো একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল তবে দেবর্ষির মুখের অভিব্যক্তি দেখে থেমে যেতে হলো। মাথা নিচু করে বলে উঠলো "সরি স্যার"।
"তুমি খুব ভালো করে জানো এসব নিয়ে মাতামাতি আমি পছন্দ করিনা। তোমায় এসব আপডেটের জন্য পিএ হিসাবে রেখেছি ? আজকে সিডিউল বলো।" দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে তাকিয়ে বলল দেবর্ষি।
"স্যার আর দু ঘণ্টা পর সাড়ে সাতটায় একটা মিটিং আছে। আর সন্ধ্যে ছ টা নাগাদ আরেকটা মিটিং আছে সেন সাইন কোম্পানির সঙ্গে। ওনারা জানিয়েছেন কোথায় মিটিং হবে লোকেশনটা আজ মেইল করে দেবেন।" ঝার খেয়ে নিজের উত্তেজনা কমিয়ে মিনমিন করে বলে ফেলল আবির।
"গুড! সকালের মিটিংটা অ্যারেঞ্জ করো। আর সকাল দশটার মধ্যে যদি সেন সাইন কোম্পানি অ্যাড্রেসটা মেইল না করেন তাহলে মিটিং ক্যান্সেল করবে। You know যে আমার জন্য টাইমটা কতটা ম্যাটার করে ! Now go!" কথাটা শেষ করে দেবর্ষি আবার এক্সারসাইজ এর জন্য যন্ত্রপাতি গুলোর দিকে এগিয়ে যায়।
"ইয়েস স্যার। আমি দেখে নিচ্ছি।" আজ্ঞা পালন করতে তড়িঘড়ি করে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় আবির।
.
.
.
.
চলবে......