Love Unlocked :6
Pritha 🎀:
মোটামুটি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে মেঘার সাথে একবার দেখা করে নিয়ে আরিয়া বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। সোনালী অবশ্য তার নতুন বন্ধুর সাথেই ফিরতে চেয়েছিল কিন্তু আরিয়া মুখের উপর না বলে দেওয়াতে এর পরে আর কিছু বলতে পারেনি। নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে ক্যাফের থেকে বেরিয়ে এলো ও। এখান থেকে পায়ে হেঁটে দশ মিনিট গেলেই ওর কলেজটা। এতে অবশ্য ওর সুবিধাই হয়েছে কলেজ আর কাজের জায়গা কাছাকাছি হলে ডাইরেক্ট কলেজ থেকে কাজে চলে আসবে। বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। মেঘাকে যা দেখলো ওই এখানকার হর্তাকর্তা বিধাতা। মেয়েটা একটু গায়ে পড়া হলেও কাজ নিয়ে ঢিলেমি একদম পছন্দ করেনা। হয়তো এই কারণেই এখনো টিকে যেতে পেরেছে। অবশ্য ও নিজেও কাজের প্রতি যথেষ্ট সিরিয়াস, কাল থেকে মন দিয়ে কাজ করবে। এইসবই ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল আরিয়া। ইতিমধ্যেই বাসস্ট্যান্ড এর কাছে এসে পৌঁছেছে। এখান থেকে বাস ধরলে মিনিটখানেক লাগে বাড়ি পৌঁছাতে। বাসস্ট্যান্ডে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না ওকে। একটু পরেই বাস এসে থামতে উঠে পড়ল। জানলার পাশের সিটটা খালি দেখে ওতেই বসলো। ওর খুব ভালো লাগে জানলার পাশে বসতে। তার উপর এই ভেপসা গরমে জানলার বাইরের ফুরফুরে হাওয়াটা সারাদিনের ক্লান্তি দুর করে দেয়।ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে স্ক্রিন অন করতেই ভেসে উঠলো একটা বাচ্চা ছেলে আর মেয়ের ছবি। এটা ওর দাদা আর ও। ছবিটা ছোটবেলার।আজ দাদার সাথে দেখা হয়নি ভেবে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো পৃথিবীর নিয়ম গুলো ও বানালে এখন নিশ্চয়ই ও হাসপাতালে গিয়ে দাদার মুখটা দেখে একটু শান্তি কুড়িয়ে আনতে পারত। কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর একটা গান চালিয়ে হেডফোন কানে গুঁজে মাথাটা জানলার রডে হেলান দিয়ে নিলো। চুলটাও খুলে দিলো। ফুরফুরে হাওয়া আর চুলের খেলার মাঝে ওর ক্লান্ত দুই চোখে ঘুমপরীরা ভর করলো।
.
"দিদি ভাড়াটা ?!" ঘুম ভাঙ্গলো কন্ডাক্টরের ডাকে।চমকে উঠে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে অবস্থানটা বুঝতে একটু বেগ পেতে হলো।
"সরি ভাই চোখ লেগে এসেছিল একটু দাঁড়াও দিচ্ছি।" বলে ঝটপট ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে লাগলো। পয়সার ব্যাগটার জীর্ণ অবস্থা সামনের মাসে স্যালারি পেলে একটা ব্যাগ কিনবে নাহয়। এসব ভাবতে ভাবতে টাকা বার করে ছেলেটিকে দিয়ে দিলো। এরপর ওর স্টপেজ আসতে নেমে পড়লো। বাড়িটা বাস্ট্যান্ডের কাছেই। পায়ে হেঁটে দশ মিনিট। অবশ্য কেউ কেউ এর জন্যও গাড়ি হাকায়। তবে ওর জন্য এই সব বিলাসিতা। গান শুনতে শুনতে দশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করে পৌঁছালো বাড়ির সামনে। বাড়িটা দু-তলা। বাড়ির মালিক থাকে উপরের তলায়। নিচের তলাটা ভাড়া নিয়ে আরিয়া থাকে,একাই।
নিজের কাছে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে উঠানে প্রবেশ করতেই কানে এলো কারোর বাজখাঁই স্বর "ওই এসেছে, এত সন্ধ্যে বেলা ! দেখো গিয়ে কোথায় ফষ্টি নষ্টি করেছে। হ্যাঁ গো তোমায় এতোবার বললাম এভাবে এমন একলা একটা মেয়েকে ভাড়া দিও না, তুমি শুনলে তো ! কি বলে ঢুকেছিল ওই মেয়ে হ্যাঁ?! কাকিমা সন্ধ্যার আগে ফিরে যাবো। এই হয়েছে সময় তার। জানি জানি সব জানা আছে এখনকার সব কুকীর্তি।"
আরিয়া জানে এই কন্ঠটা কার ! এই বাড়ির মালকিন মিসেস ছবি সেন। স্বামী অলোক সেনের নিরীহতার সুযোগ নিয়ে এই বাড়িতে বেশ জাঁকিয়ে রাজত্ব করেন তিনি। হ্যাঁ রাজত্বই বটে। ঠিক যেমন একটু আগে দোতলা থেকে যা নয় তাই বলে গেলো আরিয়াকে। তার গলার স্বরে আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকজনের কৌতুহলী দৃষ্টিও পড়েছে তার উপর। তবে তাতে তার কোনো হেলদোল নেই। সে তার বাজখাঁই স্বরে স্বামীর প্রতি অভিযোগ জারি রেখেছে যে কেন সে অবিবাহিত আরিয়াকে এখানে ঠাঁই দিয়েছে, তার মতে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের বাড়িতে জায়গা দিলে তারা বাইরে গিয়ে আকাম কুকাম করে আসবে যার দায়ভার নিতে হবে তাদেরকে। তার স্বামী অলোকবাবু এব্যাপারে নির্বিকার। তিনি তার পরলোকে গমন করা বন্ধুর মেয়েকে ঠাঁই দিয়েছেন ঠিকই তবে বউয়ের বিরোধিতা করে অনাথ মেয়েটার পাশে দাঁড়াতে সাহস পাননা। যদিও এব্যাপারে আরিয়া কোনো অভিযোগ করে না। তাকে যে থাকতে দিয়েছে এতেই সে বারবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
আরিয়া আর কোনো কথা বাড়ালো না। চাইলে স্বভাববশত দুচারটে কথা শুনিয়ে দিতেই পারতো। তবে চাইলো না। এখনকার সময়ে একা একটা মেয়ে টিকে থাকা কি পরিমাণ যুদ্ধের সেটা এখন বোঝে ! এর থেকে তো অনাথ আশ্রমেও পিতৃমাতৃহীন বাচ্চাগুলো সুরক্ষিত থাকে ! ওর মতো অভাগা আর কজন ! সব থেকেও হারালো।
তাছাড়া এমন কম দামে এক কামরার সুরক্ষিত একটা ঘর পেয়েছে সেই ঢের! কোনমতেই ও এই জায়গাটা হারাতে চায়না! তাই সবাইকে মুখের উপর জবাব দিলেও এখানে চুপই থাকে !
তাই আজও উঠান পেরিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। ঘরটা একটু অগোছালো ! বাড়িতে থাকার সময় কই ! টিউশন,কলেজ তার উপর এখন উপরিভাবে ক্যাফ টাও যোগ হয়েছে। বাড়ি ফেরা কেবল ঘুমানোর উদ্দেশ্যে আর দিন শেষে দুটো চাল ফুটিয়ে খাওয়ার জন্য। নিচের তলায় একটাই ঘর। একটা রান্নাঘর। আর একটা বাথরুম রয়েছে।এই নিয়েই ওর একার সংসার। লাইটটা জ্বালিয়ে ব্যাগটা বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে বাথরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। একটু পরে জামা বদল করে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ভাত বসিয়ে ভাবলো ঘরটা একটু পরিষ্কার করা দরকার। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঘরে চলে এলো। কিন্তু ঘরের যা অবস্থা তা দেখে কপালে একটা ভাঁজ পড়ল। কান্নাও পেলো খানিক ! ঘর গোছাতে ও একদমই পারে না। মাঝে মধ্যে ছবি কাকিমা উপর তলা থেকে নেমে ওর ঘরের সামনে এলেই নাক সিটকায়, বলে "ইশ কি নোংরা করে রেখেছে দেখো, ব্যবহারে কোনো সুশ্রী নেই গো !" উনি খুব পিটপিটা। নিজের ঘরদোর সব সময় পরিষ্কার করে রাখেন। ও নাহয় পারে না, তাই বলে এরকম বলবে ? ওর বুঝি মানে লাগে না !
নাহ আজ যাই হয়ে যাক ঘর ও গোছাবেই। বিছানার উপর ছড়িয়ে থাকা সব জামা দলা পাকিয়ে একজায়গায় করে ফেলল। ঘরটা মোটামুটি রকম ঝাড় দিয়ে নিলো।তারপর কপালে আবার ভাঁজ পড়ল। জামা তো ভাঁজ করতে পারে না। কিন্তু তাই বলে ওর ঘর গোছানোর অভিযান মোটেও থেমে থাকবে না। সমস্ত জামা নিয়ে দলা পাকিয়ে আরও ছোট করে চেয়ারে ঠুসে রেখে দিলো। বিছানাটা তো পরিষ্কার করতে পেরেছে ! মুখে খেলে গেলো বিশ্বজয়ের হাসি। তারপর হাত ঝেড়ে ঘরটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলো ! ভাবটা ঠিক এমন কে বলেছে আমি ঘরগোছাতে পারিনা হুহ !
___________________________________________
গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আবির বলে উঠলো "স্যার আজ কি ফ্ল্যাটে যাবেন নাকি বাড়িতে ?"
"হঠাৎ বাড়িতে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠছে কেন?" (দেবর্ষি)
"ম্যাম ফোন করেছিলেন। জানিয়েছেন আপনাকে নিয়ে বাড়ি আসতে দরকারী কথা আছে!"
"আমি থাকতে মম তোমায় কেন ফোন করে ! তাছাড়া নিয়ে আসবে মানে ? আমি কি বাচ্চা নাকি।"
"হ্যাঁ তো"
"কি বললে?"
"ইয়ে মানে না না আমি বলতে চাইলাম যে ম্যাম যে আমায় কেন ফোনে করেন ! ওটাই আর কি হে হে !" মাথা চুলকে হেসে পরিস্থিতিটা সামলানোর চেষ্টা করলো আবির।
"হেসো না তো বোকার মতো! Silly things"
"আমার হাসি আপনারা কেউ সহ্য করতে পারেননা কেন বলুন তো ! বিকেলেও একটু হাসছিলাম বলে কত মুখ শুনিয়ে দিলো। শান্তি নেই একটুও।" আবির বিরক্ত হয়ে ভয়ডর ভুলে বলে ফেলল।
দেবর্ষি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো "আপনারা মানে ?! আর কে সহ্য করতে পারেনি !"
"কে আবার ! আরিয়া নামের ওই মেয়েটা।"
দেবর্ষি ভ্রু কুঁচকে বলল "কে আরিয়া ?" কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করে "ও ক্যাফের ওই বাচাল মেয়েটা। ওর সাথে তুমি আমায় তুলনা করছো হ্যাঁ? তোমার সাহস তো কম নয়। আমি দেবর্ষি সিংহ রায় আর তুমি...."কথাটা শেষ করার আগেই দেবর্ষির ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখলো স্ক্রিনে লেখা "দাদান"
সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করে বলল "হ্যাঁ দাদান বলো !"
এদিকে আবির বুকে ফুঁ দিয়ে হাফ ছাড়ল। বিড়বিড় করে বলল "থ্যাংকস দাদান ভালো সময় ফোন করেছো। বেঁচে গেছি!"
"তুমি এখনো খাওনি কেন !আমি কতবার বলব এমন অনিয়ম করবে না তুমি।"(দেবর্ষি)
.....
"আমি কাজে ব্যস্ত থাকি। সবসময় এমন জেদ করলে চলে !"
.....
"উফ সেটা না! আচ্ছা ঠিক আছে আমি আসছি।" বলে কলটা কেটে দিলো দেবর্ষি।
বিরক্তি মুখে আবিরের উদ্দেশ্যে বলল "আবির গাড়ি ঘোরাও,বাড়ি চলো।"
আবির মিরর গ্লাসে দেবর্ষির বিরক্তি ভরা মুখটা দেখে মুচকি মুচকি একটু হেসে নিল।মনে মনে বলল "আব আয়েগা উট পাহাড় কে নিচে। সারাদিন আমায় খুব জ্বালাও বাছাধন এইবার তোমার দম দেখব।"
এদিকে আবিরকে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে দেবর্ষি ধমকে বলল "আবার হাসছো ,বারণ করলাম তো !"
.
.
.
.
চলবে....