পর্ব - 4
********
Invitation
***********
গাড়ির ভগ্নস্তূপটা পড়ে আছে রাস্তায়। জি টি রোডের এক ধার দিয়ে যাওয়া আসা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। রাস্তার এক ধার দিয়েই এখন গাড়ির যাওয়া আসা হচ্ছে। সপ্তর্ষিরা যখন পৌঁছলো তখন প্রায় রাত দুটো। গাড়ির এহেন অবস্থা দেখে নীহারিকাকে সামলানো খুবই কঠিন হয়ে উঠছিল। সপ্তর্ষি, অম্লান ও অরিজিৎ মিলেও তাকে সামলাতে পারছিল না। ইন্সপেক্টর তাদের দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন - 'আপনাদের মধ্যে সপ্তর্ষি কে?'
'আমি, আমি সপ্তর্ষি মন্ডল।' সপ্তর্ষি এগিয়ে গিয়ে বললো।
ইন্সপেক্টর ভালো করে সপ্তর্ষিকে দেখে বললেন - 'আপনি আ্যসট্রনট না? দু দিন আগেই টি ভি তে দেখলাম মনে হলো।'
'হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন আপনি। যার একসিডেন্ট হয়েছে সেও আ্যসট্রনট ছিল।'
'ওহ, সো স্যাড। দেখুন মিস্টার সপ্তর্ষি, আপনাদের দুটো জায়গায় যেতে হবে। প্রথম থানায়। কিছু ফরম্যালিটি আছে, সেগুলো পুরো করতে হবে। আর আপনাদের সেকেন্ড কাজ হলো বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ যাওয়া। বডি গুলো ওখানেই আছে। কাল সকালে পোস্টমর্টেম হবে। তার আগে আপনাকে বডি গুলো আইডেন্টিফাই করতে হবে। আচ্ছা, যিনি মারা গেছেন, তার বাড়ির লোক কেউ নেই?'
এবার নীহারিকা এগিয়ে এলো। বললো - 'বাড়ির লোকেরাই ছিল গাড়িতে। অর্ণব, তার মা, বাবা, বোন।'
'বাঁকি আত্মীয়? মানে দাহ কে করবে?'
'সেটা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না ইন্সপেক্টর। এটা বলুন যে আমরা বডি গুলো কবে পাবো?' সপ্তর্ষি বললো।
'সেটা তো হসপিটাল ভালো বলতে পারবে। তবে কম করেও দু দিন তো সময় লাগবেই।'
কথা শেষ করে ইন্সপেক্টর এগিয়ে গেলেন নিজের গাড়ির দিকে।
এতক্ষণে ক্রেন চলে এসেছে, গাড়ির ভগ্নস্তূপ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষ বারের মত গুঁড়িয়ে শেষ হয়ে যাওয়া গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সপ্তর্ষিরা। বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে তাদের।
হঠাৎ অম্লান বলে উঠলো - 'কিছুই ঠিক হচ্ছে না রে। যবে থেকে ওই ঘটনাটা ঘটেছে আমাদের সাথে, তবে থেকে কিছুই ঠিক হয়নি। এমন কি এক রাতও আমরা ঠিক মত ঘুমোতে পারিনি। যখন-তখন ওসব ভয়ানক দৃশ্য গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কী দিন, কী রাত, কোনো ঠিক নেই। তারপর অর্ণবের সাথে এতবড় একটা দুর্ঘটনা। জানি না এর শেষ কোথায় হবে। আর কী-কী দেখতে হবে আমাদের, সেটা ভগবান জানেন।'
কথা শেষ করে অম্লান গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
******************************************
বাগডোগরা এয়ারপোর্টে যখন প্লেনটা ল্যান্ড করলো তখন সকাল দশটা বাজে। দার্জিলিংএর এক হোটেলে কামরা বুক করে রেখেছিলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। তিনি জানেন না কত দিন সময় লাগবে এখানে। সকালে কলকাতা থেকে রওনা দেওয়ার সময়ই সপ্তর্ষি তাকে ফোন করে অর্ণবের দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে দিয়েছিল। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রওনা দিলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। ঘটনাস্থলে যাওয়া কিম্বা এই কঠিন সময়ে সপ্তর্ষিদের পাশে দাঁড়াবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। যে কাজে তিনি যাচ্ছেন, সেটাও আবশ্যক। জনগণের কল্যাণের জন্য, হয়তো পৃথিবীর কল্যাণের জন্যও। দার্জিলিংএ হোটেলে পৌঁছতে দুপুর পেরিয়ে গেল প্রায়। রাস্তাতেই এক ছোট হোটেলে লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিককে যেতে হবে লামাহাটা। দার্জিলিং থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটারের দূরত্বে পাহাড়ে ঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম। পাহাড়ি রাস্তা, বেশি দেরি করে লাভ নেই। লামাহাটা থেকে ফিরেও আসতে হবে তাকে দার্জিলিংএ। হোটেল ম্যানেজারকে গাড়ির কথা আগে থেকেই বলা ছিল। হোটেলের রুমে পৌঁছে নিজের ব্যাগটা রেখে সোফায় একটু গা এলিয়ে দিলেন তিনি। কিছুক্ষণ পরেই কলিং বেলের আওয়াজ শুনতে পেলেন মৃত্যুঞ্জয়। দরজা খুলতেই সামনে দেখলেন হোটেলের এক বয় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
'স্যার, আপনার গাড়ি রেডি।' হোটেলের বয় বললো মৃত্যুঞ্জয়কে।
'ঠিক আছে, আমি আসছি।'
বয় চলে যাওয়ায় পর নিজের কোর্টের পকেটে একবার হাত দিলেন মৃত্যুঞ্জয়। বেরিয়ে এলো একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো। তাতে লেখা আছে একটা ঠিকানা, দেবব্রত চৌধুরীর ঠিকানা।
গাড়ির ড্রাইভারকে কাগজের টুকরোটা দেখিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞাসা করলেন - 'ঠিকানাটা চেনো?'
কাগজে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গাড়ি চালাতে-চালাতে ড্রাইভার বললো - 'হ্যাঁ স্যার। লামাহাটা ইকো পার্কের কাছেই।'
লামাহাটা পৌঁছতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল। পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গাড়িটা এগিয়ে চলেছে। লামাহাটা ইকো পার্ক পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে ডান দিকে ঘুরে গেল তাদের গাড়ি। প্রায় দু কিলোমিটারের মত এগিয়ে এক জায়গায় গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। ডান দিকে বড় খোলা মাঠ দেখতে পেলেন মৃত্যুঞ্জয়। মাঠের মধ্যে একতলা এক কাঠের ছোট্ট বাড়ি। মৃত্যুঞ্জয় গাড়ি থেকে নামলেন। এগিয়ে গেলেন সেই বাড়ির দিকে। এই বাড়িটাই কি? দেবরাজ বর্মন যে ঠিকানাটা তাকে দিয়েছেন, সেটা অনুযায়ী বাড়ি তো এটাই হওয়া উচিত। দেবরাজ বর্মন যেমন বর্ণনা দিয়েছিলেন বাড়িটা অনেকটা তেমন। ছয় ধাপ কাঠের সিঁড়ি উঠে সদর দরজার সামনে পৌঁছলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। সদর দরজার সামনে একটা ছোট বাল্ব জ্বলছে। দরজায় টোকা মারলেন তিনি। কোনো সাড়া শব্দ নেই। আবার টোকা মারলেন মৃত্যুঞ্জয়।
'কাউন হে?' বাড়ির ভিতর থেকে আওয়াজ এলো। গলা শুনে মনে হলো এই এলাকারই কেউ। খুব বেশি বয়স বলে মনে হলো না মৃত্যুঞ্জয়ের। কোনো জবাব না দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ে আরেকবার টোকা মারলেন। দরজা খুললো। মৃত্যুঞ্জয় দেখলেন তার সামনে উনিশ-কুড়ি বছরের এই এলাকারই এক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
'মুঝে দেবব্রত সাহেব সে মিলনা হে।' মৃত্যুঞ্জয় বললেন ছেলেটাকে।
বাড়ির ভিতরে থেকে এক ভারী কন্ঠ শুনতে পেলেন মৃত্যুঞ্জয়।
'কে রে বাহাদুর?'
খানিক পরেই মৃত্যুঞ্জয় দেখতে পেলেন তার চেহারা। মাঝ বয়সী লম্বাটে গড়নের একজন লোক। মাথায় বড়বড় সাদা চুল। প্রায় বুক পর্যন্ত লম্বা সাদা দাড়ি। গায়ে ওভারকোর্ট। লোকটার যত না বয়স, তার থেকে বেশি বলে মনে হচ্ছে। লোকটা এগিয়ে এলেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। ভালো করে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন - 'ওয়েলকাম মিস্টার মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক, ওয়েলকাম।'
******************************************
অর্ণবের খবর জেনে গেছে পুরো অফিস। নিঃসন্দেহে আজ শোকের দিন। দেবরাজ বর্মন আজ ক্লাস নিলেন না। ছাত্ররা যে যার বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল। গেল না শুধু তনুশ্রী। পড়াশোনায় তার ঝোঁক হয়তো অন্যের থেকে বেশি। লাইব্রেরিতে যাবে ভাবলো সে। ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালো। হঠাৎ একটু দূরে সে দেখতে পেলো নীহারিকাকে। কারোর সাথে কথা বলছে নীহারিকা। নিজের বহুদিনের ইচ্ছেকে চরিতার্থ করার সময় হয়তো এটাই। সেই রাতে হোটেলের পার্টির সময় নীহারিকাকে বেশ কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিল তনুশ্রী। কথা বলার প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্বেও কথা বলা হয়নি নীহারিকার সাথে তার। আজ আবার এতো কাছ থেকে দেখতে পেল নীহারিকাকে। নীহারিকার সাথে পরিচয় করার নিজের ইচ্ছেটাকে আর চেপে রাখতে পারলো না তনুশ্রী। তার পা দুটো তার অজান্তেই এগিয়ে গেল নীহারিকার দিকে। একটু এগোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। এখন কি পরিচয় করার সঠিক সময়? তনুশ্রীর মনে প্রশ্নটা নাড়া দিলো। তনুশ্রী জানে, নীহারিকার মন-মেজাজ ভালো নেই। সে জানে নীহারিকা রাতে ঘটনাস্থলেই ছিল। কিন্তু আজকের এই মুহূর্তটা যদি হাত থেকে চলে যায়, তাহলে আবার এই মুহূর্ত কবে ফিরে আসবে, সেটা জানে না তনুশ্রী। আগামী তিন বছরে এমন মুহূর্ত আদৌ আসবে কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। আবার ধীর গতিতে তনুশ্রীর পা দুটো এগিয়ে গেল নীহারিকার দিকে। নীহারিকা কারোর সাথে কথা বলছিল। তার কথা শেষ হয়ে গেছে। সেখান থেকে এগিয়ে গেছে নীহারিকা। তনুশ্রী নিজের পায়ের গতি বাড়ালো।
'এক্সকিউজ মি ম্যাম।'
তনুশ্রীর গলার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো নীহারিকা। পিছন দিকে ফিরে তাকালো সে।
'ইয়েস!'
তনুশ্রী আরো এগিয়ে এলো নীহারিকার দিকে। সে দেখতে পেল নীহারিকার চোখ দুটো ফোলা এবং লাল। মনের বেদনা যে চোখের রাস্তায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
'সরি ম্যাম। আজকের দিনটা হয়তো ঠিক নয় আপনার সাথে আলাপ করার জন্য। আসলে অনেক দিন ধরেই আপনার সাথে পরিচয় করতে চাইছি। আপনার বিষয় অনেক স্টাডি করেছি ম্যাম। বলতে গেলে আপনাকে অনুসরণ করেই আমি ইসরোতে এসেছি। তাও সরি বলবো। এটা হয়তো ঠিক সময় না।'
একটু হেসে নীহারিকা বললো - 'ইট্স ওকে।'
'ম্যাম, আমার নাম তনুশ্রী মজুমদার। ফার্স্ট ইয়ার।' হাত বাড়ালো তনুশ্রী। নীহারিকাও নিজের হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলো।
'তনুশ্রী মজুমদার? নামটা শুনেছি মনে হচ্ছে। ও হ্যাঁ মনে পড়লো। এবারের এনট্রেন্স এক্সামে তুমি নাকি টপ করেছো। কংগ্রাচুলেশন।' নীহারিকা বললো।
'থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম।'
দুজনেই এবার হাঁটা শুরু করলো।
'আসলে বলতে পারেন ম্যাম, আমার ভাগ্যটা খুব ভালো ছিল।' তনুশ্রী বললো।
'কেন?'
'আসলে এক্সামের প্রিপারেশনের সময় আমি ডি-কর্ডিং টা খুব ভালো করে পড়েছিলাম। এক্সামে বেশিরভাগ কোয়েশ্চেন এলোও সেখান থেকে।'
ডি-কর্ডিংএর নাম শুনে মুখটা আবার যেন শুকিয়ে গেল নীহারিকার।
ভারী কণ্ঠে বললো - 'ডি-কর্ডিং! এই ডি-কর্ডিং টা অর্ণবও খুব ভালো করতে পারতো। আমাদের লাস্ট মিশনে ডি-কর্ডিংএর দরকার পড়েছিল। সেটা অর্ণব নিজেই করেছিল।'
তনুশ্রী লক্ষ্য করলো কথাটা বলতে গিয়ে নীহারিকার দু চোখ ছলছল করে উঠলো।
মনে-মনে নিজের ভাগ্যের উপর রাগ হলো তনুশ্রীর। আজ যদি অর্ণব জীবিত থাকতো তাহলে তার থেকে ডি-কর্ডিং এর বিষয় আরো বিশদে জ্ঞান পেতে পারতো। তাও, এখানে অনেকেই এমন আছেন, যারা ডি-কর্ডিংএর বিষয় ভালোই জ্ঞান রাখেন।
নীহারিকার মনটা ভালো করার জন্য তনুশ্রী বললো - 'আপনি তো বেশ কিছু ম্যান মিশন করেছেন ম্যাম। ম্যাম, জানি না সম্ভব হবে কি না, তবে আমি চাই এই তিন বছরের ট্রেনিংএ আপনার থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি।'
'আমার নিজেরই এখন শেখা শেষ হয়নি তনুশ্রী। আরো কত কিছু যে শেখার আছে। প্রত্যেক মিশনে নতুন-নতুন এক্সপেরিয়েন্স হয়। কত কিছু শেখা যায় প্রত্যেক মিশন থেকে। চাঁদে যাওয়া একটা আলাদা অনুভূতি, আলাদা এক্সপেরিয়েন্স। মঙ্গলে যাওয়া এক আলাদা অনুভূতি, আলাদা এক্সপেরিয়েন্স। আবার টাইটানে গিয়ে আলাদা এক্সপেরিয়েন্স হলো। তাই শেখার শেষ নেই তনুশ্রী। তোমায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিখে যেতে হবে।'
হঠাৎ নীহারিকার মোবাইলে রিং হলো। সপ্তর্ষি কল করেছে।
'নীহারিকা, যত তাড়াতাড়ি পারিস লঞ্চ প্যাডে আয়। দরকারি কথা আছে।'
'এক্ষুনি?'
'হ্যাঁ এক্ষুনি।'
******************************************
লঞ্চ প্যাড মেন বিল্ডিং থেকে কিছুটা দূরে। অফিসের গাড়ি করে যেতে হয়। পাঁচ থেকে সাত মিনিট লাগে যেতে। বিশাল লঞ্চ প্যাডের এক কোণায় একটা বড় শেডের নিচে কিছু ইঞ্জিনিয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেখানেই দাঁড়িয়েছিল সপ্তর্ষি। দূর থেকে নীহারিকাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে এগিয়ে গেল সেই দিকে।
'কী হলো? কী এমন আর্জেন্ট কথা আছে?' সপ্তর্ষির কাছে আসতে-আসতে নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
সপ্তর্ষি নীহারিকার হাত ধরে তাকে লঞ্চ প্যাডের অন্য এক কোণায় নিয়ে গেল।
'নীহারিকা, তুই জানিস চিফ কোথায় গেছেন?' জিজ্ঞাসা করলো সপ্তর্ষি।
'না, জানি না।' নীহারিকা জবাব দিলো।
'আমি জানি।'
'জানিস? কোথায় গেছেন চিফ?'
'চিফ গেছেন দেবব্রত চৌধুরীকে খুঁজে বের করতে। দেবব্রত চৌধুরীকে খুঁজতে তিনি কোথায় গেছেন, সেটা বলতে পারবো না।'
'কিন্তু তুই এটা জানলি কী করে? চিফ তো কাউকে কিছু বলে যাননি।' নীহারিকার কৌতূহল বাড়লো।
নিজের আশেপাশে ভালো করে দেখে নিয়ে সপ্তর্ষি বললো - 'দেবরাজ বর্মন কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। তাতেই বুঝতে পারলাম। মিশন ইন্ডিয়ানা'র বিষয় দেবরাজ বর্মন খুব ভালো করেই জানেন আমার মনে হয়। যার সাথে তিনি কথা বলছিলেন, সেও নিশ্চই মিশন ইন্ডিয়ানা'র সাথে যুক্ত ছিল।'
'তুই এতোটা শিওর কী করে?' নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
'দেবরাজ বর্মন তাকে বলছিলেন যে, মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক দেবব্রত চৌধুরীকে খুঁজতে বেরিয়ে গেছেন। মিস্টার বর্মন নাকি বাধ্য হয়েই মিস্টার ভৌমিককে দেবব্রতর ঠিকানাটা দিয়েছেন। নীহারিকা, এতে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে দেবরাজ বর্মন জানতেন দেবব্রত চৌধুরীর ঠিকানা। দেবরাজ বর্মন চান না যার সাথে তিনি কথা বলছেন, সে কোনো ঝামেলায় মধ্যে জড়িয়ে পড়ুক। তাই তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সাজেশান তিনি দিয়েছেন। নীহারিকা, আমি দেবরাজ বর্মনকে বলতে শুনলাম যে, তিনি চান না যেটা আগে ঘটে গেছে, সেটা আবার ঘটুক।'
কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেল সপ্তর্ষি। কথা শেষ হওয়ার পর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে সেটার বিষয় গভীর চিন্তা।
'দেবরাজ বর্মন কোথায় আছেন এখন?' নীরবতা ভেঙে নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো।
'আমি যখন তাকে শেষ দেখলাম তখন তিনি আর্কাইভে ছিলেন।'
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নীহারিকা আবার বললো - 'সপ্তর্ষি, এখন এটা তো পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মিশন ইন্ডিয়ানা'র সাথে যুক্ত তিনজন আমাদের কাছে আছে। একটা দেবরাজ বর্মন, দেবব্রত চৌধুরী এবং সেই অজানা লোকটা। চিফ দেবব্রত চৌধুরীর খোঁজে গেছেন। যে কাজে তিনি গেছেন, তাতে সফল হলে অনেকটা প্রবলেম সল্ভ হবে। আর যদি সফল হলেন না, তাহলে আমাদের কিছু একটা ব্যাকআপ রাখতে হবে। দেবব্রত চৌধুরীর সাথে চিফের সম্পর্ক কেমন? এতো দিন ধরে নিরুদ্দেশ থাকা এই মানুষটা আদৌ চিফকে চেনে কি না সন্দেহ আছে তাতে। চিফের কথায় সে এখানে চলে আসবে, সেটা নিয়েও সন্দেহ কম নেই। কিন্তু দেবরাজ বর্মন এবং সেই অজানা লোকটার সাথে দেবব্রত চৌধুরীর অনেক পুরোনো সম্পর্ক। সেই মিশন ইন্ডিয়ানা'র সময় থেকে, সম্ভবত তারও আগে থেকে। দেবব্রত চিফের কথা না শুনলে, এদের কথা হয়তো শুনবে। আমাদের দুটো কাজ করতে হবে সপ্তর্ষি। প্রথম হলো ওই অজানা লোকটাকে খুঁজে বের করা এবং দ্বিতীয় কাজ হলো দেবরাজ বর্মন এবং ওই অজানা লোকটাকে নিজের হাতে রাখা।'
'কিন্তু সেই অজানা লোকটা কে, সেটা জানবো কী করে? দেবরাজ বর্মনকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি কোনো দিন বলবেন না।' সপ্তর্ষি বললো।
'রাইট। তিনি বলবেন না সেটা আমিও জানি। একটা উপায় আছে সপ্তর্ষি।'
'কী?'
'তাকে ফলো করা। তুমি যা বললে তাতে মনে হলো ওই লোকটা দেবরাজ বর্মনের খুবই ক্লোজ। তাই তাকে তিনি কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়তে দিতে চান না। এটাও পরিষ্কার যে, সেই লোকটা এখন কলকাতাতেই আছে। সেই লোকটা যদি দেবরাজ বর্মনের কাছের কেউ হয়, তাহলে দেবরাজ বর্মন শুধু ফোন করেই শান্ত থাকবেন না। খুব সম্ভবত তিনি যাবেন সেই অজানা লোকটার সাথে দেখা করতে আর আসন্ন বিপদের বিষয় তাকে খবর দিতে। সপ্তর্ষি, আজ আমাদের দেবরাজ বর্মনকে ফলো করতেই হবে।'
******************************************
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। মিস্টার দেবরাজ বর্মন আর্কাইভ লক করে মেন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে পার্কিংএর দিকে এগোলেন। কোনো ড্রাইভার নেই তার, গাড়ি তিনি নিজেই চালান। দেবরাজ বর্মনের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নীহারিকা ও সপ্তর্ষি সেখান থেকে রওনা দিলো। দেবরাজ বর্মন এবং সপ্তর্ষির গাড়ির মধ্যে দূরত্ব প্রায় চল্লিশ হাতের। তাদের গাড়ি ডায়মান্ড হার্বার রোড ধরে এগিয়ে চলেছে। জোকা থেকে দক্ষিণ দিকে আরো প্রায় কুড়ি কিলোমিটার এগিয়ে ইসরোর ইস্ট্রান উইংএর মেন বিল্ডিং এবং লঞ্চ প্যাড। লম্বা ডায়মান্ড হার্বার রোডটা পেরিয়েই বেশিরভাগ কর্মচারীদের নিজের বাড়ির দিকে যেতে হয়। দেবরাজ বর্মন এবং সপ্তর্ষির গাড়ির দূরত্ব মাঝে-মাঝে বাড়ছে ও মাঝে-মাঝে কমছে। সপ্তর্ষি চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজের গাড়িকে যথাসম্ভব দেবরাজ বর্মনের গাড়ির থেকে লুকিয়ে রাখার। দেবরাজ বর্মন যেন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারেন যে সপ্তর্ষি ও নীহারিকা তার পিছু নিয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ সময়ই লাগলো দেবরাজ বর্মনের গাড়িটা বেহালা পৌঁছতে। সপ্তর্ষি জানে দেবরাজ বর্মনের বাড়ি টালিগঞ্জে। রোজ তিনি ঠাকুরপুকুর এম জি রোড ধরে টালিগঞ্জের দিকে এগিয়ে যান। কিন্তু আজ তিনি এম জি রোডের দিকে গেলেন না। সোজা বেহালার দিকে এগিয়ে গেলেন।
'কোথায় যাচ্ছেন তিনি?' সপ্তর্ষির আশ্চর্য হলো।
'আমার ধারণাটাই ঠিক মনে হয় সপ্তর্ষি। তাকে ফলো করা আমাদের ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে হয়।'
বেহালা চৌরাস্তা থেকে দেবরাজ বর্মনের গাড়ি বেঁকে গেল বাঁ দিকে, জেম্স লং সরণির দিকে। সপ্তর্ষি এবং নীহারিকাকে বেশ অনেকক্ষণ ফলো করতে হলো নিজের উদ্দেশ্যে সফল হওয়ার জন্য। দেবরাজ বর্মনের গাড়ি অবশেষে কলকাতা বড় বাজারের কাছে একটা পুরোনো বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দেবরাজ বর্মনের গাড়ির থেকে প্রায় দুশো মিটার দূরত্ব রেখে সপ্তর্ষি নিজের গাড়ি দাঁড় করালো। রাত প্রায় আটটা বাজে। বড় বাজারে চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। কলকাতার এদিকে এখনো বেশ কিছু পুরোনো বাড়ির প্রাচুর্য আছে। যেই বাড়ির সামনে দেবরাজ বর্মন নিজের গাড়িটা দাঁড় করালেন সেটা চারতলা। নিচের তলায় দুটো দোকান। একটা কাপড়ের এবং একটা মুদিখানা। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা সরু গলি। গলিটা বেশ অন্ধকার। সেই গলি দিয়েই বাড়ির উপরে ওঠার সিঁড়ি। দেবরাজ বর্মন সেই গলির মধ্যে প্রবেশ করলেন। সপ্তর্ষি ও নীহারিকাও এগিয়ে গেল গলির দিকে। দেবরাজ বর্মন নিজের প্যান্টের পকেট থেকে একটা চাবি বের করে নিজের সামনের লোহার ফটকটা খুললেন এবং ভিতরে প্রবেশ করলেন। ভিতরে প্রবেশ করতেই তিনি পুনরায় লোহার ফটকে তালা লাগাতে ভুললেন না। সপ্তর্ষি ও নীহারিকার উৎসাহটা নিমেষের মধ্যে যেন অনেকটাই কমে গেল।
'ইশ! উপরে যাওয়াটা খুব দরকার ছিল নীহারিকা। এই চারতলা বাড়িতে কোন তলাতে ওই অজানা লোকটা লুকিয়ে আছে, সেটা জানা খুব দরকার ছিল। হাতে খুব বেশি সময় আছে বলে তো মনে হয় না। খুব সম্ভবত আগামীকাল সকালেই সেই অজানা লোকটা কলকাতা ছেড়ে দেবে।'
******************************************
গোল একটা কাঠের টেবিলের দু পাশে দুটো চেয়ারে বসে আছেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক এবং দেবব্রত চৌধুরী। ঘরটা খুব বড় না। একটা ছোট খাট ছাড়া একটা স্টিলের আলমারি আছে সেই ঘরে। দেবব্রত চৌধুরীর ডান দিকে একটা জানালা, সেটা অর্ধেক খোলা। দুজনের সামনে হুইস্কি ভরা দুটো কাঁচের গ্লাস রাখা আছে। তা ছাড়া টেবিলের উপর রাখা আছে হুইস্কির এবং জলের একটা করে বোতল।
হুইস্কিতে এক চুমুক দিয়ে অর্ধেক খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে দেবব্রত চৌধুরী বললেন - 'এই জানালাটা প্রায় খুলে রাখি আমি। এখান থেকে আকাশটা পরিস্কার দেখা যায়। অন্ধকার আকাশ। আকাশে অজস্র তারা। এই তারাদের নিয়েই তো আমাদের কারবার। কী বলেন মিস্টার ভৌমিক। একটা সময় ছিল যখন এই আকাশেই ঘুরে বেড়াতাম। আজ এই গ্রহ তো কাল ওই গ্রহ। সে সব এখন ইতিহাস হয়ে গেছে।'
'আপনি আমাকে চেনেন সেটা জেনে অবাক লাগছে।' মৃত্যুঞ্জয় বললেন।
'না চেনার কী আছে মিস্টার ভৌমিক। একটা সময় ছিল যখন ইসরো আমার সব কিছু ছিল। তাই ইসরোর এখনকার চিফকে চেনা কোনো বড় ব্যাপার না। আপনাকে তো সবাই চেনে। আপনার নেতৃত্বে আমাদের দেশ টাইটানে সাকসেসফুল মিশন করলো।' কথা শেষ করে দেবব্রত নিজের গ্লাস খালি করলেন।
নিজের গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ে বললেন - 'সেই টাইটান মিশনের ব্যাপারেই তো আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।'
দেবব্রত নিজের গ্লাসটা পুনরায় ভর্তি করে ভালো করে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের দিকে। তারপর অট্টহাস্য করে বললেন - 'কেন? এই মিশনটাও কি সফল হয়নি?'
'এক প্রকার বলতে গেলে না, সফল হয়নি। উল্টে যা সংকেত পাওয়া গেছে, সেগুলো আরো ভয়ঙ্কর।' চিন্তিত গলায় বললেন মিস্টার ভৌমিক।
'আমি আগেই বলেছিলাম, টাইটানে আর যেন কোনো মিশন না হয়। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না। আমি নাকি ওখান থেকে ফিরে পাগল হয়ে গেছি। ওখানে যা কিছু ঘটেছে সেটা দেখে নিজের মানসিক ভারসাম্য আমি নাকি হারিয়ে ফেলেছি। এগুলো শুনতে হয়েছে আমায় এক সময়।'
'কী হয়েছিল সেখানে? সেটাই তো জানতে চাই মিস্টার চৌধুরী।'
নিজের দ্বিতীয় পেগ শেষ করে দেবব্রত চৌধুরী বললেন - 'ভয়ঙ্কর, খুবই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছিল সেখানে।'
ক্রমশঃ....