Read Mission Indiana - 6 by Bishwadeep Mukherjee in Bengali Science-Fiction | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

Mission Indiana - 6

মিশন ইন্ডিয়ানা
*************
পর্ব - 6
*******
Welcome Back
**************

ফ্ল্যাটটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা ঘর। ড্রইং রুম বললে ভুল বলা হবে না। ঘরের চার কোণায় চারটে কম পাওয়ারের লাইট লাগানো আছে। ঘরের বাঁ দিকে একটা খোলা দরজা। কথা গুলো সেখান থেকেই শোনা যাচ্ছে। দরজার দিকে এগিয়ে গেল নীহারিকা এবং সপ্তর্ষি। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো একটা ঘরে দেবরাজ বর্মন এবং সেই অজানা লোকটা তর্ক-বিতর্ক করতে ব্যস্ত। দেবরাজ বর্মন নীহারিকা ও সপ্তর্ষির দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেই অজানা লোকটার মুখ ছিল তাদের দিকেই। চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার কারণেই হয়তো সেই অজানা লোকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা নীহারিকা ও সপ্তর্ষিকে দেখতে পাচ্ছিল না। সপ্তর্ষি একবার চারিদিকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর দেবরাজ বর্মন আর সেই অজানা লোকটার কথায় মনোযোগ দিলো। সেই অজানা লোকটা দেবরাজ বর্মন থেকে একটু লম্বা। মাথায় চুল একেবারে কম। নেই বললে ভুল বলা হবে না। চেহারায় বলি রেখা গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ গুলো যেন একটু ভিতরে ঢুকে গেছে। সেই লোকটা কিছু বলছে দেবরাজ বর্মনকে।
'এতো বছর ধরে গুহার মধ্যে ঢুকে বসে আছি। আমার নিজের জীবন বলে আর কিছুই রইল না। মাঝে-মাঝে ভাবি যে, সেই মিশনে মরে গেলেই হয়তো ভালো হতো। এমন একটা থার্ড ক্লাস লাইফ থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম। শুধু তোর ভয়ের কারণে আমি নিজের জীবনটা শেষ করে দিলাম।'
'তুই যদি আমার নিজের ভাই না হতিস, তাহলে এতো ভয় পেতাম না। তুই এটা ভালো করে জানিস অনুরাগ, তোর ছাড়া এই জীবনে আমার কেউ নেই। আমি তখনো চাই নিই আর এখনো চাই না যে, তুই কোনো ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলিস। অনুরাগ, আমি জানতাম না কিছুই। কোনো আন্দাজ ছিল না আমার। বহু বছর হলো আমি ইসরো তে কাজ করছি। কোনো দিন মহাকাশ যাইনি। এই পৃথিবীর বুকে থেকেই কাজ করে গেছি সারা জীবন। যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতাম যে, কিছু একটা ঘটবে, তাহলে তোকে কোনো মতেই ইন্ডিয়ানা'র পাইলট করে সেখানে পাঠাতাম না।'
'তুই আমায় পাইলট করিসনি দাদা। পাইলট হয়েছিলাম আমি নিজের ক্ষমতায়।' একটু উচ্চ স্বরে অনুরাগ বর্মন বললেন।
'সেটা আমি জানি অনুরাগ। কিন্তু সেই সময় আমি বাধা হয়ে দাঁড়াতাম। কেন অনুরাগ? কেন আমি টেকনিশিয়ানের কাজ ছেড়ে আর্কাইভ হেড হলাম? একবারও ভেবে দেখেছিস? ওই ক্লাসিফাইড ফাইল যেন কারোর হাতে না যায়। পরবর্তী কালে যদি কোনো দিন মিশন ইন্ডিয়ানা'র উপর ইনভেস্টিগেশন হতো, তাহলে তোকেও জেরা করা হতো। সেটা আমি চাইতাম না। আর আমি ভুল কোথায় ছিলাম? সেই ঘটনার পর দেবব্রত গা ঢাকা দিলো। চিফ কুণাল গোস্বামী ত্যাগপত্র দিয়ে চলে গেল জানি না কোথায়? আমি তোকে ওখানে ছেড়ে দিতাম? যাতে সবাই তোকে গিল্টি প্রমাণ করতে পারুক।' কথা গুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন দেবরাজ বর্মন। 
নীহারিকা ও সপ্তর্ষি অবাক হয়ে তাদের কথপোকথন শুনছিলো। মাঝে একে অপরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার তাদের কথায় মনোযোগ দিলো। 
দেবরাজ বর্মনের কথায় একটু হেসে অনুরাগ বর্মন বললেন - 'আমি যে অপরাধী না সেটা তখনই প্রমাণ করতে পারতাম, যদি আমি সেখানে থাকতাম। টাইটান থেকে ফিরে আসার পর গা ঢাকা দেওয়ার মানেই হলো যে, আমি অপরাধী। যদি সেখানে থাকতাম তাহলে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ পেতাম। সেই সুযোগটা আর পেলাম না। যারা তখন ইসরোতে কাজ করতো, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এখন আর নেই। কিন্তু তারা যত দিন ইসরোতে কাজ করে গেছে, আমাকে আর দেবব্রতকে অপরাধী মনে করেছে। এমন মনে হয় যেন নিজের তিনটে সাথীকে আমরা হারিয়ে দিইনি, বরং তাদের খুন করেছি আমরা। দাদা, এখনো যদি কোনো সুযোগ পাই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার তাহলে আমি পিছনে ফিরে আর দেখবো না।'
অনুরাগ বর্মনের কথা শুনে চুপ রইলেন দেবরাজ বর্মন। ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা ছেয়ে রইল। দেবরাজ বর্মন একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। সামনে একটা কাঁচের টেবিলে একটা সিগারেটের ডিবে আর আ্যশ ট্রে রাখা ছিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান মারলেন তিনি। 
'দেখ অনুরাগ, আমি আজ পর্যন্ত যা কিছু করেছি তোর ভালোর জন্যই করেছি। আমার মনে আছে যখন টাইটান থেকে তুই ফেরত এলি, তখন তোর মানসিক অবস্থা ভালো ছিলো না। পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলি তুই। সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়ে তোকে সুস্থ করানো হলো। জানিস অনুরাগ? যখন বাবা-মা মারা যায় তখন তোর দায়িত্ব নেওয়ার কথা আমায় বলে গিয়েছিল তারা। আজ পর্যন্ত সেটাই পালন করে এসেছি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে তুইও বড় হয়েছিস। তোর নিজস্ব মত-অমত বলেও কিছু থাকতে পারে, সেটা ভুলে গিয়েছিলাম।'
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন দেবরাজ বর্মন। ঘর থেকে দ্রুত কদমে বেরোতে গিয়েই চমকে গেলেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীহারিকা ও সপ্তর্ষি।

********************************

মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের চলে যাওয়ার পর দেবব্রত সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাহাদুরকে বলে দিলেন যে রাতের খাবার উনি খাবেন না। নিজের ঘরের জানালাটা খুলে একটা চেয়ার নিয়ে বসলেন তিনি। রাত্রের খোলা আকাশ দেখতে খুব পছন্দ করেন দেবব্রত চৌধুরী। এই পছন্দটা আজকের নয়, বহু পুরোনো। ছোট বেলায় মায়ের মৃত্যুর পর নিজের বাড়ির ছাদে, খোলা আকাশের নিচে গার্গীর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছেন তিনি। গার্গী নামের মেয়েটি তাদের বাড়ির পাশেই থাকতো। গার্গী বলতো - 'জানিস দেবু, মা বলে, যে মারা যায় সে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়।'
গার্গীর থেকে এই কথাটা দেবব্রত চৌধুরী অনেকবার শুনেছিলেন। এক দিন বললেন - 'যদি তাই হয় গার্গী, তাহলে আমি একদিন যাবো ওই তারা গুলোর কাছে। খুঁজে বের করবো মা কে।'
তারাদের মাঝে দেবব্রত গেলেন, কিন্তু নিজের মা কে খুঁজতে নয়, বরং বেঁচে থাকার জন্য ভবিষ্যতের পরিকল্পনাকে এক নতুন রূপ দিতে। গার্গীর সাথে তার বহু বছর পুরোনো সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল যখন তিনি চাঁদ থেকে ফিরে এলেন। ইসরোতে চাকরি পাওয়ার পর দেবব্রত চৌধুরীর প্রথম ম্যান মিশন ছিল চাঁদে। সে সময়ে প্রায় বহু দেশই চাঁদে "লুনার বেস" বানাবার পরিকল্পনা করছে। বলাই বাহুল্য সেই পরিকল্পনাতে আমাদের দেশও ছিল। নিজের মুন মিশনের আগে দেবব্রত গার্গীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। গার্গী তখন বেশ অসুস্থ। অসুস্থ্যতার কারণে বিছানা থেকে উঠবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে গার্গী।
'আর বেশি দিন নেই গার্গী। এই মিশন থেকে ফিরে এসেই তোকে আমি নিজের করে নেবো। তারপর তোর সব দায়িত্ব আমার।' গার্গীর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন দেবব্রত। গার্গীর দু চোখ বেয়ে জল বেরিয়ে আসছিল। সে হয়তো বুঝতে পেরেছিল, দেবব্রতর মুন মিশন থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত এই পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব আর থাকবে না। হলোও সেটাই। পৃথিবীতে ফিরে এসে দেবব্রত জানতে পারলো সে মর্মান্তিক খবরটা। কী একটা জটিল রোগে গার্গীর নিয়মিত রক্তক্ষয় হয়ে চলেছিল। ঠিক মত রোগ ধরতে না পারার কারণে, গার্গী বহুদূর চলে গেল দেবব্রত থেকে। হয়তো সেই তারাদের দেশেই। 
আজ হঠাৎ কেন পুরোনো স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে আসছে ঠিক বুঝতে পারলেন না দেবব্রত চৌধুরী। বহু বছর হয়ে গেল তিনি একা। ছোট বেলায় মা কে হারিয়েছেন। বাবার সাথে দূরত্ব চিরকালের। কাছে ছিল তো একমাত্ৰ গার্গী। অবশেষে সেও দেবব্রতকে ছেড়ে চলে গেল। টাইটান থেকে ফিরে আসার কিছু দিন পর দেবব্রত খবর পেল যে, তার বাবাও নাকি এই পৃথিবীতে আর নেই। নিঃসঙ্গতাকে বহু দিন আগে থেকেই নিজের জীবনের সঙ্গী বানিয়ে নিয়েছেন দেবব্রত চৌধুরী। কিন্তু এই ত্রিশটা বছর যেন ত্রিশটা যুগের মত কেটেছে তার। নিজের কাউকে হারাবার যন্ত্রণা তিনি আগেও পেয়েছেন। কিন্তু এই যন্ত্রণাটা কেমন যেন অদ্ভুত ধরণের। আজ তিনি জীবিত আছেন, শুধু সুধাকর দত্ত এবং অগ্নিজিৎ রায়ের জন্য। দুজনেই নিজের ক্যাপ্টেনের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণের আহুতি দিয়েছে। দেবব্রত জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আকাশে ঝলমল করছে অসংখ্য তারা। মহাকাশের এই অসংখ্য তারাদের মাঝেই কোথাও লুকিয়ে আছে টাইটান। সেই টাইটান নামক উপগ্রহতে হয়তো আজও আছে সুধাকর এবং অগ্নিজিতের ফসিল্স। কিম্বা হয়তো সেই অজানা শক্তি তাদের ফসিল্স গুলোকেও নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। ইন্ডিয়ানা নামের স্পেসশিপটা যখন ইসরোর ইস্ট্রান উইংএর লঞ্চ প্যাড থেকে রওনা হয়, তখন কেউ ভাবেনি যে তাদের এই মিশনটা ভয়ানক কিছুর সম্মুখীন হতে চলেছে। পৃথিবীর অর্বিট থেকে বেরিয়ে ইন্ডিয়ানা যখন টাইটানের দিকে এগোতে শুরু করেছিল, তখন সুধাকর বলেছিল - 'আর তো কিছু দিনের ব্যাপার। পৃথিবীতে ফিরেই সব থেকে আগে ওই বাড়িটা বুক করে নেবো। বহু দিন হয়ে গেল ভাড়া বাড়িতে থাকা। মাথার উপর একটা নিজস্ব ছাদ দরকার পড়ে।'
'তোমার তো শুনছি বিয়েও ঠিক হচ্ছে নাকি।' অনুরাগ বর্মন জিজ্ঞাসা করেছিল। 
দুজনেই পাশাপাশি বসেছিল। অনুরাগ পাইলট এবং সুধাকর কো পাইলট। 
অনুরাগের বিয়ের কথা শুনে অল্প অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন দেবব্রত। মনে পড়েছিল কিছু পুরোনো কথা। তখন তিনি মুন মিশনে যাচ্ছেন। একজন সিনিয়ার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল - 'শুনছি নাকি পৃথিবীতে ফিরে তোর বিয়ে? নিমন্ত্রণ করতে ভুলিস না যেন।'
কথা গুলো এখনো মাঝে-মাঝে কানের পর্দায় ধাক্কা মেরে চলে যায়। ঠিক মনে হয় এসব যেন কালকেরই ঘটনা। নাহ, পেরিয়ে গেছে বহু বছর। এখন তিনি প্রৌঢ়। চেহারার যা অবস্থা, বৃদ্ধ বললেই চলে। নিজের জীবনের আশি শতাংশ তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন। কোনো রকমে কুড়ি শতাংশ কাটিয়ে দিলেই মুক্তি। "মুক্তি" শব্দটা বেশ প্রিয় দেবব্রত চৌধুরীর কাছে। এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তিই তো পেতে চান তিনি। তিনি কোনো দিন আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেননি। সেটা করলে সুধাকর ও অগ্নিজিতের অপমান হতো। দেবব্রত জানতে ইচ্ছে করে অনুরাগের বিষয়। কোথায় আছে সে এখন? তার সাথে অনুরাগই তো ছিল যে জীবিত ফেরত এসেছিল প্রথিবীতে। কোনো সন্দেহ নেই, খুব ভালো পাইলট ছিল সে। 
দেবব্রত নিজের চেয়ার থেকে উঠলেন। খাটের পাশে রাখা স্টিলের এক আলমারি খুলে বের করলেন একটা ছোট মত চামড়ার ব্যাগ। চামড়ার ব্যাগটা নিয়ে বিছানায় বসলেন তিনি। ভিতর থেকে কিছু ছবি বের করে বিছানার উপর রাখলেন। ছবি গুলো দেখে মুচকি হাসলেন ঠিকই, কিন্তু তার দু চোখ ছলছল করে উঠলো। টাইটানে যাওয়ার ঠিক আগেকার ছবি এগুলো। অগ্নিজিৎ তুলেছিল। হেডিং দিয়েছিল - 'ক্রিউ অফ মিশন ইন্ডিয়ানা।' 
ছবি গুলোর প্রিন্ট বের করে সবাইকে দিয়েছিল সে।
হঠাৎ নিজের ফোনে রিং শুনতে পেলেন দেবব্রত চৌধুরী। একটু আশ্চার্য হলেন ঠিকই। কেউ এখন তাকে আর তেমন ফোন করে না। সামনের টেবিলের উপর রাখা ছিল মোবাইলটা। খাট থেকে উঠে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেবব্রত দেখলেন কোনো অচেনা নাম্বার থেকে কল আসছে। 
'হ্যালো!' 
'আমার কথা কি দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে হচ্ছে?' ওপার থেকে আওয়াজ এলো।
'হ্যাঁ, আমি দেবব্রত চৌধুরী বলছি। আপনি?'
কিছু সেকেন্ডের নীরবতার পর কল করা লোকটি বললেন - 'আমি কলকাতা থেকে বলছি, দেবরাজ বর্মন।'

********************************

আশানুরূপ কিছু হলো কী? হ্যাঁ, কিছু তো হয়েছে ঠিকই। দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুব দরকার ছিল। সেটা অন্তত হয়ে গেল। দেবব্রত কেমন মানুষ, এর বিষয় কিছুই জানতেন না মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। চিন্তা ছিল যে, দেবব্রত আদৌ দেখা করবেন কি না তার সাথে। এই দিক দিয়ে এখন চিন্তা মুক্ত তিনি। দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে নিজের সমস্ত বক্তব্য রাখতে পেরেছেন, এটাই অনেক। কিন্তু সত্যি কি এটা অনেক? দেবব্রত চৌধুরীর ফিরে আসা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। দেবব্রত কিছুই খুলে বললেন না। এই ধোঁয়াশাটা কাটা না পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না মৃত্যুঞ্জয়। দার্জিলিংএর হোটেলে ফিরে এসে, নিজের ঘরে বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করে গেলেন তিনি। যা কিছু ঘটেছে আর যা কিছু ঘটতে চলেছে, তার সমাধান একটি। সেটার নাম হলো - দেবব্রত চৌধুরী। মৃত্যুঞ্জয় কি আরো কিছু দিন এখানে থাকবেন? আবার কি দেখা করতে যাবেন দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে? মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন গিজগিজ করছে তার। ইসরোর প্রাক্তন চিফ কুণাল গোস্বামীর কথা মনে পড়ছে তার। মিশন ইন্ডিয়ানা'র পর তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। পরিস্থিতি অনেকটা তেমনই তৈরি হচ্ছে এবার। তাহলে কি মৃত্যুঞ্জয়কেও পদত্যাগ করার জন্য তৈরি থাকা দরকার? নিজের মনকে বোঝানো দরকার যে, ইসরোর আর তাকে প্রয়োজন নেই।
প্রচুর ভাবনা চিন্তা করে অবশেষ মৃত্যুঞ্জয় সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এখানে থাকার আর প্রয়োজন নেই। দেবব্রতকে যা বলার, যা বোঝাবার উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবার সব কিছুই দেবব্রত চৌধুরীর নিজের বিবেকের উপর। অফিসে তার প্রয়োজন। তাকে অফিসে না পেয়ে অনেকেই হয়তো চিন্তায় আছে। অর্ণবের এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সেখানেও উপস্থিত থাকতে পারলেন না তিনি। নিজের খাটে বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে প্লেনের টিকিট কাটার জন্য একটা আ্যপ খুলতে যাবেন, ঠিক সে সময় তিনি দেখলেন নীহারিকা তাকে ফোন করছে। একটু আশ্চর্য তো তিনি হলেনই। আবার কিছু ঘটলো নাকি? মনের ভিতর একরাশ ভয় নিয়ে তিনি কলটা তুললেন।
'হ্যালো।'
'স্যার, আমি নীহারিকা।'
'হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। বলো।'
'স্যার, আপনাকে একটা ছোট প্রশ্ন জিগ্যেস করতে চাই।'
'কী প্রশ্ন?' 
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলো - 'দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?'
মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক চমকে উঠলেন। নীহারিকা কী করে জানতে পারলো যে তিনি দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? একমাত্র দেবরাজ বর্মন ছাড়া তো কেউ জানে না এটা। তাহলে কি দেবরাজ বর্মন বলেছেন নীহারিকাকে? নীহারিকা যখন জেনেই গেছে, তখন লুকিয়ে লাভ নেই। 
'দেখা হয়েছে নীহারিকা। তবে এই দেখাটা কতটা সফল হয়েছে, সেটা বুঝতে পারছি না।'
'মানে? কথা হয়নি দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে?' নীহারিকা প্রশ্ন করলো। 
'কথাও হয়েছে। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে মিশন ইন্ডিয়ানা'তে কী ঘটেছিল, সেটাও জেনেছি। এবারে মিশন টাইটানে কী হয়েছে, সেটাও বলেছি দেবব্রত চৌধুরীকে। কিন্তু যে প্রস্তাবটা তার সামনে রাখা হয়েছে, সেটা সে মানবে কি না জানি না। পরিস্কার করে কিছুই বললেন না।' হতাশার সুরে মৃত্যুঞ্জয় বললেন। 
'স্যার, প্রস্তাবটা আমরা রাখিনি। প্রস্তাবটা যারা রেখেছে তাদের কথা যদি আমরা না শুনি, তাহলে যে অনর্থটা হবে, সেটার রেস্পন্সিবিলিটি কে নেবে? দেবব্রত নেবেন তো?' নীহারিকার গলা উচ্চ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কার সাথে সে কথা বলছে, সেটা ভেবে পরক্ষণেই নিজের গলার আওয়াজ নিচে করে নিলো।
'আই ডোন্ট নো এনিথিং নীহারিকা। আমি জানি না আমি কী করবো। আমি দেবব্রতকে প্রেসার তো দিতে পারি না। সব কিছু বুঝিয়ে বলেছি। মোর্স কোর্ড গুলো দেখিয়েছি যেটা তুমি আমায় দিয়েছিলে। এবার তো সব কিছু তার বিবেকের উপর। তাই না?'
খানিক চুপ থেকে নীহারিকা বললো - 'স্যার, মিশন ইন্ডিয়ানা'র বিষয় আমিও সব ইনফরমেশন পেয়ে গেছি। ওই মিশনে দেবব্রত চৌধুরীর সঙ্গে আরেক জন জীবিত ফেরত এসেছিল।'
'হ্যাঁ, জানি। অনুরাগ বর্মন। দেবরাজ বর্মনের ভাই।' মৃত্যুঞ্জয় বললেন।
'হ্যাঁ স্যার। আমি এই মুহূর্তে অনুরাগ বর্মনের বাড়িতেই আছি।'
নীহারিকার কথায় আবার চমকে গেলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক।
'তুমি হঠাৎ তার বাড়িতে কী করছো?' জিজ্ঞাসা করলেন মৃত্যুঞ্জয়। 
'নিজেকে আর বাকি লোকেদের বাঁচাতে এসেছি স্যার।'
নীহারিকার জবাবে চুপ রইলেন মৃত্যুঞ্জয়। 
'স্যার, একটা কথা বলতে চাই আপনাকে। আমার মনে হয় আমাদের কোনো চান্স নেওয়া উচিত না। স্যার, আপনি এখনো কানফিউজ যে, দেবব্রত চৌধুরী আসবেন কি না আপনার কথায়। আর আমরা এটাও জানি যে, দেবব্রত চৌধুরী না এলে আমাদের কাজ পুরো হবে না। আপনার কথা দেবব্রত চৌধুরী নাই শুনতে পারেন। সেক্ষেত্রে আমাদের এমন একজনকে প্রয়োজন পড়তে পারে, যার কথা দেবব্রত চৌধুরী শুনতে পারেন। যার কথায় দেবব্রত চৌধুরী এখানে আসতে পারেন।' কথা গুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেল নীহারিকা। 
'তোমার কি মনে হয় সেক্ষেত্রে অনুরাগ বর্মন আমাদের কোনো কাজে আসবে?' প্রশ্ন করলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক।
'হ্যাঁ স্যার। অনুরাগ বর্মন আমাদের সঙ্গেই আছেন। হ্যাঁ, অনুরাগ বর্মনের দাদা দেবরাজ বর্মন কিন্তু আমাদের সঙ্গে নেই। জানি না ওনার মনে এই মুহূর্তে এখন কী চলছে। তিনি চান না যে, তার ভাই কোনো ঝামেলায় পড়ুক। কিন্তু অনুরাগ বর্মন নিজের দাদার বিরুদ্ধে গিয়ে এগিয়ে এসেছেন।'
খানিক চুপ থাকলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। হয়তো কিছু চিন্তা করছিলেন। 
'ঠিক আছে। আমি কালকে ফিরছি। দেখি কী হয়।' কথা শেষ করে কলটা কেটে দিলেন মৃত্যুঞ্জয়।

********************************

মোবাইলটা নিজের জিন্সের পকেটে রেখে নীহারিকা অনুরাগ বর্মনকে বললো - 'জানি না এর ভবিষ্যৎ কী মিস্টার বর্মন। এটাও জানি না যে, দেবরাজ বর্মন কী ভাবে রিয়েক্ট করবেন এবার।'
একটা সোফাতে নীহারিকা ও সপ্তর্ষি বসে ছিল। অনুরাগ বর্মন বসে ছিলেন চেয়ারে।
'আমি তো এটা বুঝতে পারছি না দেবরাজ বর্মন এমন করছেন কেন? উনি কি সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছেন না?' কথাটা সপ্তর্ষি বললো। 
অনুরাগ বর্মন এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। সিগারেটের বেশ কিছু লম্বা টান মেরে বাকি অংশটা আ্যশ ট্রে তে ফেলে তিনি বললেন - 'কালচক্র হয়তো এটাকেই বলে। যাকে একদিন মানসিক ভারসাম্যহীন বলে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তাকেই এতো বছর পর আবার প্রয়োজন পড়লো। দোষটা আসলে কারোর না। সে সময়ে দেবব্রতরও কোনো দোষ ছিল না, আজ তোমাদেরও কোনো দোষ নেই। আজ যদি কোনো অঘটন ঘটে, তাহলে নিজেদের দোষী মনে করো না কোনো দিন। দোষ আসলে ডিপার্টমেন্টের। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেটার বিষয় যদি ইসরো একটু রিসার্চ করতো, ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখতো, তাহলে আজ এমন পরিস্থিতি আসতো না। তোমাদের টাইটানে পাঠানো ভুল হয়েছে। একেবারে ভুল হয়েছে। এখন কোনো রকমের মিচুয়াল কাজে আসবে বলে তো মনে হয় না আমার।'
নীহারিকা ও সপ্তর্ষি একে অপরের দিকে তাকালো। 
'মিচুয়াল কাজে আসবে না মানে? কী বলতে চাইছেন আপনি?' সপ্তর্ষি জিজ্ঞাসা করলো। 
নিজের চেয়ার থেকে উঠে গেলেন অনুরাগ বর্মন। খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
'একটা ডিজাস্টার সে সময়ে ঘটেছিল। আবারও একবার ডিজাস্টার ঘটতে পারে। যদি এমন হলো.. যদি এমন হলো তাহলে আশ্চর্যের কিছুই হবে না।'
ডিজাস্টারের কথা শুনে নীহারিকা এবং সপ্তর্ষির মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। 
'ওই ডি.. ডিজাস্টারটা যেন না হোক সেটার চেষ্টাই তো করে যাচ্ছি আমরা।' শুকনো গলায় নীহারিকা বললো। 
নীহারিকার দিকে তাকালেন অনুরাগ বর্মন। 
'নীহারিকা, তুমি এক স্বপ্নের কথা বলেছিলে না। যে ঘটনা তোমাদের সাথে টাইটানে ঘটেছে, সেগুলো বারবার স্বপ্ন হয়ে তোমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।'
'হ্যাঁ।' নীহারিকা মাথা নাড়লো।
'আমার যতদূর মনে হয় ওই স্বপ্নগুলো বারবার আসার পিছনেও কারণ আছে।' বললেন অনুরাগ বর্মন। 
'কী কারণ?' সপ্তর্ষি জিজ্ঞাসা করলো।
'হয়তো তারা কোনো ভাবে তোমাদের মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিতে চায়। তোমাদের বন্ধু অর্ণবের দুর্ঘটনার পিছনেও তাদেরই হাত আছে কি না কে জানে?'
কথাটা বলে অনুরাগ বর্মন পুনরায় চেয়ারে বসে বললেন - 
'এখনো তো সবই ধোঁয়াশা। তাই না? সবটাই আমাদের ধারণা মাত্র। কিন্তু আমি নিজের চোখে যা দেখেছি, তার বেসিসে বলতে পারি যে, তারা কিছুও করতে পারে।'

********************************

'বহুদিন.. না, বহু বছর পর কথা হচ্ছে তোমার সাথে ক্যাপ্টেন।' গাড়ি চালাতে-চালাতে বললেন দেবরাজ বর্মন। 
'ক্যাপ্টেন বলেই তো ভুল করে ফেললে দেবরাজ। আমি ক্যাপ্টেন না। আমি একজন সাধারণ মানুষ, যে নিজের শেষ দিনের ব্যাক কাউন্টিং শুরু করে দিয়েছে।' কথা বলতে-বলতে দেবব্রত আবার জানালার কাছে চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
'না দেবব্রত না। এতো তাড়াতাড়ি ব্যাক কাউন্টিং শুরু করলে চলবে না। এখনো তো তোমার আসল কাজটা বাকিই আছে। আসলে কী জানো, আমি মৃত্যুঞ্জয়কে তোমার ঠিকানা দিতে চাইনি। কিন্তু দিতে বাধ্য হলাম। আমার বিষয় অনেক ইনভেস্টিগেশন করেছিল মৃত্যুঞ্জয়। তারপর ভাবলাম, যা কিছু হবে সেটার দায়িত্ব আমি নিজের উপর কেনই বা নিই। সশরীরে পৃথিবী কোনো দিন ছাড়িনি আমি। এমন সৌভাগ্য তোমরাই পেয়েছো। তাই সেদিন টাইটানে কী ঘটেছিল, সেটা পুরোটাই তোমাদের মুখে শোনা। তোমার আর অনুরাগের মুখে। বিশ্বাস করেছিলাম তোমাদের কথায়। সত্যি  বলতে অনুরাগের মানসিক অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু....'
দেবরাজ বর্মনের কথা মাঝ পথে থামিয়ে দেবব্রত বললেন - 'থাক না দেবরাজ। এখন এসব কথা বলে কী লাভ? যা হয়ে গেছে, সেটা আর ফিরে আসবে না। আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না, যাদের প্রাণ আমাকে বাঁচানোর জন্য গেছে।'
রাস্তার এক ধারে নিজের গাড়িটা দাঁড় করালেন দেবরাজ বর্মন। বললেন - 'দেবব্রত, তুমি আবার ফিরে আসবে কি না আমি জানি না। কিন্তু যদি ফিরে আসো, তাহলে দুজনকে নিজের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। এক আমাকে, আর দ্বিতীয় আমার ভাইকে। তাকে আমি অনেক বোঝালাম। কিন্তু সে বুঝতে চাইলো না। এবার তোমায় বোঝাচ্ছি। অনুরাগকে নিয়ে টানাটানি করবে না। মৃত্যুর সাথে দ্বন্দ যুদ্ধ করার তোমার ইচ্ছে হতে পারে, কিন্তু আমার কোনো ইচ্ছে নেই। আমি এটাও চাইবো না যে, তুমি মৃত্যুর সাথে এই দ্বন্দ যুদ্ধে আমার ভাইকে টেনে নিয়ে যাও।' কথা শেষ করে দেবরাজ বর্মন কলটা কেটে দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেন। 
দেবব্রত চৌধুরী নিজের মোবাইলটা যথাস্থানে রেখে দেওয়ালে ঝুলন্ত আয়নার সামনে গেলেন। ভালো করে নিজেকে আয়নায় দেখলেন তিনি। তারপর অট্টহাস্য করে বললেন - 'ওয়েলকাম ব্যাক দেবব্রত, ওয়েলকাম ব্যাক।'

ক্রমশঃ....