নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে কংগ্রেস নেতাদের ভয়ের শেকড় যে কতটা গভীরে প্রোথিত ছিল, সেটা বোঝার জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে প্রাক-স্বাধীনতা কালের কিছু অগ্নিগর্ভ মুহূর্তের দিকে।
আজ যে ইতিহাসকে পাঠ্যপুস্তকে নিছক কয়েক লাইনের অধ্যায়ে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, সেগুলো আসলে ছিল ভারতের স্বাধীনতার আসল মোড়-ফেরানো ঘটনা।
স্বাধীনতার প্রকৃত চালিকা শক্তি কী ছিল?
গান্ধী–নেহেরুর অহিংস আন্দোলন, নাকি আজাদ হিন্দ ফৌজের রক্ত ও নৌসেনাদের বিদ্রোহ?
এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনার ভেতর—যেগুলোকে সচেতনভাবে আড়াল করা হয়েছে।
তাই প্রয়োজন সেই ঘটনাগুলোর পুনরায় পোস্টমর্টেম।
কেন কংগ্রেস নেতৃত্ব INA ট্রায়ালকে ভয় পেয়েছিল?
কেন তারা নৌবাহিনী বিদ্রোহকে দমন করেছিল?
কেন INA সৈনিকদের স্বাধীন ভারতে অবহেলিত হতে হলো?
এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখতে পাব—নেতাজী অনুপস্থিত থাকলেও তাঁর ছায়াই কংগ্রেসের ক্ষমতালোভী রাজনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
এখন আমরা সেই ঘটনাগুলোর প্রথমটিতে ঢুকব, যা গোটা দেশকে উত্তাল করেছিল এবং ব্রিটিশদের কাঁপিয়ে তুলেছিল—
INA ট্রায়াল ও নৌবাহিনী বিদ্রোহ।
# INA ট্রায়াল ও নৌবাহিনীর বিদ্রোহ: ভারতের স্বাধীনতার প্রকৃত টার্নিং পয়েন্ট—
১. লাল কেল্লার বিচার:
এক অগ্নিগর্ভ সূচনা, **তারিখ: ৫ নভেম্বর ১৯৪৫।** দিল্লির লাল কেল্লার ভেতরে শুরু হলো আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচার। অভিযুক্ত:
- শাহনওয়াজ খান (পেশোয়ার),
- প্রেমকুমার সেহগল (জালন্ধর),
- গুরবক্ষ সিং ঢিল্লন (পাঞ্জাব)।
অভিযোগ: রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা ও ষড়যন্ত্র।
ব্রিটিশরা ভেবেছিল—INA-কে দেশদ্রোহী প্রমাণ করলে নেতাজীর জনপ্রিয়তা ভেঙে পড়বে। কিন্তু ঘটল উল্টো।
ভারত উত্তাল হয়ে উঠল। কলকাতার কলেজস্ট্রিট থেকে বোম্বের ডকইয়ার্ড, লাহোর থেকে মাদ্রাজ—সব জায়গায় মিছিল।
স্লোগান কাঁপিয়ে দিল আকাশ:
**“লাল কেল্লার দেয়াল ভাঙবে, আজাদ হিন্দ ফৌজ জিতবে।”**
ছাত্র, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ বুঝল—INA আসলে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়েছে। বিচারপর্ব চলাকালীন শহরগুলোতে টানা ধর্মঘট, রেল অবরোধ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলল।
২. নেহেরুর নাটকীয়তা:
জওহরলাল নেহেরু আইনজীবীর পোশাক পরে আদালতে হাজির হলেন। সংবাদপত্রে শিরোনাম হলো—“নেহেরু INA অফিসারদের পাশে।”
কিন্তু ভেতরের চিত্র ভিন্ন।
- INA যোদ্ধাদের প্রতিরক্ষার আসল নেতৃত্বে ছিলেন ভি. কে. কৃষ্ণমেনন, ভূলাভাই দেশাই ও আসাফ আলী।
- নেহেরুর ভূমিকা ছিল প্রতীকী, রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা কুড়োনোর জন্য।
- কংগ্রেস নেতৃত্ব INA-কে অতিরিক্ত জনপ্রিয় হতে দিতে চাইছিল না।
- স্বাধীনতার পর INA সৈনিকদের পুনর্বাসন বা সেনাবাহিনীতে ফেরানোর বিষয়টি নিয়ে নেহেরু সরকার একেবারেই নীরব থাকে।
অতএব, নেহেরুর ভূমিকা ছিল দ্বিচারী—বাইরে INA-র সমর্থক, ভেতরে INA-র ইতিহাস চাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্রের অংশীদার।
৩. সৈনিকদের বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ:
**তারিখ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬।** বোম্বের HMIS *Talwar* জাহাজে নৌসেনারা বিদ্রোহে ফেটে পড়ল।
কারণ:
- অমানবিক খাবার,
- বর্ণবৈষম্যমূলক ব্যবহার,
- INA বন্দিদের মুক্তির দাবি।
মুহূর্তেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহ।
- ২০,০০০ নৌসেনা অংশ নিল।
- ৭৮টি জাহাজ ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে দিল।
- স্লোগান উঠল: **“Jai Hind! Release INA Prisoners!”**
কলকাতা, করাচি, মাদ্রাজ—সব জায়গায় বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। শহরের শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকল, ছাত্ররা মিছিলে যোগ দিল।
৪. রক্তাক্ত পরিণতি:
**তারিখ: ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬।** ব্রিটিশরা যুদ্ধজাহাজ থেকে গুলি চালাল। শত শত নৌসেনা মারা গেল। হাজার হাজার বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হলো।
**২৩ ফেব্রুয়ারি**, বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করল।
কিন্তু এই কয়েক দিনে গোটা ভারতীয় সেনা ও নৌবাহিনী বুঝে গেল—তারা আর ব্রিটিশদের জন্য লড়বে না।
৫. ব্রিটিশ আতঙ্ক ও অ্যাটলির স্বীকারোক্তি:
১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন গভর্নর জাস্টিস পি. বি. চক্রবর্তীর কাছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী **ক্লেমেন্ট অ্যাটলি** স্পষ্ট বলেছিলেন:
“ভারত থেকে ব্রিটিশদের সরে যেতে বাধ্য করেছিল প্রধানত INA-র বিদ্রোহ ও ১৯৪৬ সালের নৌসেনা মিউটিনি। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের প্রভাব আমাদের কাছে ছিল খুবই কম।”
অ্যাটলির এই স্বীকারোক্তি আজও প্রমাণ হিসেবে বিদ্যমান। অথচ পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস সরকার ন্যারেটিভ তৈরি করে যে, “দে দি আজাদি হামে, না খড়গ না ঢাল; সবরমতি কে সন্ত তু নে কর দিয়া কামাল !!”
সত্যিই এই সবরমতির সন্ত কামাল করে দিয়েছেন। নেতাজীর মত এমন একজন জনগণ মন অধিনায়ককে কংগ্রেস রাজনীতির চালকের আসন থেকে নির্বাসিত করে দিয়ে।
৬. কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতা:
কংগ্রেস নেতৃত্ব—গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল—বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ালেন না।
- গান্ধী বললেন: *“এই বিদ্রোহ অনুশাসনহীন।”*
- নেহেরু ও প্যাটেল ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বিদ্রোহীদের শান্ত করার আশ্বাস দিলেন।
ফলাফল: বিদ্রোহ রক্তে দমন হলো। INA-র ভাবমূর্তিকে আড়াল করা হলো। দেশবাসীর কাছে প্রকৃত ইতিহাসকে গোপন করে এক বিকল্প ইতিহাস তৈরি করে উপস্থাপন হলো।
৭. INA সৈনিকদের বিস্মৃতির অন্ধকার:
স্বাধীনতার পরে INA সৈনিকদের সেনাবাহিনীতে ফিরতে দেওয়া হলো না।
অনেকে চাকরি হারালেন, সমাজে সন্দেহের চোখে দেখা হলো।
কিছু INA যোদ্ধা সীমান্ত অঞ্চলে বা পাকিস্তানে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হলেন।
যারা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলেন, তারাই স্বাধীন ভারতে অবহেলিত হলেন।
৮. বিশ্লেষণ: কেন ভয় ?
- INA ট্রায়াল ও নৌবাহিনী বিদ্রোহ দেখিয়ে দিল—ভারতের স্বাধীনতার মূল চালিকাশক্তি ছিল সশস্ত্র বিপ্লব।
- জনগণ গান্ধী–নেহেরুর অহিংস কাহিনীর বাইরে এসে INA-র বীরত্বকে দেখল।
- ব্রিটিশরা স্বীকার করল, তারা ভয় পেয়েছিল সেনাদের বিদ্রোহে।
- কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব চাইলো না এই সত্য প্রকাশ পাক।
কারণ যদি প্রকাশ পেত, তবে গান্ধী–নেহেরুর একচ্ছত্র কৃতিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হতো। তাই তারা INA ও বিদ্রোহের কাহিনীকে ইতিহাস থেকে আড়াল করল।
লাল কেল্লার বিচার আর ১৯৪৬-এর নৌবাহিনী বিদ্রোহ—এই দুই ঘটনাই ভারতের স্বাধীনতার প্রকৃত টার্নিং পয়েন্ট।
নেতাজীর অনুপস্থিতিতেও তাঁর ছায়া গোটা দেশকে জাগিয়ে তুলেছিল।
আর এই কারণেই স্বাধীন ভারতের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় “নেতাজী-ভয়”—এটা এমন এক ভয়, যা আজও ক্ষমতাসীনদের তাড়া করে ফেরে।