## নেতাজীর দূরদর্শী ভাবনা বনাম গান্ধীর অবস্থান:
### ১. হরিপুরার অগ্নিবাণী—
১৯৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি। গুজরাটের হরিপুরা গ্রামে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশন। সভাপতি নির্বাচিত হলেন মাত্র চল্লিশের কোঠায় পৌঁছনো এক তরুণ নেতা—সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি তখন অসুস্থ শরীর, কিন্তু তেজস্বী মনোবল নিয়ে মঞ্চে দাঁড়ালেন। তাঁর উপস্থিতি বিদ্যুতের মতো উত্তেজনা ছড়াল।
সভায় দাঁড়িয়ে তিনি প্রথমেই বললেন:
**“I am deeply sensitive to the honour you have done me by electing me as the President of the Indian National Congress for the coming year. I am not so presumptuous as to think for one moment that I am in any way worthy of that great honour.”** (আপনারা আমাকে আসন্ন বছরের জন্য ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করে যে অমূল্য সম্মান দিয়েছেন, তার প্রতি আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমি কখনও ভাবিনি, এত বড় দায়িত্ব ও সম্মানের যোগ্য আমি হতে পারি।)
এই বিনম্র কথার আড়ালেই লুকিয়ে ছিল এক আগ্নেয়গিরির অগ্নিশিখা। তিনি জানতেন— ভারতের সামনে এখন যে লড়াই, তা কেবল ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য নয়। স্বাধীনতার পরে এক নতুন রাষ্ট্র গড়ার জন্যও প্রস্তুত হতে হবে।
### ২. স্বাধীন ভারতের জন্য নেতাজীর স্বপ্ন—
হরিপুরার সেই ভাষণ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে এক সোনালী অধ্যায়। সেখানে সুভাষচন্দ্র বসু প্রথমবার জাতিকে জানালেন, তাঁর চোখে স্বাধীন ভারতের রূপরেখা কেমনতর হবে।
তিনি বললেন:
**“The very first thing which our future National Government will have to do would be to set up a Commission for drawing up a comprehensive plan of reconstruction.”** (আমাদের ভবিষ্যৎ জাতীয় সরকারকে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে, তা হলো—পুনর্গঠনের জন্য একটি সর্বাঙ্গীন পরিকল্পনা প্রণয়নের কমিশন গঠন করা।)
অর্থাৎ তিনি স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই ভবিষ্যৎ ভারতের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের রূপরেখা তৈরি করে রেখেছিলেন। তিনি জানতেন, কেবল পতাকা ওড়ানো যথেষ্ট নয়; স্বাধীনতা অর্থবহ হবে তখনই, যখন জনগণ ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও শোষণ থেকে মুক্তি পাবে।
### ৩. অর্থনীতি ও দারিদ্র্য দূরীকরণের পরিকল্পনা—
সুভাষ স্পষ্ট করে বলেছিলেন:
**“Our principal problem will be how to eradicate poverty from our country. That will require a radical reform of our land system, including the abolition of landlordism.”** (আমাদের প্রধান সমস্যা হবে কীভাবে দারিদ্র্য দূর করা যায়। এর জন্য ভূমি ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার করতে হবে, জমিদারি প্রথা বিলোপ করতে হবে।)
একটি দারিদ্র্যপীড়িত, কৃষিনির্ভর দেশে এ বক্তব্য ছিল অকল্পনীয় সাহসী। জমিদারি বিলোপের ডাক দেওয়া মানে ছিল বড় জমিদার শ্রেণির স্বার্থে সরাসরি আঘাত হানা। কিন্তু সুভাষ নির্ভয়ে বলেছিলেন—অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন।
তিনি জানতেন, ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে স্বাধীনতা কেবল কাগুজে কথা। তাই তিনি দারিদ্র্যকে স্বাধীন ভারতের প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
### ৪. শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণ—
সুভাষ বিশ্বাস করতেন, ভারতকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার একমাত্র পথ হলো শিল্পায়ন।
তিনি বলেছিলেন, চরকা দিয়ে কেবল প্রতীকী শক্তি জোগানো যায়, কিন্তু কোটি কোটি বেকার যুবককে রুটি দেওয়া যায় না।
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল—
- ভারতে ভারী শিল্প গড়ে তোলা।
- ইস্পাত, কয়লা, বিদ্যুৎ, যন্ত্রশিল্প—এগুলোকে রাষ্ট্রের অধীনে এনে পরিকল্পিত উন্নয়ন ঘটানো।
- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে রাষ্ট্রশক্তির কেন্দ্রে রাখা।
আজ আমরা যখন ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কথা বলি, তখন ভুলে যাই—এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
### ৫. শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার—
তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে শিক্ষিত ও আধুনিক তরুণ প্রজন্মের ওপর।
- তিনি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন।
- তিনি নারী সমাজকে ক্ষমতায়নের পক্ষে ছিলেন।
- সমাজ থেকে কুসংস্কার ও বৈষম্য দূর করার জন্য শিক্ষা ছিল তাঁর প্রধান হাতিয়ার।
এমনকি তিনি চেয়েছিলেন ভারতের যুবসমাজকে সামরিক শৃঙ্খলা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার সমন্বয়ে গড়ে তুলতে।
### ৬. সামরিক শক্তি গড়ে তোলার ডাক—
সুভাষ জানতেন, শুধু রাজনীতি নয়, শক্তি ছাড়া স্বাধীনতা টেকসই হয় না। তাই তিনি বলেছিলেন— ভারতের স্বাধীনতার পর অবিলম্বে আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বিশ্বাস করতেন,
**“Ours is a vast country with a population of 350 million… It is today a source of strength if we can only stand united and boldly face our rulers.”** (আমাদের দেশ বিশাল—জনসংখ্যা প্রায় ৩৫ কোটিরও বেশি। এ পর্যন্ত এই বিশালত্ব আমাদের দুর্বলতার কারণ ছিল। আজ এটি শক্তিতে পরিণত হতে পারে, যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হই এবং সাহসের সঙ্গে শাসকদের সামনে দাঁড়াই।)
তাঁর চোখে স্বাধীন ভারত ছিল এক আত্মনির্ভর, সামরিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র।
### ৭. হিন্দু–মুসলমান ঐক্যের স্বপ্ন—
সুভাষচন্দ্র বসুর অন্যতম বড় ভিশন ছিল ভারতের হিন্দু–মুসলমান ঐক্য। তিনি জানতেন, ব্রিটিশরা *Divide and Rule* নীতি মেনে চলবে, আর কংগ্রেস যদি দুর্বল হয়, তবে এই ষড়যন্ত্র সফল হবে।
তিনি বলেছিলেন:
“Independence is not for the Hindus, not for the Muslims, but for every son and daughter of Mother India.” (স্বাধীনতা হিন্দুদের জন্য নয়, মুসলমানদের জন্য নয়—এটা ভারত মাতার প্রতিটি সন্তান–সন্ততির জন্য।)
- আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি হিন্দু, মুসলমান, শিখ সবাইকে এক পতাকার নিচে এনেছিলেন।
- INA-র যুদ্ধস্লোগান *“Jai Hind”* ধর্মনিরপেক্ষ এক জাতীয় আহ্বান হয়ে উঠেছিল।
- তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস থাকলে ব্রিটিশদের বিভেদের রাজনীতি ভেস্তে যেত।
দেশভাগের সময় গান্ধী বলেছিলেন, *“আমাকে দ্বিখণ্ডিত না করে দেশভাগ করা যাবে না।”* কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশভাগ হলো।
কিন্তু যদি সুভাষ থাকতেন, তিনি কখনোই তা হতে দিতেন না। তাঁর কাছে ভারতের ঐক্য ছিল স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় শর্ত।
### ৮. গান্ধীর অবস্থান ও হিংসা—
কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর ভাবনা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি চাইছিলেন গ্রামভিত্তিক স্বরাজ, খাদি, চরকা, অহিংসা।
তিনি বিশ্বাস করতেন—শিল্পায়ন পশ্চিমা সভ্যতার অনুকরণ। তাঁর কাছে সামরিক প্রস্তুতি মানে ছিল নৈতিক অবক্ষয়।
কিন্তু সুভাষের বজ্রদৃঢ় নেতৃত্ব, তাঁর অসীম জনপ্রিয়তা, তাঁর দূরদর্শী ভিশন—এসব গান্ধীর কাছে এক অদৃশ্য আতঙ্ক তৈরি করেছিল।
তিনি হয়তো বুঝেছিলেন, যদি সুভাষ কংগ্রেসে নেতৃত্ব ধরে রাখেন, তবে একদিন কংগ্রেসের লাগাম তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে যাবে।
ফলে হরিপুরার পর থেকেই শুরু হলো গান্ধীর কৌশল—সুভাষকে একঘরে করা। তথাকথিত অহিংসার পূজারী মহাত্মা গান্ধীর মনে নেতাজীর প্রতি কেন যে এত হিংসা ছিল, সেটা হয়তো তিনিই ভালো করে বলতে পারতেন।
### ৯. ত্রিপুরী কংগ্রেস: সংঘাতের বিস্ফোরণ—
১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী কংগ্রেসে এ সংঘাত প্রকাশ্যে রূপ নিল। গান্ধী নিজে ঘোষণা করলেন: “আমার প্রার্থী পট্টাভি সীতারামাইয়া।”
কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসু জিতে গেলেন।
ফলাফলের পর গান্ধী মন্তব্য করলেন:
**“সীতারামাইয়ার পরাজয় মানে আমার পরাজয়।”**
এই বাক্যের অভিঘাতে গান্ধীপন্থী ওয়ার্কিং কমিটির প্রায় সবাই পদত্যাগ করলেন। সভাপতি হয়েও সুভাষ একা হয়ে গেলেন।
এটাই ছিল সেই মুহূর্ত, যখন কংগ্রেসের ভেতরে সুভাষকে হটিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র পাকাপাকি হয়ে গেল।
### ১০. সংবাদপত্রের প্রতিক্রিয়া—
নেতাজীর হরিপুরার ভাষণ শুধু কংগ্রেস কর্মীদেরই নয়, তৎকালীন সংবাদপত্রগুলিকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল।
- *The Statesman* লিখেছিল: “সুভাষ বসুর বক্তৃতা ভারতীয় যুবসমাজকে নতুন আশা দেখিয়েছে।”
- *Amrita Bazar Patrika* মন্তব্য করেছিল: *“This is not a speech, this is a roadmap for a new India.”* (এটা কেবল বক্তৃতা নয়, এটা নতুন ভারতের রোডম্যাপ।)
যদি আমরা চোখ বন্ধ করে সেই মুহূর্তকে কল্পনা করি, মনে হয় যেন নেতাজী আজও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, বলছেন—“রাজনৈতিক স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিই হবে আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।”
কিন্তু তাঁর এই অদ্বিতীয় দূরদর্শিতা কংগ্রেস নেতৃত্বকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। কারণ তাঁরা জানতেন—যদি সুভাষ এগিয়ে যান, তবে গান্ধীর অহিংসার কাহিনী, নেহেরুর এলিটিস্ট রাজনীতি—সব ভেস্তে যাবে।
তাই ইতিহাসের সবচেয়ে যোগ্য নেতাকে sidelining করার সেই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র শুরু হলো।
হরিপুরার সেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে সুভাষচন্দ্র বসু যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা আজও আমাদের রক্তে আগুন ধরায়। তিনি কেবল স্বাধীনতার কথা বলেননি; তিনি বলেছেন দারিদ্র্য দূর করার, শিল্পায়নের, আধুনিক সেনা গড়ার, শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার, হিন্দু–মুসলমানের ঐক্য অটুট রাখার কথা।
কিন্তু সেই বজ্রদৃঢ় স্বপ্ন কংগ্রেস নেতৃত্বকে আতঙ্কিত করেছিল। কারণ তাঁর উপস্থিতির মানে ছিল এক নতুন ভারত—যেখানে অহিংসার একচেটিয়া কাহিনী টিকে থাকতে পারত না।
আজও আমরা তাঁর অভাববোধে কাঁদি। ভাবি, যদি নেতাজী থাকতেন, তবে ভারত আজ অন্যরকম হতো—এক শক্তিশালী, আত্মনির্ভর, ঐক্যবদ্ধ ভারত।
আর এই কারণেই আজও শাসকেরা ভয় পায় তাঁর নাম, তাঁর ছায়া, তাঁর স্বপ্নকে।
কারণ নেতাজী মানেই সত্য, নেতাজী মানেই ভবিষ্যৎ।