### গান্ধীজীর দ্বিধা ও আত্মসমর্পণ :
ভারতের স্বাধীনতার আগে-পরে দেশভাগের প্রশ্নে মহাত্মা গান্ধীর অবস্থান ছিল অত্যন্ত দ্বিধাগ্রস্ত।
তিনি স্পষ্ট বলেছিলেন—
**“Partition of India will come only over my dead body.”**
(ভারত ভাগ হবে শুধু আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে।)
এই উক্তি কোটি কোটি ভারতীয়ের মনে আশা জাগিয়েছিল যে— দেশভাগ কোনোদিন ঘটবে না। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছিল ঠিক এর উল্টো।
১৯৪৬–৪৭ সালের দাঙ্গা, হিন্দু–মুসলমান সংঘর্ষ, ব্রিটিশদের চাপ, আর কংগ্রেস নেতৃত্বের তাড়াহুড়ো— সব মিলিয়ে গান্ধীজী নীরব হয়ে গেলেন।
- তিনি দেশভাগ থামানোর জন্য কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিলেন না।
- ব্রিটিশ ও কংগ্রেস নেতৃত্বের পরিকল্পনার বিরুদ্ধেও দাঁড়ালেন না।
- শেষ পর্যন্ত তিনি দেশভাগকে মেনে নিলেন— যা তাঁর নিজের ঘোষণার সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীত।
#### কেন এই আত্মসমর্পণ ?
এখানে কয়েকটি কারণ কাজ করেছিল:
1. **কংগ্রেস নেতৃত্বের চাপ** — নেহেরু ও প্যাটেল দেশভাগ মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন।
2. **দাঙ্গার ভয়** — গান্ধীজী মনে করেছিলেন, যদি দেশভাগ না হয়, তবে আরও রক্তপাত বাড়বে।
3. **ব্রিটিশদের তাড়াহুড়ো** — ১৯৪৮ নয়, ১৯৪৭-এর মধ্যেই ক্ষমতা ছাড়তে হবে বলে চাপ আসছিল।
এই সব কারণে গান্ধীজী তাঁর নিজের অবস্থান থেকে সরে গেলেন।
#### ইতিহাসের ব্যথা ট্র্যাজেডি:
এটা ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
যে গান্ধী বলেছিলেন—*“আমাকে দ্বিখণ্ডিত না করে দেশভাগ হবে না,”*
তিনি-ই শেষ পর্যন্ত দেশের দ্বিখণ্ডনের সাক্ষী হলেন।
ফলাফল—
- লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হলো।
- কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হলো।
- হিন্দু, মুসলমান, শিখ— সব সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসলো চরম অমানবিক এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকা।
#### নেতাজী থাকলে ?
এখানেই আসে বড় প্রশ্ন— যদি নেতাজী থাকতেন ?
তিনি কখনোই দেশভাগ হতে দিতেন না।
কারণ তাঁর কাছে স্বাধীনতার মানে ছিল অখণ্ড ভারত।
তিনি যেমন INA-তে হিন্দু–মুসলমান–শিখ সবাইকে এক পতাকার নিচে এনেছিলেন, তেমনই তিনি ব্রিটিশের *Divide and Rule* পলিসিকেও গুঁড়িয়ে দিতে পারতেন।
তাহলে ভারতের ইতিহাস হতো অন্য রকম—
দেশভাগের দুঃখ গাঁথা লিখতে হতো না।
গান্ধীজীর দ্বিধা থেকে আত্মসমর্পণ ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিল।
স্বাধীনতা এলো, কিন্তু সেই স্বাধীনতার প্রথম উপহার হলো দেশভাগ।
এই ট্র্যাজেডির আড়ালেও লুকিয়ে আছে সেই একই প্রশ্ন—
**যদি নেতাজী ফিরে আসতেন ?**
তাহলে দেশভাগের এই ভয়াবহ অধ্যায় কখনোই লেখা হতো না।
এবং এটাই কংগ্রেস নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল—
**নেতাজী মানেই অখণ্ড ভারত।**
### ভয়ের প্রকৃত শিকড় :
এখন প্রশ্ন— কেন নেহেরু, গান্ধী বা কংগ্রেস নেতৃত্ব এত আতঙ্কিত ছিল ?
কেন তারা এমন সব সিদ্ধান্ত নিল, যেগুলো ভারতের ভবিষ্যৎকে রক্তে রাঙিয়ে দিল ?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে একটাই জায়গায়—
**নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন।**
#### INA ও নৌসেনা বিদ্রোহের শিক্ষা:
INA ট্রায়াল আর ১৯৪৬ সালের নৌসেনা বিদ্রোহ প্রমাণ করেছিল—
ভারতের স্বাধীনতা শুধুই অহিংস আন্দোলনের ফল নয়।
সশস্ত্র বিপ্লবও ছিল প্রকৃত চালিকাশক্তি।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি পর্যন্ত স্বীকার করেছিলেন—
**“It was the INA and the naval mutiny that forced us to quit India. Gandhi’s role was minimal.”**
(ভারত ছাড়তে আমাদের বাধ্য করেছিল INA আর নৌসেনা বিদ্রোহ। গান্ধীর ভূমিকা ছিল খুবই সামান্য।)
এমন স্বীকারোক্তি কংগ্রেস নেতৃত্বকে ভয় পাইয়ে দিল।
কারণ যদি সত্য প্রকাশ পায়, তবে স্বাধীনতার কৃতিত্ব আর তাদের হাতে থাকবে না।
#### নেহেরুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নাটক:
১৯৪৬ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচনও সেই ভয়েরই ফসল।
সবার সমর্থন প্যাটেলের দিকে থাকলেও গান্ধী চাপিয়ে দিলেন নেহেরুকে।
কারণ নেহেরুই ছিলেন সেই নেতা, যিনি নেতাজীর বিপরীতে দাঁড়াতে পারবেন।
প্যাটেল থাকলে হয়তো নেতাজীর জন্য জায়গা তৈরি হতো, কিন্তু নেহেরুর হাতে ক্ষমতা মানেই— সব দরজা বন্ধ।
#### দেশভাগের তাড়াহুড়ো:
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ঘোষণা করল— আগস্টের মধ্যেই তারা চলে যাবে।
১৯৪৮ নয়, ১৯৪৭– এই তাড়াহুড়োর কারণও ছিল নেতাজীর ভয়।
যদি তিনি ফিরে আসেন, তবে দেশভাগ সম্ভব হবে না।
তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশ দ্বিখণ্ডিত করা হলো।
চট্টগ্রাম–সিলেটের মতো হিন্দু–বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাও পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া হলো।
এটা ছিল এক প্রকার রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ।
গান্ধীজী নিজে বলেছিলেন—*“আমাকে দ্বিখণ্ডিত না করে দেশভাগ হবে না।”*
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি চুপচাপ দেশভাগ মেনে নিলেন।
এটা ছিল তাঁর নিজের কথার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
কেন ?
কারণ কংগ্রেস নেতৃত্ব জানত— নেতাজী ফিরে এলে দেশভাগ রুখে দেবেন।
তাই তাঁরা দ্রুত দেশভাগ ঘটিয়ে দিলেন, যেন নেতাজীর জন্য পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।
#### স্বাধীনতা না ক্ষমতা হস্তান্তর ?
সবচেয়ে বড় সত্য হলো— ভারত ১৯৪৭ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে *Indian Independence Act* পাস করে কেবল “ক্ষমতা হস্তান্তর” করা হলো।
ভারত ১৯৫০ পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মানল, পরে কমনওয়েলথের সদস্য হলো।
এ সবকিছুই নেতাজীর দর্শনের বিপরীত।
কারণ তিনি বলেছিলেন—
**“Freedom is not given, it is taken.”**
(স্বাধীনতা দেওয়া হয় না, সেটা ছিনিয়ে নিতে হয়।)
কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা পেল না, বরং ভিক্ষার মতো ক্ষমতা হস্তান্তরকে মেনে নিল।
সব মিলিয়ে দেখা যায়—
- INA ট্রায়াল,
- নৌসেনা বিদ্রোহ,
- কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচন,
- দেশভাগের তাড়াহুড়ো,
- গান্ধীর আত্মসমর্পণ,
- আর ক্ষমতা হস্তান্তরের নাটক—
সবকিছুর আড়ালে কাজ করছিল একটাই ভয়—
**যদি নেতাজী ফিরে আসেন।**
কারণ নেতাজী মানেই অখণ্ড ভারত, নেতাজী মানেই সশস্ত্র বিপ্লব, নেতাজী মানেই প্রকৃত স্বাধীনতা।
আর এই সত্য প্রকাশ পেলে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হতো।
তাই কংগ্রেস নেতৃত্ব থেকে ব্রিটিশ শাসক— সবাই মিলে নেতাজীর ছায়াকে ভয় পেয়েছিল।
এই ভয়ই স্বাধীন ভারতের জন্মলগ্নকে রক্তাক্ত ও অসম্পূর্ণ করে তুলেছিল।