নেহেরুর মৃত্যুর সময় ছায়ামূর্তি: “নেতাজী ফিরে আসবেন”—
এই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে তুলল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।
**২৭ মে ১৯৬৪।**
দিল্লির তিনমূর্তি ভবন।
জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুতে দেশ শোকস্তব্ধ।
রাষ্ট্রপ্রধান, বিদেশি অতিথি, সাধারণ মানুষ—সবাই তখন শোকযাত্রায়।
কিন্তু ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ নজর কেড়ে নিলেন এক দীর্ঘকায় পুরুষ।
মাথার উপরের অংশে টাক, সাদা দাড়ি-গোঁফ, চোখে মোটা চশমা।
কিন্তু সেই চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—যা যেন আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
কিছু মানুষ থমকে গিয়েছিলেন।
ফিসফিস করে বলেছিলেন—
**“লোকটা তো হুবহু নেতাজীর মতো।”**
তিনি ভিড়ের মধ্যেই ছিলেন, আবার মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
কেউ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না।
অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষ তাঁদের গবেষণায় এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন *“off-the-record witness account”* হিসেবে।
প্রমাণ নেই, ছবি নেই।
কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের একাধিক একই ধরনের বর্ণনা এটিকে নিছক কাকতালীয় ঘটনা হতে দেয় না।
তাহলে কি সত্যিই নেতাজী ছিলেন নেহেরুর অন্ত্যেষ্টির সময় দিল্লিতে?
যদি তাই হয়, তবে এটি কি নিছক প্রতীকী উপস্থিতি,
না কি এক গভীর বার্তা—
**“যার ভয়ে আমাকে ইতিহাস থেকে সরানো হয়েছিল, আজ তিনি আর নেই।”**
বাংলার মাটিতও তাঁর ছায়া: নামহীন সেই গুমনামী সাধুর রহস্য শুধু উত্তর ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেক গবেষণা ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যে উঠে এসেছে—
তিনি একাধিকবার গোপনে বাংলার বিভিন্ন জায়গাতেও গিয়েছিলেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো **চন্দননগরের প্রবর্তক আশ্রম**।
স্থানীয়দের মতে, ১৯৬০–৭০ এর দশকে প্রবর্তক আশ্রমে এক অচেনা সাধুর আসা–যাওয়া ছিল।
তিনি কখনও সাধারণ সাধুবাবার বেশে, কখনও মুসলমান ফকির সেজে প্রবেশ করতেন।
আশ্রমের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট কক্ষে তাঁর গোপন অবস্থান ছিল বলে জানা যায়।
কিছু প্রবীণ সন্ন্যাসী ও স্থানীয় মানুষ পরে শপথ করে বলেছিলেন—
যাঁকে তাঁরা দেখেছিলেন, তাঁর রূপ গুমনামী বাবার সঙ্গে হুবহু মিলে যেত।
সাদা দাড়ি, টাক মাথা আড়াল করার চেষ্টা, চশমার ফাঁক দিয়ে ঝলসে ওঠা সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—
যা তাঁরা নেতাজীর চোখ ছাড়া আর কারও চোখে দেখেননি।
আশ্রমের পরিবেশে এই মানুষটির আবির্ভাব সর্বদা রহস্যময় ছিল।
তিনি কখনও প্রকাশ্যে আসতেন না, বিশিষ্ট কিছু প্রবীণ ব্যক্তি ছাড়া নতুন ভক্তদের সঙ্গে তেমন একটা কথাও বলতে চাইতেন না।
যাঁরা ভাগ্যক্রমে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন,
তাঁরা বলতেন— তাঁর গলার স্বর, ভঙ্গি আর চিন্তাধারা সবকিছুতেই লুকিয়ে ছিল **অন্য এক মহাপুরুষের ছায়া।**
চন্দননগরের এই প্রবর্তক আশ্রমের সূত্র ধরেই
অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন—
গুমনামী বাবা শুধু নৈমিষারণ্য, বস্তি, প্রভৃতি স্থানেই আবদ্ধ ছিলেন না, বরং বাংলার মাটিতেও তাঁর উপস্থিতি ছিল।
প্রশ্নটা তাই আবার সামনে আসে—
তিনি যদি নিছকই একজন সাধু হন,
তাহলে কেন গোপনে, ছদ্মবেশে বাংলায় যাতায়াত করতেন?
আশ্রমে একান্তে কী আলোচনা হতো,
কাদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটত,
সেসবের কোনো উত্তর আজও সরকারি নথিতে নেই।
কিন্তু জনশ্রুতি ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বলছে—
**“তিনি বাংলায় এসেছিলেন।
তিনি বেঁচে ছিলেন।
তিনি আমাদের মাঝেই ছিলেন।”**
ফৈজাবাদের রাম ভবনে: ১৯৮০–এর দশকের গোড়ার দিকে ফৈজাবাদের মানুষ হঠাৎই টের পেলেন—
তাদের শহরে এক অদ্ভুত সাধুর আবির্ভাব ঘটেছে।
তিনি কোথা থেকে এলেন, কীভাবে এলেন—
কেউ জানল না, কেউ জানতেও পারল না।
লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম—
**“গুমনামী বাবা।”**
কেউ কেউ বলতেন— **ভগবানজী**।
শহরের প্রান্তে এক অচেনা বাড়ি, যা ‘রাম ভবন’ নামে পরিচিত, সেইখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করলেন তিনি।
কিন্তু তাঁর জীবনযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা—
ঘরের যেখানটায় তিনি বসতেন, তার সম্মুখভাগে সবসময়ই টাঙানো থাকত একটা পর্দা। তিনি কারও সামনে আসতেন না। সাধু ছিলেন বটে, কিন্তু কোনও শিষ্য-চেলা বা সাধারণ ভক্তমণ্ডলী গড়ে তুললেন না।
যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছানোর সৌভাগ্য পেয়েছিলেন,
তাঁদের প্রত্যেকেই বলেছিলেন—
তিনি ছিলেন অন্যরকম।
তাঁর কথাবার্তা, জ্ঞানের গভীরতা,
দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর দখল,
সবই যেন এক অতীত-চেনা মানুষের ছায়াকে মনে করিয়ে দিত।
দিন যত গড়াতে লাগল,
রাম ভবন যেন রূপ নিল এক গোপন দুর্গে।
বাইরে থেকে তিনি সন্ন্যাসীর মতো,
কিন্তু ভেতরে—
কাগজপত্র, বই, চিঠি, দলিল,
যেন সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছিল—
এ সাধু কেবল সাধু নন,
তিনি এমন এক মানুষ,
যাঁকে গোটা দেশ আজও খুঁজে ফিরছে।
ফৈজাবাদবাসীর কাছে তখন থেকে শুরু হলো
এক দীর্ঘ গুঞ্জনের ইতিহাস—
**“গুমনামী বাবা আর কেউ নন,
তিনি আসলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।”**
রাম ভবনের অদৃশ্য দরবার: ফৈজাবাদের রাম ভবন। বাইরে থেকে দেখতে সাদামাটা একটা পুরনো বাড়ি।
কিন্তু এর ভেতরে লুকিয়ে ছিল এমন এক রহস্য, যা আজও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসকে কাঁপিয়ে দেয়।
এই বাড়ির ভেতরে থাকতেন এক অজ্ঞাত সাধু—যিনি নিজের পরিচয় গোপন রাখতেন, সর্বদা পর্দার আড়ালে থাকতেন।
লোকেরা তাঁকে ডাকত—**“গুমনামী বাবা।”**
অনেকে আবার ডাকতো— “ভগবানজী” বলে ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—
একজন নিছক সাধুর ঘরে কেন আসতে শুরু করল আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রাক্তন সৈনিকেরা?
কেন সেখানে গোপনে ঢুকতে লাগলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত?
এগুলো কি কেবল কাকতালীয়, নাকি এর আড়ালে ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কোনো গোপন অধ্যায়?
যাঁরা একসময় নেতাজীর ডাক শুনে রক্ত উজাড় করে লড়েছিলেন,
সেই **আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকেরা** কি করে এক সাধারণ সাধুর বাড়িতে গোপনে আসতেন?
কিন্তু রাম ভবনের দিনলিপি অন্য কিছু বলে।
প্রমাণ মেলে, বিশিষ্ট সৈনিক **পবিত্র মোহন সরকার** নিয়মিত যেতেন গুমনামী বাবার কাছে।
তিনি কেবল দর্শনার্থী ছিলেন না—ছিলেন ঘনিষ্ঠ শ্রোতা, যিনি সেই অদৃশ্য মানুষটির উপদেশ, পরামর্শ আর স্মৃতিচারণ শুনতেন।
শুধু তিনিই নন, আরও বহু প্রাক্তন INA যোদ্ধা রাম ভবনের গোপন দরজায় গিয়ে নক করেছেন।
কেন?
কারণ তাঁদের মনে অটল বিশ্বাস ছিল—
**যিনি ভেতরে বসে আছেন, তিনিই তাঁদের অধিনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।**
স্বাধীনতা সংগ্রামী লীলা রায়ের সাক্ষাৎ: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে **লীলা রায়** এক উজ্জ্বল নাম।
সাহসিনী, বিপ্লবী, নারীমুক্তির অগ্রদূত—তিনি ছিলেন নেতাজীর একনিষ্ঠ সহযাত্রী।
প্রমাণ আছে, তিনিও গিয়েছিলেন গুমনামী বাবার সঙ্গে দেখা করতে।
প্রশ্ন হলো—
লীলা রায়ের মতো মানুষ, যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে,
তিনি কেন একজন অচেনা সাধুর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন?
উত্তর একটাই—
তিনি জানতেন, সেই সাধু আসলে সাধু নন।
তিনি ছিলেন সেই পুরনো বন্ধু, সেই বিপ্লবী সেনাপতি—**নেতাজী**।
রাম ভবনে প্রতিবছর দুটো উৎসব বিশেষভাবে পালিত হতো—
**২৩ জানুয়ারি (নেতাজীর জন্মদিন)** এবং **দুর্গাপূজা**।
এই দিনে বাড়িতে আসতেন অনেক মানুষ।
তাঁরা খাবার নিয়ে যেতেন, জিনিসপত্র নিয়ে যেতেন, আর ভেতরে বসা মানুষটির জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ধরনের সরঞ্জাম জোগান দিতেন।
একজন সাধুর জন্মদিন এত জমকালোভাবে পালিত হয়?
না।
এই দিনগুলোতে সবাই বুঝতেন—এটা সাধুর জন্মদিন নয়, এটা **নেতাজীর জন্মদিন**।
মুখ্যমন্ত্রীর গোপন সাক্ষাৎ: গবেষণার সূত্রে জানা যায়, উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী **হেমবতী নন্দন বহুগুণা** গোপনে রাম ভবনে এসেছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে গুমনামী বাবার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন।
কেন একজন মুখ্যমন্ত্রী গোপনে কোনও সাধুর কাছে যাবেন?
তাও আবার সরকারি রেকর্ডে একটিও লাইন উল্লেখ নেই।
কারণ যদি এটা প্রকাশ পেত, তবে রাজনৈতিক ভূমিকম্প শুরু হতো।
প্রণব মুখার্জির মন্তব্য: একই ধরনের আরেকটি ঘটনা শোনা যায়।
পরবর্তী সময়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়া **ড. প্রণব মুখার্জি** একবার গিয়ে দেখা করেছিলেন গুমনামী বাবার সঙ্গে।
বেরিয়ে এসে তিনি শুধু বলেছিলেন—
**“This man is extraordinary.”**
প্রশ্ন রয়ে গেল—
একজন রাষ্ট্রনায়ক, কূটনীতিতে পারদর্শী মানুষ, যিনি অসংখ্য বিশ্বনেতার সঙ্গে আলাপ করেছেন,
তিনি কেন একজন সাধারণ সাধুকে দেখে এমন মন্তব্য করবেন?
এমন বিস্ময় তাঁর মধ্যে জাগল কেন?
উত্তর—কারণ তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন এক **অদৃশ্য ইতিহাসের ছায়ার।**
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য: শুধু রাজনীতিক নন, সাধারণ প্রত্যক্ষদর্শীরাও তাঁদের সাক্ষ্য রেখেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামী **দুর্গাপ্রসাদ পান্ডে** ও **শ্রীকান্ত শর্মা** স্পষ্ট বলেছেন—
তাঁরা যখন গুমনামী বাবার কণ্ঠ শুনেছিলেন,
যখন তাঁর চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখেছিলেন,
তখন মনে হয়েছিল—
**“এই মানুষটি আর কেউ নন, তিনি নেতাজী।”**
প্রশাসনিক নীরবতা: গুমনামী বাবা যেখানেই থাকুন না কেন—নৈমিষারণ্য, বস্তি, কিংবা ফৈজাবাদের রাম ভবন—
তাঁকে কখনও প্রশাসনিক বাধার মুখে পড়তে হয়নি।
না কোনও পুলিশি জেরা, না কোনও তল্লাশি।
কেন?
একজন অচেনা সাধু যদি এভাবে বারবার জায়গা পরিবর্তন করে থাকেন, তবে প্রশাসন নিশ্চয়ই সন্দেহ করত।
কিন্তু এখানে তার উল্টোটা ঘটেছে।
এতে মনে হয়—ভারত সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে **অলিখিত বোঝাপড়া** ছিল।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো—
এইসব সাক্ষাৎ, এইসব প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, এইসব প্রমাণের টুকরো—সবই আছে,
কিন্তু সরকারি নথিতে নেই এর একটিও উল্লেখ।
কেন?
যদি সত্যিই তিনি কেবল একজন সাধু হতেন,
তবে এসব সাক্ষাৎ প্রকাশ করতে সরকার এত ভয় পেত কেন?
কেন সবকিছু লুকোনো হলো?
উত্তর—
কারণ সত্য প্রকাশ পেলে ভারতের ইতিহাস আবার নতুন করে লিখতে হতো।
রাম ভবনের গোপন সাক্ষাৎকারগুলো একটা বড় প্রশ্ন তোলে—
একজন সাধুর কাছে কেন আসবেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকেরা?
কেন আসবেন লীলা রায়ের মতো বিপ্লবীরা?
কেন আসবেন মুখ্যমন্ত্রী বা প্রণব মুখার্জির মতো নেতারা?
আর কেন সরকার চুপ থাকবে, কোনও রেকর্ড রাখবে না?
সব মিলিয়ে একটাই উত্তর—
**তিনি সাধু ছিলেন না। তিনি ছিলেন অদৃশ্য নেতাজী।**
পর্দার আড়ালে বসে থেকেও তিনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছিলেন,
নিজের পুরনো সৈনিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন,
নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এক অদৃশ্য দরবারে।
আজও ফৈজাবাদের মানুষ বলেন—
রাম ভবনের দেয়ালে যেন সেই ফিসফিসানি শোনা যায়।
চোখের আড়ালে থেকেও তিনি উপস্থিত ছিলেন,
মুখ না দেখিয়েও তিনি সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন—
**“আমি আছি। আমি তোমাদের ছেড়ে যাইনি।”**
গোপন সাক্ষাৎকারের এই কাহিনীগুলোই প্রমাণ করে—
নেতাজীর ছায়া শুধু অতীতেই সীমাবদ্ধ ছিল না,
স্বাধীন ভারতের রাজনীতির বুকের ভেতরেও তিনি এক অদৃশ্য শিখার মতো জ্বলতে থেকেছেন।
আর সেই আগুনের ভয়েই শাসকরা আজও তাঁর আসল সত্য প্রকাশ করতে ভয় পায়।