Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

এখনও নেতাজীকে কেন এত ভয় ? - 7

## **ভারতে ফিরে আসার নিরব পদচিহ্ন** 


সুভাষচন্দ্র বসু—যাঁকে আমরা নেতাজী নামে চিনি—তাঁর জীবনটাই ছিল এক ত্যাগের মহাকাব্য।  
ক্ষমতা, পদ বা ব্যক্তিগত সম্মান—এগুলোর প্রতি তাঁর কোনও আকর্ষণ ছিল না।  
তিনি সবসময়ই বলতেন, **“আমার জীবন-মৃত্যু, সবই মাতৃভূমির জন্য।”**  

কিন্তু ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা তাঁকে শান্তি দেয়নি।  
কারণ এই স্বাধীনতা ছিল আসলে ব্রিটিশদের এক সাজানো নাটক—  
ক্ষমতা হস্তান্তরের আড়ালে দেশকে দ্বিখণ্ডিত করা,  
সিলেট–চট্টগ্রামের মতো হিন্দু–বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল ছিঁড়ে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া।  

নেতাজীর হৃদয়ে কেবল একটাই বিশ্বাস কাজ করত—  
**ভারতের মাটিতেই তাঁর শেষ নিঃশ্বাস হবে।**  

তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর দায়িত্ব এখনও শেষ হয়নি।  
দেশ রক্তাক্ত, বিভাজিত, শরণার্থীর হাহাকারে ভারী হয়ে রয়েছে এই দেশের আকাশ বাতাস।  
তাই রাশিয়ার আড়াল থেকে তিনি কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলেন—  
**দেশে ফিরতেই হবে। তবে ভিন্ন পথে।**  


প্রকাশ্যে না আসার কারণ: প্রশ্ন জাগে—  
যদি তিনি দেশে ফিরেই এসেছিলেন, তবে কেন প্রকাশ্যে আসেননি?  

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সামনে আসে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা।  
সদ্য স্বাধীন ভারত তখন অস্থির—  
দেশভাগের ক্ষত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা,  
আর আন্তর্জাতিক চাপ।  

এক মুহূর্ত ভাবুন তো—  
যদি নেতাজী হঠাৎ প্রকাশ্যে চলে আসতেন?  

জনতা তাঁর পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ত।  
কংগ্রেসের সাজানো ইতিহাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।  
আর বিদেশি শক্তি দাবি তুলত—  
**“তাঁকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে হস্তান্তর করো।”**  

এই মানসিক চাপে সদ্য জন্ম নেওয়া ভারত রাষ্ট্রের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো।
নেতাজী সেটা হতে দিতে পারেননি।  
তাই তিনি বেছে নিলেন **আড়ালের পথ।**  

তিনি জানতেন, নীরব থেকেও দেশকে রক্ষা করা যায়। তাঁর নাম উচ্চারিত না হলেও, তাঁর কাজ ইতিহাস বদলাতে পারে।  


স্ট্যালিন–নেহেরু অলিখিত বোঝাপড়ার বিষয়টি যদিও একটি অনুমান নির্ভর থিওরি। তবুও এই বিষয়টিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
গবেষকরা বলেন—  
রাশিয়ায় থাকার সময় নেতাজীর সঙ্গে স্ট্যালিনের যোগাযোগ হয়েছিল।  
স্ট্যালিন ছিলেন একজন চূড়ান্ত কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
তিনি জানতেন, নেতাজীর মতো এমন একজন মহান নেতাকে বন্দি করা মানেই ভবিষ্যতের জন্য হাজারো রকমের বিপদ।  

তাই কি স্ট্যালিন তাঁকে সরাসরি বন্দি করেননি?  
বরং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক অলিখিত বোঝাপড়ায় পৌঁছেছিলেন?  

কিছু সূত্র বলে—  
স্ট্যালিন ও নেহেরুর মধ্যে এক গোপন সমঝোতা হয়েছিল।  
চুক্তি ছিল—  
নেতাজী দেশে ফিরবেন,  
কিন্তু প্রকাশ্যে আসবেন না।  
রাজনীতিতে তাঁর কোনও ভূমিকা থাকবে না।  

কেন?  
কারণ তাঁর প্রকাশ্য প্রত্যাবর্তন মানেই রাজনৈতিক ভূমিকম্প।  
গান্ধী–নেহেরুর একচ্ছত্র কৃতিত্ব ভেঙে পড়ার বিষয়টি ছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়টিও জড়িত ছিল। নেতাজী একজন ঘোষিত যুদ্ধাপরাধী ছিলেন; সুতরাং এই সময়ে তাঁর প্রকাশ্যে আসার কোনো সুযোগ একেবারেই ছিল না। 
যদি তিনি আত্মপ্রকাশ করতেন, দেশের আমজনতা তাঁর পক্ষে রাস্তায় বেরিয়ে আসত অবশ্যই। কিন্তু তাতে কী হতো? যুদ্ধাপরাধীর তালিকা থেকে তাঁর নাম কি বাদ দিয়ে দেওয়া হতো? মোটেও না। কারণ সদ্য স্বাধীন দরিদ্র ভারতের তখন এই ধরনের কোনো কূটনৈতিক গ্রহণযোগ্যতাই ছিল না।
তাই বিভিন্ন দিক বিবেচনা করেই হয়তো নেতাজীর বিষয়ে স্ট্যালিন ও নেহেরুর মধ্যে কোনো একটা যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল।
প্রমাণ নেই, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের টানাপোড়েন বলছে—  
**কিছু তো একটা হয়েছিল।**  


গুমনামী অগ্নিপুরুষ: ১৯৫০-এর দশকের শুরু।  
কোনও বিমানবন্দরের রেকর্ড নেই, কোনও সরকারি কাগজ নেই। তবুও তিনি ফিরে এলেন।  

প্রথমে **নৈমিষারণ্য**,  
তারপর **বস্তি**,  
শেষ পর্যন্ত **ফৈজাবাদ।**  

সব জায়গায় তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত সাধু।  
মুখে নয়, তাঁর সামনে টানা থাকত একটি **পর্দা।**  
কেউ তাঁর মুখ সরাসরি দেখতে পেত না।  
তবুও যাঁরা কাকতালীয়ভাবে দেখেছিলেন,  
তাঁরা স্তব্ধ হয়ে বলেছিলেন—  
**“এই সেই দৃষ্টি, এই সেই কণ্ঠস্বর, এই সেই ভঙ্গি… তিনিই তো নেতাজী।”**  

আরও বিস্ময়কর ব্যাপার—  
তিনি যেখানেই থাকুন না কেন,  
কখনও কোনো রকম প্রশাসনিক ঝামেলায় পড়েননি। কোনও পুলিশি চেকিং, কোনও পরিচয়পত্রের প্রশ্ন ওঠেনি।  

এটা কি নিছকই কাকতালীয়?  
না কি সর্বোচ্চ স্তরে তাঁর জন্য ছিল এক নীরব ছত্রছায়া?  


সুভাষচন্দ্র বসু—নেতাজী।  
যে মানুষ নিজের জীবনের সমস্ত বিলাসিতা, এমনকি ICS-এর মতো সম্মানজনক চাকরি পর্যন্ত ছুঁড়ে ফেলে বলেছিলেন—  
**“আমি দাসত্বের প্রতীক হতে চাই না।”**  

এমন আত্মত্যাগী পুরুষ কি নিছক এক দুর্ঘটনায় বিলীন হতে পারেন?  
দেশবাসীর হৃদয় কখনোই তা মানতে পারেনি।  
তাই স্বাধীনতার পরপরই ভেসে উঠতে শুরু করল গুজব—  
**“তিনি বেঁচে আছেন, তিনি ফিরবেন।”**  

আর সত্যিই তো ফিরেছিলেন—  
কিন্তু অন্য এক রূপে।  

প্রথমে **নৈমিষারণ্য**।  
সেখানে এক অজ্ঞাত সাধুর খবর ছড়াল, যিনি খুব কম মানুষের সঙ্গ নিতেন, সর্বদা থাকতেন রহস্যময় নীরবতায়।  

তারপর **বস্তি**।  
সেখানেও তিনি মুখ ঢেকে রাখতেন, দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা হতো কিন্তু সরাসরি মুখ দেখা প্রায় অসম্ভব ছিল।  
তবুও যাঁরা হঠাৎ মুখোমুখি হয়েছেন, তাঁরা স্তব্ধ হয়ে গেছেন সেই চোখের দৃষ্টি ও কণ্ঠস্বর শুনে। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তিনি বাংলায়ও বহুবার গিয়েছিলেন। হয়তো সেখানে থাকতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই সেটা আর হয়ে ওঠেনি। 
অবশেষে তিনি গিয়ে থিতু হলেন **ফৈজাবাদের রাম ভবনে**।  
সেখান থেকেই শুরু হলো ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় অধ্যায়।  
মানুষ তাঁকে নাম দিল—  
**“গুমনামী বাবা।”**  


নেহেরুর মৃত্যুর সময় ছায়ামূর্তি: “নেতাজী ফিরে আসবেন”— 
এই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে তুলল এক অবিশ্বাস্য ঘটনা।  

**২৭ মে ১৯৬৪।** 
দিল্লির তিনমূর্তি ভবন।  
জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুতে দেশ শোকস্তব্ধ।  
রাষ্ট্রপ্রধান, বিদেশি অতিথি, সাধারণ মানুষ—সবাই তখন শোকযাত্রায়।  

কিন্তু ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ নজর কেড়ে নিলেন এক দীর্ঘকায় পুরুষ।  
মাথার উপরের অংশে টাক, সাদা দাড়ি-গোঁফ, চোখে মোটা চশমা।  
কিন্তু সেই চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—যা যেন আগুন জ্বালিয়ে দেয়।  

কিছু মানুষ থমকে গিয়েছিলেন।  
ফিসফিস করে বলেছিলেন—  
**“লোকটা তো হুবহু নেতাজীর মতো।”**  

তিনি ভিড়ের মধ্যেই ছিলেন, আবার মুহূর্তের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেলেন।  
কেউ এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না।  

অনুজ ধর ও চন্দ্রচূড় ঘোষ তাঁদের গবেষণায় এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন *“off-the-record witness account”* হিসেবে।  
প্রমাণ নেই, ছবি নেই।  
কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের একাধিক একই ধরনের বর্ণনা এটিকে নিছক কাকতালীয় ঘটনা হতে দেয় না।  

তাহলে কি সত্যিই নেতাজী ছিলেন নেহেরুর অন্ত্যেষ্টির সময় দিল্লিতে?  
যদি তাই হয়, তবে এটি কি নিছক প্রতীকী উপস্থিতি,  
না কি এক গভীর বার্তা—  
**“যার ভয়ে আমাকে ইতিহাস থেকে সরানো হয়েছিল, আজ তিনি আর নেই।”**  


বাংলার মাটিতও তাঁর ছায়া: নামহীন সেই গুমনামী সাধুর রহস্য শুধু উত্তর ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। অনেক গবেষণা ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যে উঠে এসেছে—  
তিনি একাধিকবার গোপনে বাংলার বিভিন্ন জায়গাতেও গিয়েছিলেন।  
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো **চন্দননগরের প্রবর্তক আশ্রম**।  

স্থানীয়দের মতে, ১৯৬০–৭০ এর দশকে প্রবর্তক আশ্রমে এক অচেনা সাধুর আসা–যাওয়া ছিল।  
তিনি কখনও সাধারণ সাধুবাবার বেশে, কখনও মুসলমান ফকির সেজে প্রবেশ করতেন।  
আশ্রমের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট কক্ষে তাঁর গোপন অবস্থান ছিল বলে জানা যায়।  

কিছু প্রবীণ সন্ন্যাসী ও স্থানীয় মানুষ পরে শপথ করে বলেছিলেন—  
যাঁকে তাঁরা দেখেছিলেন, তাঁর রূপ গুমনামী বাবার সঙ্গে হুবহু মিলে যেত।  
সাদা দাড়ি, টাক মাথা আড়াল করার চেষ্টা, চশমার ফাঁক দিয়ে ঝলসে ওঠা সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি—  
যা তাঁরা নেতাজীর চোখ ছাড়া আর কারও চোখে দেখেননি।  

আশ্রমের পরিবেশে এই মানুষটির আবির্ভাব সর্বদা রহস্যময় ছিল।  
তিনি কখনও প্রকাশ্যে আসতেন না, বিশিষ্ট কিছু প্রবীণ ব্যক্তি ছাড়া নতুন ভক্তদের সঙ্গে তেমন একটা কথাও বলতে চাইতেন না।  
যাঁরা ভাগ্যক্রমে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন,  
তাঁরা বলতেন— তাঁর গলার স্বর, ভঙ্গি আর চিন্তাধারা সবকিছুতেই লুকিয়ে ছিল **অন্য এক মহাপুরুষের ছায়া।**  

চন্দননগরের এই প্রবর্তক আশ্রমের সূত্র ধরেই  
অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করলেন—  
গুমনামী বাবা শুধু নৈমিষারণ্য, বস্তি, প্রভৃতি স্থানেই আবদ্ধ ছিলেন না, বরং বাংলার মাটিতেও তাঁর উপস্থিতি ছিল।  

প্রশ্নটা তাই আবার সামনে আসে—  
তিনি যদি নিছকই একজন সাধু হন,  
তাহলে কেন গোপনে, ছদ্মবেশে বাংলায় যাতায়াত করতেন?  
আশ্রমে একান্তে কী আলোচনা হতো,  
কাদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটত,  
সেসবের কোনো উত্তর আজও সরকারি নথিতে নেই।  

কিন্তু জনশ্রুতি ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বলছে—  
**“তিনি বাংলায় এসেছিলেন।  
তিনি বেঁচে ছিলেন।  
তিনি আমাদের মাঝেই ছিলেন।”**


ফৈজাবাদের রাম ভবনে: ১৯৮০–এর দশকের গোড়ার দিকে ফৈজাবাদের মানুষ হঠাৎই টের পেলেন—  
তাদের শহরে এক অদ্ভুত সাধুর আবির্ভাব ঘটেছে।  
তিনি কোথা থেকে এলেন, কীভাবে এলেন—  
কেউ জানল না, কেউ জানতেও পারল না।  

লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম—  
**“গুমনামী বাবা।”**  
কেউ কেউ বলতেন— **ভগবানজী**। 

শহরের প্রান্তে এক অচেনা বাড়ি, যা ‘রাম ভবন’ নামে পরিচিত, সেইখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করলেন তিনি।  
কিন্তু তাঁর জীবনযাত্রা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা—  
ঘরের যেখানটায় তিনি বসতেন, তার সম্মুখভাগে সবসময়ই টাঙানো থাকত একটা পর্দা। তিনি কারও সামনে আসতেন না। সাধু ছিলেন বটে, কিন্তু কোনও শিষ্য-চেলা বা সাধারণ ভক্তমণ্ডলী গড়ে তুললেন না।  

যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছানোর সৌভাগ্য পেয়েছিলেন,  
তাঁদের প্রত্যেকেই বলেছিলেন—  
তিনি ছিলেন অন্যরকম।  
তাঁর কথাবার্তা, জ্ঞানের গভীরতা,  
দেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর দখল,  
সবই যেন এক অতীত-চেনা মানুষের ছায়াকে মনে করিয়ে দিত।  

দিন যত গড়াতে লাগল,  
রাম ভবন যেন রূপ নিল এক গোপন দুর্গে।  
বাইরে থেকে তিনি সন্ন্যাসীর মতো,  
কিন্তু ভেতরে—  
কাগজপত্র, বই, চিঠি, দলিল,  
যেন সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছিল—  
এ সাধু কেবল সাধু নন,  
তিনি এমন এক মানুষ,  
যাঁকে গোটা দেশ আজও খুঁজে ফিরছে।  

ফৈজাবাদবাসীর কাছে তখন থেকে শুরু হলো  
এক দীর্ঘ গুঞ্জনের ইতিহাস—  
**“গুমনামী বাবা আর কেউ নন,  
তিনি আসলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।”**