Read The divine artist Vishwakarma by KRISHNA DEBNATH in Bengali Motivational Stories | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা

ভারতীয় পুরাণে বিশ্বকর্মা হলেন দেবশিল্পী। তিনি সৃষ্টিশিল্পের আদিগুরু। দেবশিল্লী বিশ্বকর্মা দেবতাদের নগরী, অস্ত্র-শস্ত্র, রথ, অলঙ্কার থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রূপকার হিসেবে পরিচিত। শিল্পকলা, স্থাপত্যবিদ্যা, কারুশিল্প— সবকিছুর উৎস তিনি। পুরাণ বলে— ত্রিপুরাসুরের দুর্গ, ইন্দ্রের অমরাবতী, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল— সবই বিশ্বকর্মার নকশা আর সৃজনশক্তির ফল। রামায়ণে বর্ণিত রাবণের লঙ্কা বা মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরীও এই বিশ্বকর্মার নিপুণ হাতেই নির্মিত হয়েছিল বলে কথিত আছে।

কিন্তু এই পৌরাণিক কাহিনীর অন্তরালে আমরা যদি গভীরভাবে ভাবি, তবে দেখব যে বিশ্বকর্মা কেবল পুরাণের এক দেবতা নন; তিনি মানুষের শ্রম, দক্ষতা, কল্পনা আর প্রযুক্তির এক বিশ্ব প্রতীক।

স্থপতি থেকে স্থপতিবিদ্যা : বিশ্বকর্মা যেমন দেবলোকের প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, তেমনি আজকের যুগের স্থপতি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও নগর পরিকল্পনাবিদরা সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন। সুউচ্চ অট্টালিকা, সেতু, মেট্রো রেল, আধুনিক বিমানবন্দর— সবই যেন সেই বিশ্বকর্মার আধুনিক সংস্করণ।

অস্ত্রশিল্প থেকে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি : দেবতাদের জন্য তিনি যে দিব্যাস্ত্র তৈরি করেছিলেন, আজকের দিনে তা প্রতিফলিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে— মিসাইল, স্যাটেলাইট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক যুদ্ধবিমান।

রথ থেকে মহাকাশযান : পুরাণে দেবতাদের রথ উড়ে যেত আকাশপথে। আধুনিক বিজ্ঞান সেই স্বপ্নকে বাস্তব করেছে— বিমান, রকেট, স্পেসশিপ। ISRO-র চন্দ্রযান, মঙ্গলযান যেন বিশ্বকর্মার প্রাচীন স্বপ্নেরই পূর্ণতা।

শিল্পকলা থেকে প্রযুক্তি : অলঙ্কার ও কারুশিল্পে বিশ্বকর্মার কুশলতা আজ রূপ নিয়েছে ডিজাইন, আর্কিটেকচার, থ্রিডি প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে।

বিশ্বকর্মা পূজার আধুনিক তাৎপর্য :

বিশ্বকর্মা পূজা আজ আর কেবল পুরাণের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। শিল্পাঞ্চল, কারখানা, কারিগর, মেকানিক, প্রযুক্তিবিদ— সবাই এই দিনটিকে নিজেদের উৎসব হিসেবে পালন করেন। কারণ প্রতিটি যন্ত্রপাতি, প্রতিটি সরঞ্জামই মানব সভ্যতার অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি।

যেভাবে পুরাণে বিশ্বকর্মা দেবতাদের অগ্রগতির হাতিয়ার গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি আধুনিক যুগে বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকরা একসাথে মিলে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাই বলা যায়— বিশ্বকর্মা কেবল পুরাণের দেবতা নন, তিনি আসলে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি, সৃজনশীলতা ও শ্রমশক্তির প্রতীক।

আজকের দিনে আমরা যখন বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করি, তখন আসলে আমরা সেই চিরন্তন সৃজনশীলতাকে প্রণাম জানাই, যা মানুষকে পাথরের গুহা থেকে মহাকাশ অভিযানের পথে নিয়ে গেছে। বিশ্বকর্মা পূজা আমাদের শেখায়, যন্ত্রকে সম্মান করো, শ্রমকে মূল্য দাও, আর জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করো এক নতুন পৃথিবী।

আজকের দিনে যখন আমরা আকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ ছুড়ি, দূর নক্ষত্রের ছবি তুলি কিংবা জিন-সম্পাদনার মাধ্যমে ভবিষ্যতের চিকিৎসাব্যবস্থাকে পাল্টে দিই— তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আসল বিশ্বকর্মা হলেন আজকের বিজ্ঞানীরাই। যেমন ভগবান বিশ্বকর্মা দেবশিল্পী রূপে দেবতাদের জন্য অস্ত্র, প্রাসাদ ও যন্ত্র নির্মাণ করেছিলেন, তেমনই আধুনিক বিজ্ঞানীরা মানবসমাজের জন্য প্রযুক্তির সেই ‘অস্ত্রশস্ত্র’ গড়ে তুলছেন। তাদের গবেষণাগারই আসলে আজকের বিশ্বকর্মার কর্মশালা।  

একজন পদার্থবিদ যখন পারমাণবিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনেন, তখন তিনি আমাদের কাছে নতুন শক্তির সম্ভাবনা এনে দেন। একজন জীববিজ্ঞানী যখন ইনসুলিন আবিষ্কার করেন বা জিন থেরাপির দরজা খোলে দেন, তখন তিনি মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে হাতিয়ার যোগান দেন। একজন প্রকৌশলী যখন সেতু, মেট্রো রেল বা মহাকাশযান নকশা করেন, তখন তিনি সভ্যতার রথচক্রকে ঘোরাতে থাকেন।  

এমনকি তথ্যপ্রযুক্তির বিশেষজ্ঞরা, যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার পর্যন্ত নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন, তারাও আধুনিক বিশ্বকর্মারই প্রতিনিধি। তাদের শ্রম ও মেধার কারণেই পৃথিবী ক্রমে একটি সংযুক্ত গ্রামে পরিণত হচ্ছে।  

আজকে বিশ্বকর্মা পূজার দিনে এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ মানবরূপী বিশ্বকর্মাদের প্রতি আমার অন্তরের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি।

তাই বিশ্বকর্মা পূজার এই দিনে কেবল দেবশিল্পীর প্রতিমা আর কারখানার যন্ত্রপাতি নয়, বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানানো প্রয়োজন। কারণ তারাই আজকের যুগে আমাদের পথ দেখাচ্ছেন, উন্নতির নতুন নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছেন। তারা প্রমাণ করছেন— বিশ্বকর্মা কেবল পুরাণের চরিত্র নন, তিনি প্রতিটি গবেষণাগারে, প্রতিটি প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীর হাতে আজও বেঁচে আছেন।