Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

নার্ভাস সিস্টেম: শরীরের মহা-অর্কেস্ট্রা

মানুষের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন একেকটি বাদ্যযন্ত্র, আর এদের সম্মিলিত সংগতিই বজায় রাখে আমাদের নার্ভাস সিস্টেম নামক অর্কেস্ট্রার সুর তাল লয়ের সামঞ্জস্য। এটি শুধু শরীরকে চালায় না, বরং প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কের অবিরাম যোগাযোগও নিশ্চিত করে। যখন এই সিস্টেম ঠিক থাকে, শরীর ও মনের মধ্যে এক বিস্ময়কর সামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়। এই ভারসাম্যই আমাদের শরীরকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক রাখে। কিন্তু এর সামান্য পরিমাণ ব্যাঘাত ঘটলেই দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের ডিজঅর্ডার বা অসংখ্য রকমের রোগ। বিশেষত ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, থাইরয়েডের অসুখ কিংবা ফ্যাটি লিভার— এ ধরনের বেশিরভাগ মেটাবলিক ডিজঅর্ডারের মূল শিকড়ই লুকিয়ে আছে মানুষের নার্ভাস সিস্টেমের ভারসাম্যহীনতার মধ্যে।

আমাদের নার্ভাস সিস্টেমকে বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে CNS ও PNS সম্পর্কে।

CNS ও PNS: ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার নেটওয়ার্ক:-

সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম (CNS)— অর্থাৎ মস্তিষ্ক ও স্পাইনাল কর্ড হলো আমাদের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র। আবার পেরিফেরাল নার্ভাস সিস্টেম (PNS) হলো সেই বিশাল স্নায়ু নেটওয়ার্ক, যা CNS-এর বার্তা প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছে দেয় এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিক্রিয়াও ফিরিয়ে আনে। উদাহরণস্বরূপ, আগুনে হাত দিলে জ্বালাপোড়ার সংকেত মুহূর্তেই মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত সরানোর নির্দেশ ফিরে আসে। অর্থাৎ CNS ও PNS মূলত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়েই কাজ করে।

এরপর জানতে হবে ANS বা অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেম সম্পর্কে। এই অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেম একটি স্বয়ংক্রিয় নেটওয়ার্ক। এটি নিজের মতো করেই কাজ করতে থাকে। এর কাজ চালাতে আমাদের কোনো সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দরকার হয় না। আমি ঘুমিয়ে থাকলেও শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, হৃদয় স্পন্দন করছে, পেটের খাবার হজম হচ্ছে, কিডনি রক্ত ছেঁকে দিচ্ছে— এসবই ANS-এর বিস্ময়কর স্বয়ংক্রিয়তা।
অর্থাৎ, ANS হলো শরীরের “অটো-পাইলট” সিস্টেম, যা সবসময় ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ করে। শ্বাস নিতে, হার্টবিট বজায় রাখতে বা খাবার হজম করতে কারো অনুমতিই লাগে না— এটাই এর বিশেষত্ব।

ANS আবার দুটি ভাগে বিভক্ত। সিমপ্যাথেটিক ও প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম।

১. সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (SNS):
“Sympathy” মানে হচ্ছে কোনো কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক বা প্রতিক্রিয়া দেখানো। SNS আসলে আমাদের ভাবনা-চিন্তা, আবেগ ও ভয়ের প্রতিক্রিয়ায় সক্রিয় হয়। যেমন— পরীক্ষার হলে বসেই কারো বুক ধড়ফড় শুরু হয়, ইন্টারভিউর আগে হাত পা ঘামতে শুরু করে, হঠাৎ করে বিপদের সম্মুখীন হলেই হৃৎস্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে যায়— এগুলো সব SNS-এর কাজ। তখন শরীর হরমোন ছাড়ে, বিশেষ করে কর্টিসল নামের স্ট্রেস হরমোন।
কর্টিসল তাৎক্ষণিকভাবে শরীরকে বিপদের জন্য প্রস্তুত করলেও এর দীর্ঘমেয়াদি আধিক্য মারাত্মক ক্ষতিকর— স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এমনকি মস্তিষ্কের স্মৃতি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই অতিরিক্ত SNS-অ্যাক্টিভেশন মানেই শান্ত সমুদ্রের বুকে সুনামি বা শান্ত আকাশে বজ্রপাত !

২. প্যারাসিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (PNS):
এর কাজ SNS-এর বিপরীত। এটি শরীরকে শান্ত করে, হৃদস্পন্দনকে স্বাভাবিক রাখে, হজম প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে, ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করে। সবকিছু রিদমিক ও সুষম রাখাই এর প্রধান কাজ।

হোমিওস্টেসিস বা অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য:

SNS ও PNS এই দুই সিস্টেমের সূক্ষ্ম সমন্বয় থেকেই জন্ম নেয় হোমিওস্টেসিস— অর্থাৎ শরীরের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীল অবস্থা। বাহ্যিক পরিবেশ যতই বদলাক না কেন, শরীর চেষ্টা করে নিজের ভেতরের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, গ্লুকোজের মাত্রা বা পিএইচ ভেল্যু একটি নির্দিষ্ট সীমায় ঠিক রাখতে। এটাই সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের মূল চাবিকাঠি।

আমাদের রোগ কেন হয় ?

ANS বা অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করলে শরীর নিজেই সুস্থ হয়ে উঠতে পারে, ওষুধের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু আজকের যুগে স্ট্রেস, ঘুমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, দূষণ— সব মিলিয়ে আমাদের এই সূক্ষ্ম সিস্টেমের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। অতিরিক্ত কর্টিসল নিঃসরণ, দীর্ঘস্থায়ী সিমপ্যাথেটিক উত্তেজনা এবং বিশ্রামের অভাবই মেটাবলিক ডিজঅর্ডারের মূল কারণ। 

কীভাবে ANS-কে ঠিক রাখা যায় ?

ধ্যান ও যোগব্যায়াম: প্যারাসিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে, মনে শান্তি আনে।

সুষম খাদ্যাভ্যাস: প্রাকৃতিক ও পুষ্টিকর খাবার আমাদের নার্ভাস সিস্টেমের জন্য জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। 

নিয়মিত ঘুম: CNS ও ANS উভয়কে পুনরুজ্জীবিত করে।

শারীরিক অনুশীলন: হাঁটা, দৌড়, সাঁতার— নার্ভাস সিস্টেমের ভারসাম্য বজায় রাখে।

এনিম্যাল এক্সারসাইজ: পশুর মতো ভঙ্গি ও গতির মাধ্যমে মেরুদণ্ডে মোচড় দেওয়া হয়। এতে স্পাইনাল কর্ড সক্রিয় হয়, রক্তসঞ্চালন বাড়ে এবং স্নায়ুতন্ত্রে নতুন প্রাণশক্তি আসে।

স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ: গভীর শ্বাস, প্রকৃতির সংস্পর্শ, মাইন্ডফুলনেস সিমপ্যাথেটিক উত্তেজনা কমায়।

নার্ভাস সিস্টেমকে ঠিক রাখা মানেই শরীরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোগমুক্তির ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। ওষুধ সাময়িক ভরসা দিতে পারে, কিন্তু সত্যিকার আরোগ্য আসে তখনই, যখন স্নায়ুতন্ত্রের এই সূক্ষ্ম সমন্বয় অটুট থাকে। তাই সুস্থ জীবনের মূল মন্ত্র হলো— নার্ভাস সিস্টেমকে শক্তিশালী রাখা, যাতে শরীর নিজেই নিজের চিকিৎসক হয়ে উঠতে পারে।