Read Mission Indiana - 9 by Bishwadeep Mukherjee in Bengali Science-Fiction | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

Mission Indiana - 9

মিশন ইন্ডিয়ানা
*************
পর্ব - 9
********
Indiana 
*********

নিজের ঘরে পায়চারি করছেন অনুরাগ বর্মন। কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বেশ কিছু সিগারেট একের পর এক খেয়ে ফেলেছেন তিনি। ধূমপানে খুব একটা আগ্রহী নন তিনি, কিন্তু এই মুহূর্তে ধূমপান যেন স্বর্গ প্রাপ্তি মনে হচ্ছে তার কাছে। ঘরের জানালা দিয়ে নিচে রাস্তার দিকে তাকালেন তিনি। একবার সোফায় বসছেন, আবার কিছুক্ষণ পর উঠে পায়চারি শুরু করে দিচ্ছেন। নিজের মোবাইল হাতে নিয়ে কাউকে কল করতে গেলেন, কিন্তু কিছু একটা ভেবে মোবাইলটা পুনরায় টেবিলের উপর রেখে দিলেন। তিনি আরেকটা সিগারেট ধরাতে যাবেন ঠিক সেই সময় তার মোবাইলে একটা নোটিফিকেশনের বিপ শোনা গেল। সিগারেট যথা স্থানে রেখে মোবাইল হাতে নিলেন অনুরাগ বর্মন। হোয়াটসআ্যপে ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজ করেছে নীহারিকা। ম্যাসেজে লেখা আছে - "দেবব্রত ফিরে এসেছে।" ম্যাসেজটা পড়তেই চেহারায় হাসি দেখা গেল অনুরাগ বর্মনের। মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।

********************************

ইসরোর ইস্টার্ন উইংএর মিউজিয়ামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন দেবব্রত চৌধুরী। গেটের সামনে বসে থাকা গার্ডের দিকে খানিক চেয়ে রইলেন তিনি, ঠিক যেন তাকে চেনার চেষ্টা করছেন। চিনতে পারলেন না। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে যে লোকটা এখানে গার্ডের কাজ করতো, সে অবশ্যই এখন আর থাকবে না। দেবব্রত এখন কাজ করেন না এখানে। বহু বছর আগে কাজ ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমান কর্মচারীদের পক্ষে তাকে চেনা সম্ভব না। সব জায়গায় অনায়াসে ঘুরে বেড়ানোও দেবব্রত চৌধুরীর পক্ষে সম্ভব নয়। মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক ব্যাঙ্গালুরু যাওয়ার আগে দেবব্রত চৌধুরীর জন্য একটা "ভিজিটারস্ কার্ড" বানিয়ে দিয়েছেন। সেটাই পকেটে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেবব্রত। কার্ডটা বের করে গার্ডকে দেখালেন তিনি। গার্ড খুব ভালো করে জানে যে, এই কার্ডটা সবার কাছে থাকা সম্ভব নয়। দেবব্রত চৌধুরীর কাছে কার্ডটা আছে মানে তিনি নিশ্চই চিফের কাছের লোক। গার্ড এগিয়ে গিয়ে গেট খুলে দিলো। লম্বা ব্যবধানের পর ইসরোর ইস্ট্রান উইংএর মিউজিয়ামে পা রাখলেন দেবব্রত চৌধুরী। বিশাল জায়গা ঘিরে মিউজিয়াম। বহু স্পেসক্রাফ্ট ছাড়া আরো নানাবিধ জিনিসে ভরা। মিউজিয়ামের এক বিশেষ দিকে এগিয়ে গেলেন দেবব্রত চৌধুরী। বেশ বড় রকম একটা ঘর বানানো আছে। সামনে নাম্বার লক কড়া লোহার গেট। বিগত ত্রিশ বছরে হয়তো এই গেটটা একেবারের জন্যও খোলা হয়নি। ত্রিশ বছর আগেকার কথা মনে পড়লো দেবব্রত চৌধুরীর। তার সামনেই এই ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইন্ডিয়ানা কে। এক লাইনে বেশ কিছু স্পেসক্রাফ্ট রাখা আছে। এই স্পেসক্রাফ্ট গুলোর সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো ইন্ডিয়ানা। একটা ইতিহাস সৃষ্টিই তো করতে গিয়েছিল ইন্ডিয়ানা। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য তাকে আজ একটা ঘরের মধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে। সত্যিই কি দুর্ভাগ্যটা ইন্ডিয়ানা'র? নাকি দেবব্রত চৌধুরীর দুর্ভাগ্যে তার আজ এমন অবস্থা। ইন্ডিয়ানা কোনো অপরাধীর ন্যায় নিজেকে যেন লুকিয়ে আর গুটিয়ে নিয়েছে। নাম্বার লক করা দরজাটা একবার খুললে ভালো হতো। একবার মন ভরে দেখতে চায় দেবব্রত ইন্ডিয়ানা কে। ইন্ডিয়ানা'র থেকে ক্ষমা চাইতে চায় সে। মিশন সফল হোক বা না হোক, ইতিহাস সৃষ্টি তো করেছে ইন্ডিয়ানা। ইন্ডিয়ানা'ই তো প্রথম টাইটানে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ইতিহাস সৃষ্টি করা ইন্ডিয়ানা বহুকাল ধরে অন্ধকারের মধ্যে মিশে আছে। দেবব্রত বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। 
'আপনি এখানে আছেন স্যার? আমি সারা বিল্ডিং আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি।'
নীহারিকার গলার আওয়াজ পেয়ে পিছন দিকে ফিরে তাকালেন দেবব্রত। নীহারিকা এগিয়ে গেল দেবব্রত চৌধুরীর দিকে। বললো - 'স্যার, আপনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে চান।'
'কে?' জিজ্ঞাসা করলেন দেবব্রত। 
'আপনার পুরোনো ক্রিউ মেম্বারের মধ্যে একজন, অনুরাগ বর্মন।' বললো নীহারিকা। 
নামটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন দেবব্রত চৌধুরী।
'এই বন্ধ ঘরটা দেখছো নীহারিকা? এর ভিতরেই গা ঢাকা দিয়ে আছে আমাদের ইন্ডিয়ানা। কোনো এক সময়ে এই ইন্ডিয়ানা কে চালিয়েছিল অনুরাগ। পাইলট ছিল সে। কোনো এক সময়ে এই ইন্ডিয়ানা'র ক্যাপ্টেন ছিলাম আমি। সবই এখন ইতিহাস। এমন ইতিহাস যেটাকে সবাই ভুলে যাওয়াই পছন্দ করবে। ইতিহাস সৃষ্টি করার পরেও আমাদের ইন্ডিয়ানা'র এই অবস্থা। কাউকে মুখ দেখাতে পারে না সে। নীহারিকা, একবার, শুধু একবার যদি কেউ এই দরজাটা খুলে দিতে পারতো, তাহলে আমি ক্ষমা চাইতে পারতাম ইন্ডিয়ানা'র কাছে। ইন্ডিয়ানা'র এই অবস্থার পিছনে একমাত্র আমি দায়ী। শুধু তাই নয়। সেই মিশনে যারা নিজের প্রাণ হারিয়েছে, সেটার জন্যও একমাত্র আমিই দায়ী। নীহারিকা, গত তিরিশ বছরে এক দিনও এমন হয়নি যেদিন আমি একটু হলেও মনের শান্তি পেয়েছি। নিজেকে খুনি মনে হতো নীহারিকা।'
নীহারিকা লক্ষ্য করলো দেবব্রত চৌধুরীর দু চোখ ছলছল করছে।  দেবব্রত চৌধুরীর কাঁধে হাত রেখে নীহারিকা বললো - 'যা কিছু হয়েছে সেটা ভুলে যান স্যার। আপনি নিজের জায়গায় ঠিক ছিলেন। গিল্টি ফিল করবেন না স্যার। যদি সত্যিই আপনি দোষী হতেন, তাহলে নিশ্চই অনুরাগ বর্মন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না। অনুরাগ বর্মনের কাছেই আমি মিশন ইন্ডিয়ানা'র বিষয় শুনেছি।'
খানিক চুপ থেকে দেবব্রত জিজ্ঞাসা করলেন - 'অনুরাগ কি এখানে আসবে?'
'না স্যার। এখানে নয়। কোনো রেস্টুরেন্টে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান তিনি।' 
দেবব্রত নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখলেন। দুপুর আড়াইটে বাজে। 
'কখন দেখা করতে চায় সে?' দেবব্রত জিজ্ঞাসা করলেন। 
'উনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন।'
'বহুদিন পর আবার এক সাথে লাঞ্চ করার সুযোগ পাবো।'

********************************

একটা রেস্টুরেন্টে সামনা-সামনি বসে আছেন দেবব্রত চৌধুরী এবং অনুরাগ বর্মন। তাদের সামনে টেবিলে রাখা আছে পোলাউ, চিকেন জাতীয় নানাবিধ খাবার। চামচে করে একটু পোলাউ খাবার পর অনুরাগ বর্মন বললেন - 'কথাটা শুধু তোমার নয় দেবব্রত। গা ঢাকা দিয়ে তো আমিও আছি গত তিরিশ বছর ধরে।'
'হ্যাঁ, জানি। কিন্তু কার জন্য? কে দায়ী? আমিই তো। আমি যদি সেই দিন তোমাদের কথা শুনতাম, তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না। সুধাকর, অগ্নিজিৎ সবাই জীবিত থাকতো। তাদের তো শেষ কৃত্য পর্যন্ত করা গেল না। কৃষ্ণমূর্তি ঠিকই বলেছিলেন। আমি তাদের মৃত্যুর একমাত্র কারণ।' দেবব্রত বললেন। 
'না দেবব্রত। কারণ তুমি না। আমরা যদি ফিরে আসতাম, তাহলে কী বলতাম এখানে? আর সব থেকে বড় কথা, তুমি তো জাস্ট কথা বলতে গিয়েছিলে। যারা আক্রমণ করেছিল, তাদেরকে ক্ষমা করা চলে না।'
'কিন্তু আমরা করতেই বা কী পারি অনুরাগ? রিভেঞ্জ নেওয়ার মত ক্ষমতা আমাদের আছে? তাদেরকে আমরা জবাব দিতে পারবো না অনুরাগ। তাদের কথা মেনেই আমাদের চলতে হবে।'
'তুমি বলতে কী চাইছো দেবব্রত? তুমি তাদের কথা মত উঠতে বসতে চাও?' 
একটু চুপ করে দেবব্রত বললেন - 'তোমার কাছে কোনো অন্য উপায় আছে? কী করবো আমরা? যুদ্ধ? এখান থেকে বোমা, মিসাইল নিয়ে গিয়ে টাইটানের উপর ফেলবো? তারপর কী হবে সেটা ভেবে দেখেছো? কোটি-কোটি লোক বাস করে এই শহরে। এই দেশের পপুলেশনটা একবার ভেবে দেখো অনুরাগ। সবাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবো আমরা। অনুরাগ, এমন একটা বিনাশ হবে সেটার কল্পনাও আমরা করতে পারি না।'
'দেবব্রত, তুমি নিজের সর্বনাশ করতে যাচ্ছো। সেটা জানো?'
মুচকি হেসে দেবব্রত বললেন - 'সর্বনাশ নয় অনুরাগ। এটা নিয়তি। প্রত্যেকের তো একটা এন্ড পয়েন্ট হয়। ভেবে নাও এটা আমার এন্ড পয়েন্ট। যেটা ভেবেছি, সেটা যদি সফল হলো, তাহলে বহু বছর ধরে বুকের উপর থাকা বোঝাটা নেবে যাবে। বুকটা অনেক হাল্কা মনে হবে অনুরাগ। অনেক হাল্কা।'
'দেবব্রত, তোমার মনে আছে যখন মিশন ইন্ডিয়ানা'র জন্য আমাদের সিলেকশন হয়েছিল। তখন আমরা একে অপরকে একটা প্রমিস করেছিলাম। মনে আছে তোমার?' 
অনুরাগের কথায় দেবব্রত চোধুরী ভ্রু কুঁচকে তাকালেন তার দিকে। 
'তুমি যেটা বলতে চাইছো, সেটা কোনো দিন সম্ভব নয় অনুরাগ। এসব কথা ভুলেও নিজের মাথায় আনবে না।'
'কথার ভ্যাল্যু থাকা উচিত ক্যাপ্টেন। আমার কথার ভ্যাল্যু আছে। যে কথা দিয়েছিলাম, সেটা রাখবো।' কথাটা বলে পাশে রাখা কাঁচের গ্লাস থেকে জল খেলেন অনুরাগ বর্মন।
'পরিস্থিতি অনুকূল নয় সেটা আমিও জানি আর তুমিও জানো। যে সময় আমরা একে অপরকে প্রমিসটা করেছিলাম, সেই সময় আমরা ভাবিনি যে এমন পরিস্থিতিও কোনো দিন আসতে পারে। সব কিছু যদি নর্মাল থাকতো, তাহলে সেটাই হতো যে কথাটা আমরা একে অপরকে দিয়েছিলাম।' 
দেবব্রত চৌধুরীর খাবার শেষ হয়ে গেছে। জল খেয়ে ওয়েটারকে ডেকে বিল দিতে বললেন।
'এতো বছর পর তোমার সাথে লাঞ্চ করে ভালো লাগলো অনুরাগ।  এটা জেনেও ভালো লাগলো যে, এখনও নিজের পুরোনো ক্যাপ্টেনকে ভোলোনি তুমি। পুরোনো প্রমিসও মনে রেখেছো।'
'ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই দেবব্রত।'
বিলটা দেবব্রত দিলেন। অনুরাগ দিতে চেয়েছিলেন, বারণ করে দিলেন দেবব্রত। 
'ট্রিট তো ক্যাপ্টেন কেই দিতে হয়।'
দুজনে বেরিয়ে এলেন রেস্টুরেন্ট থেকে।
'দেবব্রত, আর কি কোনো দিন দেখা হবে তোমার সাথে?' 
অনুরাগের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না দেবব্রত চৌধুরী। গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন অনুরাগের দিকে। অনুরাগের বিষাদে ভরা মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে বসে পড়লেন। দেবব্রত চৌধুরীর চলে যাওয়ার পর নিজের প্যান্টের পকেটে থেকে মোবাইল বের করে একটা কল লাগালেন অনুরাগ বর্মন। 
'তুমি কি আমায় মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের মোবাইল নাম্বারটা দিতে পারবে?'

********************************

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এসেছে। কেম্পেগৌড়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে এসে ট্যাক্সিটা থামলো। চারিদিক আলোতে ঝলমল করছে। কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। চেহারায় ক্লান্তি। বিমানবন্দরের ভিতরে গিয়ে বোর্ডিং পাস নিয়ে ওয়েটিং হলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ফ্লাইটে এখনো বেশ খানিকটা দেরি আছে। মোবাইল বের করে একটা কল করলেন মৃত্যুঞ্জয়। ওপ্রান্ত থেকে নীহারিকার গলার আওয়াজ শোনা গেল।
'ইয়েস স্যার!'
'নীহারিকা, নিজের টিম রেডি করো।'
'ওকে স্যার।'
'এবার কোনো রকমের গন্ডগোল যেন না হয় নীহারিকা। এই মিশনটা যেন সাকসেস হয়। নো ক্যাজুয়েলটি।'
'আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট স্যার। কিন্তু একটা আন্দাজ করতে পারছি যে, এই মিশনের এন্ডিং পয়েন্ট কোথায়।' নীহারিকা বললো। 
মৃত্যুঞ্জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন - 'আমিও বুঝতে পারছি নীহারিকা। আমি চাই না, আমরা যেই এন্ডিং পয়েন্টটা ভাবছি, বাস্তবে সেটাই হোক। কিন্তু যদি সেটা হলো, তাহলে আমাদের করারও কিছুই থাকবে না নীহারিকা। আমরা এখন শুধু দর্শক। যা কিছু হচ্ছে বা যা কিছু হতে চলেছে, দেখা ছাড়া আমাদের করার কিছুই নেই।'
মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় নীহারিকা চুপ রইল। 
'নীহারিকা, তোমার আর দেবব্রত চৌধুরীর মধ্যে কে মিশন লিড করবে ভেবে নাও।'
'স্যার, আমার মনে হয় মিস্টার চৌধুরীকেই এই মিশনের কন্ট্রোল দেওয়া উচিত। উনি আমার  থেকে অনেক সিনিয়ার। আমার থেকে অনেক বেশি মিশন করেছেন তিনি।'
'হুম, ঠিক বলেছো। তাও, একবার কথা বলে নিও মিস্টার চৌধুরীর সাথে। ওনার মতামতটা জানা দরকার।'
'স্যার, অনুরাগ বর্মন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। আপনার মোবাইল নাম্বার তিনি চেয়েছিলেন। আমি দিইনি এখনো।'
একটু ভেবে মৃত্যুঞ্জয় বললেন - 'অনুরাগ বর্মন? দেবরাজ বর্মনের ভাই তাই তো?'
'ইয়েস স্যার।' নীহারিকা বললো। 
'তার আমার সঙ্গে কী দরকার?'
'আই ডোন্ট নো স্যার। আমায় বলেছিলেন যে, আপনার সঙ্গে ওনার নাকি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।'
'ঠিক আছে। কাল সকালে আসতে বলো তাকে।'

********************************

কলটা ডিসকানেক্ট করে অনুরাগ বর্মনকে একটা ম্যাসেজ করে দিলো নীহারিকা। সে এখন সপ্তর্ষির সঙ্গে তার ফ্ল্যাটে আছে। নীহারিকার পিছন থেকে সপ্তর্ষি দু হাতে দুটো বিয়ারের বোতল নিয়ে এলো। নীহারিকাকে একটা বোতল দিয়ে বললো - 'পারমিশন পাওয়া গেছে তা হলে।'
'হ্যাঁ, পাওয়া গেছে। কিছু দিনের ব্যবধানে আরেকটা মিশন। এমনটা মনে হয় কোনো দিন নাসা তেও হয়নি।' কথা শেষ করে এক সাথে তিন-চার ঢোঁক বিয়ার খেয়ে নিলো নীহারিকা। 
নীহারিকা বিয়ার হাতে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল। সপ্তর্ষিও এলো তার সঙ্গে।
'নীহারিকা, এবার আমরা অর্ণবকে পাবো না সেটা ভেবে দেখেছো? অর্ণবের প্রয়োজন ছিল। তার বিকল্প নেই।' বিয়ারে চুমুক দেওয়ার পর সপ্তর্ষি বললো। 
'প্রয়োজন তো ছিল অর্ণবের। কিন্তু কিছু করার নেই রে। আমি একটা বিকল্প ভেবেছি। কাল সেটা নিয়ে চিফের সঙ্গে কথা বলবো।'
নীহারিকার দিকে তাকালো সপ্তর্ষি। 
'আমি জানি তুই কী বিকল্প ভেবেছিস। বাট, শি ইজ নট প্রিপেয়ার্ড। তাকে ট্রেনিং দিতে কত দিন লেগে যাবে সেটা জানিস?'
'জানি। কিন্তু তা ছাড়া আমাদের কাছে কোনো উপায় নেই সপ্তর্ষি। আমাদের ডি কোডিং করার একজনকে লাগবে। আর আমরা এটাও জানি যে অর্ণবের জায়গা একমাত্র সেই নিতে পারবে। আমাদের কাছে কোনো চয়েস নেই সপ্তর্ষি।'
সপ্তর্ষি কিছু বললো না। বিয়ার পানের দিকে মনোযোগ করলো। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা চেয়ে রইল। নিস্তব্ধতা ভেঙে নীহারিকা বললো - 'জানিস সপ্তর্ষি, দেবব্রত চৌধুরীকে দেখে অবাক লাগে আমার। তিরিশ বছর আগের ঘটনার প্রভাব তার জীবন থেকে এখনো যায়নি। তিনি খুব ভালো করে জানেন আমাদের এই মিশনের পরিণাম কী হতে চলেছে। তাও তার মুখে চিন্তার কোনো ছাপ নেই। শুধু মনের মধ্যে আছে একরাশ বেদনা, গিল্টি ফিলিং।'
'গিল্টি ফিলিংটা আমিও লক্ষ্য করেছি নীহারিকা। সেটা হওয়া স্বাভাবিক। আমাদের টাইটান মিশনে যদি কিছু অঘটন ঘটে যেতো, তাহলে গিল্টি ফিলিং তোরও হতো। কারণ তুই ক্যাপ্টেন ছিলিস। তিনিও ক্যাপ্টেন ছিলেন মিশন ইন্ডিয়ানা'র। তার ক্রুয়ের দায়িত্বে তার ছিল। নিজের চোখের সামনে তিনি তিনটে ক্রু মেম্বারদের মরতে দেখছেন। মিস্টার চৌধুরীর দোষ থাকুক বা না থাকুক, কিন্তু চিরকাল তার মাথায় এই কথাটা থেকে যাবে যে, উনি হয়তো তাদের বাঁচাতে পারতেন।' 
নীহারিকা তাকালো সপ্তর্ষির দিকে। 
'সপ্তর্ষি, আমাদের এই মিশনটা সাকসেস হবে তো?'
সপ্তর্ষি নীহারিকার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তার পাশে একটা ফুলদানি রাখা গোল টেবিল ছিল। তার উপর বিয়ারের বোতলটা রাখলো সপ্তর্ষি। নিজের দু হাত দিয়ে নীহারিকার দুটো গালে আলতো করে চাপ দিলো সে। 
'চিন্তা কেন করছিস নীহারিকা? সব ঠিক হবে। এতো চিন্তা করিস না।'
নীহারিকা সপ্তর্ষির বুকে নিজের মাথা গুঁজে দিলো। তার হাত থেকে বিয়ারের বোতলটা নিয়ে সেই গোল টেবিলে রেখে দিলো সপ্তর্ষি। নীহারিকাকে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালো।
'নীহারিকা, এসবের মাঝে আমরা যেন নিজেদের হারিয়ে ফেলছি বলে তোর মনে হয় না? টাইটান থেকে ফিরে আসার পর আমাদের কী প্ল্যান ছিলো নীহারিকা?'
'মনে আছে। আমরা এক হবো সপ্তর্ষি। খুব শিগগিরই এক হবো।'
সপ্তর্ষি নীহারিকা দুটো হাত নিজের হাতে ধরলো। খুব ধীরে গতিতে নীহারিকাকে নিজের দিকে এগিয়ে আনলো। নীহারিকা যেন ইচ্ছাকৃতই নিজেকে সপ্তর্ষির দিকে এগিয়ে দিলো। দুজনের ঠোঁট যেন মধুর অলিঙ্গণে মেতে উঠলো। 

********************************

সকাল প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিকের গাড়ি ইসরোর গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত চৌধুরীকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন মিউজিয়ামের দিকে। 
'আপনি কিছু চেয়েছেন সেটা আপনাকে দেবো না, এটা হতে পারে না মিস্টার চৌধুরী। সব থেকে বড় কথা, আপনি যেটা চেয়েছেন, সেটার উপর আপনার পুরোপুরি অধিকার আছে।'
মিউজিয়ামের গেটের কাছে পৌঁছলেন দুজনে। দেবব্রত লক্ষ্য করলেন গতকালের গার্ডটা আজ নেই। আজকে অন্য গার্ড। মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিককে দেখেই গার্ড স্যালুট করলো তাকে। নিমেষের মধ্যে খুলে দিলো মিউজিয়ামের গেট। মৃত্যুঞ্জয় এবং দেবব্রত ভিতরে প্রবেশ করলেন। তারা এগিয়ে গেলেন সেই ঘরের দিকে।
'আমি যবে থেকে ইসরো জয়েন করেছি, তবে থেকে এই ঘরটা খুলতে দেখিনি। চিফ হওয়ার পর আমায় এই ঘরের দরজার আনলক কোড দেওয়া হলো। আমায় বলা হলো, আমি যেন এই ঘর কখনো না খুলি। আজ পর্যন্ত কথাটা মেনে এসেছিলাম আমি। কিন্তু আজ আর মানবো না। আসলে কী জানেন মিস্টার চৌধুরী? মাঝে-মাঝে অবাধ্য হতে ভালো লাগে।'
দরজার পাশে একটা ইলেকট্রনিক বোর্ড লাগানো আছে। ডিসপ্লে ছাড়া এক থেকে দশ পর্যন্ত এবং ইংরেজির "A" থেকে "Z" পর্যন্ত বাটন আছে সেখানে। মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক সেই ইলেকট্রনিক বোর্ডের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে আনলক কোড টাইপ করলেন। দেবব্রত দেখলেন আনলক কোড টাইপ করার পাঁচ থেকে ছয় সেকেন্ডের মধ্যে বড় লোহার গেটটা আসতে-আসতে দু ফাঁক হয়ে খুলে গেল। ভিতরটা অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাতে মোবাইল নিয়ে সেটার টর্চ অন করলেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। ধীর গতিতে এগিয়ে গেলেন ঘরটার ভিতর। দেবব্রত তার পিছু নিলেন। 
'আমি এই প্রথম ঢুকলাম। কোথায় সুইচ বোর্ড আছে সেটাও জানি না।' বললেন মৃত্যুঞ্জয় ভৌমিক। 
'আমি জানি সুইচ বোর্ড কোন দিকে আছে। ভিতরে ঢুকেই দরজার সাথে লাগোয়া বাঁ দিকের  দেওয়ালে। যে সময় ইন্ডিয়ানা কে এখানে রাখা হচ্ছিলো, সে সময় আমি এসেছিলাম এই ঘরে। সেই দিনটাই ইসরোতে আমার শেষ দিন ছিল।' দেবব্রত বলে এগিয়ে গেলেন। মোবাইলের আলোতেই খুঁজে পেলেন সুইচ বোর্ড। সুইচ বোর্ডের আটটা সুইচের মধ্যে একে-একে সব গুলোই অন করলেন তিনি। পরক্ষণেই অন্ধকার ঘরটা আলোতে ভরে গেল। দেবব্রত এবং মৃত্যুঞ্জয়ের নজর স্থির হয়ে গেল ঘরের মাঝখানে তাকিয়ে। 

ক্রমশঃ....