Read Lord Ramachandra's love for his wife by DR RAJESH CHOUDHURI in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ভগবান রামচন্দ্রের পত্নীপ্রেম

গতকাল স্যোসাল মিডিয়ায় দেখলাম,- পশ্চিমবঙ্গের একজন সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব  মাইক হাতে বেশ বিজ্ঞের মত ভগবান রামচন্দ্রের আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছেন। দেবী সীতার অগ্নিপরীক্ষা এবং গর্ভাবস্থায় সীতার বনবাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে কটাক্ষ করে ভগবান রামচন্দ্রকে অপরাধী বলে প্রমান করতে চাইছেন। 

এটাই সমস্যা!! অঢেল টাকার মালিক আর ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠার অধিকারী হলেই আমাদের মত সাধারণ মানুষ নিজেকে এমন কেষ্টবিষ্টু ভাবা শুরু করি যে,- পুরুষোত্তমের উপর আঙ্গুল উঠাতে দুইবার চিন্তা করিনা। পুরুষোত্তমের অনেক আচরন ও কর্ম আমাদের সাধারণ বুদ্ধির বোধগম্য নাও হতে পারে। তখন আমি শ্রদ্ধার সাথে তার সম্পর্কে  কৌতূহল প্রকাশ করতেই পারি। কিন্তু তা না করে,- নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে অসীমকে পরিমাপ করতে গেলে এমন আবোলতাবোল মন্তব্য মুখ দিয়ে বের হতেই পারে। আমার বক্তব্য শুনে আমার মত কতগুলি অবোধ মানুষ হাততালি দিলেও,- আমি যে একটা অপদার্থ বিশেষ তা বুঝতে কারো বাকী থাকেনা।

ভাবখানা এমন,- যে অগ্নিপরীক্ষাকে আমাদের মত সাধারণ মানুষ সীতার প্রতি অনায় ও অপমানজনক বলে বোধ করতে পারছি,- ভগবান রামচন্দ্র যেন এটা বুঝতে পারছিলেন না।  আমার বোধ যেন তাঁর চেয়ে কত্ত বেশী!! অথবা,- ভগবান রামচন্দ্রকে যেন আমরা শেখাতে চেষ্টা করছি,- কিভাবে পত্নীকে ভালবাসতে হয়, গর্ভবতী অবস্থায় নারীর প্রতি কেমন ব্যাবহার করতে হয়।

 রামচন্দ্রের আমলে রাজারা বহুবিবাহ করত। বহুবিবাহকে প্রথম পত্নী মেনে নিতেন স্বাভাবিকভাবেই। শ্রীরামচন্দ্রও ইচ্ছে করলে সীতার পরে একাধিক বিবাহ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সারাজীবন সীতা ভিন্ন অন্যকোন নারীকে গ্রহন না করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। রাবনের মত প্রবল প্রতাপশালী রাজা যখন সীতাকে হরন করে নিয়ে গেল,- তখন সহায় সম্বলহীন বনবাসী রাম কতগুলি অশিক্ষিত জঙ্গলী বানরকে সাথে নিয়ে রাবনের সাথে যুদ্ধ করতে চলে গেলেন,- নিজের প্রানের মায়া না করে। সেই রামচন্দ্রকে পত্নীপ্রেমের আর দায়ীত্বশীলতার পাঠ দিচ্ছি আমাদের মত কতগুলি ব্যাভিচারসম্পন্ন, প্রবৃত্তিপরায়ন নির্বোধ মানুষ!!

 অবশ্য এই রাজনৈতিক নেতাই যদি CBI এর হাত থেকে বাঁচতে পালটি খেয়ে বিজেপিতে গিয়ে নাম লেখায়,- তখন কপালে গেরুয়া তিলক আর গলায় লাল উত্তরীয় ঝুলিয়ে দিনরাত " জয় শ্রীরাম "  নাম জপতে থাকবেন,- তা ভালই জানি। যারা এখন উনার এই ভিডিও নিয়ে খুব ট্রোল করছেন তখন তারাই উনাকে মাথায় নিয়ে খুব নাচানাচি করবে,- ভীষণ রামভক্ত বলে প্রচার করবে। শালাকে বাপ আর বাপকে শালা ডাকতে তাদের একমুহূর্তও দেরী হয়না।

রাবনকে হত্যা করে যখন শ্রীরামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তখন তিনি স্বীয় পত্নীর  সতীত্বের উপর  সামান্যতমও সন্দীহান ছিলেন না।  সীতার উপর তাঁর বিশ্বাস এতটুকু ক্ষুন্ন হয়নি। কারন,- আমাদের চেয়ে সীতাকে নিশ্চয়ই তিনি অনেক ভাল করে জানতেন। কিন্তু সমাজ পরবর্তী সময় সীতার সতীত্ব নিয়ে নানা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারত, চলারপথে   তাকে অপমানমূলক সমালোচনা  বাক্যে দগ্ধ করতে পারত। তাতে  সীতাদেবী  সমাজে অপমানিত বোধ করতেন,  সম্মানহানীমূলক ব্যাবহারের সম্মুখীন হয়ে সংকুচিত  হতে পারতেন। প্রিয় পত্নী সীতাকে সেই  সামাজিক অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে, তার সামাজিক সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে  রামচন্দ্র লোকসমক্ষে অগ্নিপরীক্ষায় ব্যাবস্থা করলেন। যেহেতু সমাজে থাকতেই হবে, তাই সাধারণ মানুষের মুখ বন্ধ করা,  সীতার সামাজিক সম্মান বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী ছিল। সেটা শ্রীরামচন্দ্রের স্বীয়পত্নীর প্রতি যত্ন ও ভালবাসারই লক্ষন। যদিও প্রভু রামচন্দ্রকে সেইজন্য সমালোচনার, প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, নিজ ভ্রাতা লক্ষনের কঠোর বাক্যবানে জর্জরিত হতে হয়েছিল। কিন্তু বিচক্ষন রামচন্দ্র নিজ সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। নিজে ইতিহাসে অপরাধী হয়ে থাকবেন,- তা ভালই জানতেন। কিন্তু পত্নীর সম্মানের জন্য এই অপমান ও দোষারোপ তিনি হাসিমুখে নিজের উপর নিলেন।

পরবর্তী সময় অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে শ্রীরামচন্দ্র রাজসিংহাসনের দায়ীত্ব নিলেন। মাতা সীতা তখন গর্ভবতী। গর্ভস্থ সন্তানের মানসিক সুস্থতা ও মানসিক গড়ন তার মায়ের মানসিক স্থিতির উপর নির্ভর করে,- তা রামচন্দ্র খুব বিলক্ষন  জানতেন। মাতা সীতা যতই সফল অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে থাকুন, - তার সেই গর্ভাবস্থায় রাজবাড়ীর অন্দরমহলের অন্যান্য মহিলাগন, দাসীবৃন্দ ও সখীগন কথায় কথায় লংকার রাবন সম্পর্কে নানা কথা জিজ্ঞেস করছিল। রাবনের সাথে  সীতার বিভিন্ন সাক্ষাতমুহুর্তগুলি সম্পর্কে কৌতুহল প্রকাশ করছিল,সোনার লংকার বিষয়ে নানাকথা জানতে চাইছিল।  তাতে গর্ভবতী সীতাদেবীর মনে বিরক্তির উদ্রেগ হচ্ছিল, দুষ্ট রাবনের স্মরন-মননে বাধ্য হচ্ছিলেন তিনি, মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। যা তার গর্ভস্থ সন্তানের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছিল, সন্তানের মানসিক গঠনের উপর সীতাদেবীর এই হতাশা ও বিরক্তির প্রভাব পড়ছিল। প্রভু রামচন্দ্র  সীতা ও তার গর্ভস্থ সন্তানের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন। সীতাদেবীকে এই পরিবেশ থেকে বের করে কোন পবিত্র, আনন্দ-দায়ক, নির্মল পরিবেশে রাখা প্রয়োজন ছিল যেখানে কেউ রাবন ও লংকা সম্পর্কে কোন বার্তালাপ তার সাথে করবে না। সেই পরিবেশের জন্য ঋষি বাল্মিকীর আশ্রম ছিল আদর্শ জায়গা। তাই লক্ষনকে আদেশ করলেন সীতাকে বাল্মিকীর আশ্রমে সযত্নে রেখে আসতে। হনুমানকে দায়ীত্ব দিলেন সীতার নিরাপত্তার জন্য সদা মোতায়েন থাকতে লুকিয়ে। 

সীতাকে জংগলে ফেলে আসেননি। বনবাসে দেননি। প্রিয় পত্নীকে কাছছাড়া করতে প্রভু রামচন্দ্রের বুকে পাথর রেখে কঠোর হতে হয়েছিল। কিন্তু সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেই মুহুর্তে সীতার জন্য এটাই ছিল মংগলজনক। নিজে সমাজের দৃষ্টিতে অপরাধী হয়ে গেলেন সারা জীবনের জন্য। এই হল মংগলচিন্তক রামের স্বভাব।