Read Pupils and students by Yogi Krishnadev Nath in Bengali মনোবিজ্ঞান | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

ছাত্র এবং স্টুডেন্ট






ছাত্র ও Student — এই শব্দ দুটি পৃথক হলেও এদের আত্মা কিন্তু এক। আমাদের ভারতীয় দর্শন ও পাশ্চাত্য দর্শনের আলোকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই দুটি শব্দ শেষ পর্যন্ত একটি ধারায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। 

ছাত্র ও Student — দুটি ভিন্ন ভাষার শব্দ, দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির ফল। বর্তমান জেনারেশন এই শব্দ দুটির গভীরে গিয়ে কখনোই তলিয়ে দেখে না। সবার একটা কমন ধারণা যে, যারা পড়াশোনার জন্য কোনো না কোনো ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে যুক্ত, তারাই ছাত্র বা Student।
কিন্তু আসলেই কি তাই ? শব্দ আলাদা হলেও এই দুটো শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটাই চিরন্তন আত্মা — জ্ঞান, অনুসন্ধান ও আত্মশুদ্ধির সাধনা।
মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে শিক্ষা কখনোই কেবল বই–খাতা বা বিদ্যালয়ের বেঞ্চে সীমাবদ্ধ ছিল না।
শিক্ষা ছিল এক আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে মানুষ নিজেকে চিনত, নিজেকে গড়ে তুলত, আর সত্যের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত।
এই যাত্রার কেন্দ্রে ছিল এক অনুসন্ধানী মন — ভারতীয় ঐতিহ্যে যাকে বলা হয়েছে ছাত্র,
আর পাশ্চাত্য দর্শনের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে student।
দুই শব্দ, দুই যুগ, দুই ভাষা — কিন্তু আত্মা একটাই।

“ছাত্র” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ধাতু ‘ছদ্’ থেকে, যার অর্থ— আচ্ছাদন করা, ঢেকে রাখা, সুরক্ষা দেওয়া।
এই ধাতুর সঙ্গে ‘ত্র’ প্রত্যয় যোগ হয়ে হয়েছে ‘ছাত্র’।
অর্থাৎ, “যে গুরুর ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে।”
তবে এর ভেতর আরেকটি সূক্ষ্ম তাৎপর্য লুকিয়ে আছে।
‘ছদ্’ ধাতুর একটি অর্থ হলো ছত্র বা ছাতা,
যার প্রতীকী মানে — গুরুর ছত্রছায়া।
যেভাবে ছাতা মানুষকে রোদ–বৃষ্টি থেকে রক্ষা করে,
ঠিক তেমনি গুরু নিজের জ্ঞানের ছায়ায় শিষ্যকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে রক্ষা করেন।

তাই ছাত্র মানে কেবল “যে পড়াশোনা করে” নয়,
বরং “যে গুরুর আশ্রয়ে থেকে নিজেকে শুদ্ধ করে, গঠন করে এবং সত্যের পথে এগিয়ে যায়।”
এখানে ‘ছায়া’ মানে কেবল আশ্রয় নয়, বরং জ্ঞান–আশ্রয় —
যেখানে শিষ্য শুধু শেখে না, নিজেকে রূপান্তরিত করে।

অন্যদিকে “Student” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন “Studēre” থেকে,
যার অর্থ — to be eager, to strive after, to devote oneself,
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোনো জিনিসের প্রতি গভীর আগ্রহে নিজেকে উৎসর্গ করে।
এই শব্দের শিকড় আরও গভীরে গিয়ে মেলে প্রোটো–ইন্দো–ইউরোপীয় ধাতু “steu–”–এর সঙ্গে,
যার মানে — তাড়িত হওয়া, আগ্রহে এগিয়ে যাওয়া, অনুসন্ধানে মগ্ন থাকা।

অতএব “Student” মানে সেই ব্যক্তি,
যিনি জ্ঞানলাভের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত করেন —
যিনি শেখাকে কেবল কর্তব্য নয়, বরং এক সাধনা ও অন্বেষণ হিসেবে দেখেন।

দুটি শব্দের জন্মভূমি আলাদা হলেও তাদের ভিত এক।
একদিকে ছাত্র দাঁড়িয়ে আছে আশ্রয়ের প্রতীকে —
যে জ্ঞানের ছায়ায় থাকে, গুরুর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠে;
অন্যদিকে Student দাঁড়িয়ে আছে অনুসন্ধানের প্রতীকে —
যে নিজে থেকে প্রশ্ন করে, জানার তৃষ্ণায় এগিয়ে যায়।
দু’জনের মিলেই তৈরি হয় শিক্ষার পূর্ণতা —
আশ্রয় + অনুসন্ধান = শিক্ষা।

ছাত্র মানে বিনয়, আর Student মানে অধ্যবসায়।
একজন গ্রহণ করে, অন্যজন অনুসন্ধান করে;
একজন গুরুতে বিশ্বাস রাখে, অন্যজন নিজের ভেতরের গুরুটিকে জাগিয়ে তোলে।
তবু দু’জনের গন্তব্য এক — আত্মজ্ঞান।

আমাদের শাস্ত্রে বলা হয়েছে —

“গুরোঃ অধীনোভবতি ছাত্রঃ।”
অর্থাৎ “যে গুরুর অধীন হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে, সে-ই ছাত্র।”



আর পাশ্চাত্য দর্শন বলে —

“A student is one who strives with devotion.”



দেখা যাচ্ছে, দুটি সংজ্ঞাই এক চিরন্তন সত্যের রূপভেদ —
যে নিজেকে জ্ঞানের পথে সমর্পণ করে, অজ্ঞতার পর্দা সরিয়ে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়,
সেই-ই প্রকৃত ছাত্র, সেই-ই সত্যিকারের student।

একটি শব্দ বলছে আশ্রয়, অন্যটি বলছে অনুসন্ধান,
কিন্তু দুটো মিলে তৈরি করছে জ্ঞানের পরিপূর্ণ বৃত্ত।
ছাত্র শেখায় শ্রদ্ধা ও আত্মসমর্পণ,
Student শেখায় প্রচেষ্টা ও আত্মনিবেদন।
আর এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই জন্ম নেয় সেই শিক্ষার্থী,
যে কেবল তথ্য মুখস্থ করে না, বরং জ্ঞানের আলোয় নিজের পথ খুঁজে নেয়।

সত্যিকারের শিক্ষা তখনই শুরু হয়,
যখন একজন ছাত্র হয়ে ওঠে student —
আর একজন student হয়ে ওঠে চিরন্তন ছাত্র।
তখনই শিক্ষা হয়ে ওঠে আত্মার উপলব্ধি,
যেখানে বইয়ের সীমা ছাড়িয়ে শুরু হয় মানুষের প্রকৃত যাত্রা —
অন্ধকার থেকে আলোয়, অজ্ঞান থেকে জ্ঞানে, মানুষ থেকে মানবতায়।



✍️ — Yogi Krishnadev Nath
📖 For more philosophical writings, visit: ykdonline.in