মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৪৫
ষোড়শ দিনের যুদ্ধের শেষে পাণ্ডবগণের জয় এবং কর্ণ দুর্যোধন ও শল্যের পরামর্শ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
ষোড়শ দিনের যুদ্ধের শেষে পাণ্ডবগণের জয় এবং কর্ণ দুর্যোধন ও শল্যের পরামর্শ
কৌরবসৈন্যের সঙ্গে ত্রিগর্ত, শিবি, শাল্ব, সংশপ্তক, নারায়ণী সেনা, এবং ভাই ও পুত্রদের নিয়ে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা অর্জুনের দিকে চললেন। পতঙ্গ যেমন আগুনে পুড়ে যায় তেমন কৌরব পক্ষের অসংখ্য যোদ্ধা অর্জুনের বাণে বিনষ্ট হলেও তারা পালিয়ে গেলেন না। রাজা শত্ৰুঞ্জয় এবং সুশর্মার ভাই সৌতি নিহত হলেন। সুশর্মার আর এক ভাই সত্যসেন তোমরের আঘাতে কৃষ্ণের বাম বাহু বিদ্ধ করলে কৃষ্ণের হাত থেকে কশা ও রশি পড়ে গেল। অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শানিত ভল্লের আঘাতে সত্যসেনের মাথা কেটে ফেললেন এবং বাণের আঘাতে তাঁর ভাই চিত্রসেনকে বধ করলেন। তার পর অর্জুন ইন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করলে তা থেকে অসংখ্য বাণ সৃষ্টি হয়ে শত্রুবাহিনী ধ্বংস করতে লাগলে কৌরবপক্ষীয় প্রায় সকল সৈন্য যুদ্ধে বিমুখ হয়ে পালিয়ে গেল।
যুদ্ধভূমির অন্য দিকে যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন পরস্পরের প্রতি বাণবর্ষণ করছিলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের রথের চার ঘোড়া ও সারথি বধ কোরে তার রথের পতাকার দণ্ড, ধনু ও খড়্গ বিনষ্ট করলেন। দুর্যোধন বিপন্ন হয়ে রথ থেকে লাফিয়ে নামলে কর্ণ, অশ্বত্থামা, কৃপ প্রভৃতি তাকে রক্ষা করতে এলেন, পাণ্ডবগণও যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে তাকে ঘিরে রইলেন। দুই পক্ষে ভয়ংকর যুদ্ধ হতে লাগল, রণভূমি অগণিত মৃতদেহে ভরে উঠল। কর্ণ পাঞ্চালগণকে, অর্জুন ত্রিগর্তগণকে এবং ভীম কুরুসৈন্য বধ করতে লাগলেন। দুর্যোধন পুনর্বার যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন এবং দুজনে পরস্পরকে বাণের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করলেন। অবশেষে দুর্যোধন গদা নিয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হলে যুধিষ্ঠির জ্বলন্ত উল্কার মতো একটি বৃহৎ শক্তি অস্ত্র দুর্যোধনের প্রতি নিক্ষেপ করলেন। সেই অস্ত্রে দুর্যোধনের বুকে আঘাত করলে তিনি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। ভীম নিজের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে বললেন, মহারাজ, দুর্যোধন আপনার বধ্য নয়। তখন যুধিষ্ঠির যুদ্ধে নিবৃত্ত হলেন।
কর্ণের সঙ্গে সাত্যকির যুদ্ধ হচ্ছিল। সন্ধ্যায় কৃষ্ণ ও অর্জুন শিবপূজা কোরে কৌরবসৈন্যের দিকে এগিয়ে গেলেন। তখন দুর্যোধন, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা, কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে অর্জুন, সাত্যকি ও অন্যান্য পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণের ঘোর যুদ্ধ হতে লাগল। অর্জুনের বাণবর্ষণে কৌরবসৈন্য বিধ্বস্ত হোলো। কিছুকাল পরে সূর্য অস্ত গেলে, অন্ধকার ও ধূলিতে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। এই অবস্থাত্য রাত্রিযুদ্ধের ভয়ে কৌরবযোদ্ধাগণ তাদের সেনা সরিয়ে নিয়ে গেলে আর বিজয়ী পাণ্ডবগণ খুশি হয়ে শিবিরে ফিরে গেলেন।
শত্রুর কাছে পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়ে কৌরবগণ শিবিরে ফিরে এসে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, অর্জুন দৃঢ়, দক্ষ ও ধৈর্যশীল, আবার কৃষ্ণ তাকে যথাযোগ্য মন্ত্রণা দিয়ে থাকেন। আজ সে অতর্কিতে অস্ত্রপ্রয়োগ কোরে আমাদের পরাজিত করেছে, কিন্তু কাল আমি তার সকল পরিকল্পনা নষ্ট করবো।
পরদিন সকালে কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, আজ আমি হয় অর্জুনকে বধ করবো নতুবা তার হাতেই নিহত হবো। আমি আর অর্জুন এপর্যন্ত নানা দিকে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলাম, সেজন্য আমাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি। আমাদের পক্ষের প্রধান বীরগণ হত হয়েছেন, ইন্দ্রদত্ত শক্তি অস্ত্রও আর আমার কাছে নেই। তথাপি অস্ত্রবিদ্যায়, বীরত্বে ও জ্ঞানে অর্জুন আমার সমকক্ষ নয়। যে ধনুর দ্বারা ইন্দ্র দৈত্যগণকে জয় করেছিলেন, ইন্দ্র যে ধনু পরশুরামকে দিয়েছিলেন, যার দ্বারা পরশুরাম একুশ বার পৃথিবী জয় করেছিলেন, সেই ধনু পরশুরাম আমাকে দান করেছেন, বিজয় নামক সেই ভয়ংকর দিব্য ধনু গাণ্ডীব ধনুর চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সেই ধনু দিয়ে আমি যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করবো। কিন্তু যে যে বিষয়ে অর্জুন আমার তুলনায় শ্রেষ্ঠ তাও আমার অবশ্য বলা উচিত। অর্জুনের ধনুতে দিব্য জ্যা আছে, তার দুই অক্ষয় তূণীর আছে, আর কৃষ্ণ তার সারথি ও রক্ষক। তার অগ্নিদত্ত দিব্য অচ্ছেদ্য রথ আছে, তার রথের ঘোড়াগুলি অত্যন্ত দ্রুতগামী এবং রথের পতাকার উপর যে বানর আছে তাও ভয়ংকর। তথাপি তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করবো। শল্য কৃষ্ণের সমতুল্য, তিনি যদি আমার সারথি হন তবে নিশ্চয় তোমার বিজয়লাভ হবে। অনেকগুলি গাড়ি আমার বাণ ও নারাচ বহন কোরে নিয়ে যাবে, উত্তম ঘোড়া চালিত বহু রথ আমার পিছনে থাকবে। ঘোড়ার বিষয়ে শল্যের মতো অভিজ্ঞ কেউ নেই, তিনি আমার সারথি হলে ইন্দ্রাদি দেবগণও আমার কাছে পরাজিত হবেন।
দুর্যোধন বললেন, কর্ণ, তুমি যা চাও তাই হবে। তার পর দুর্যোধন শল্যের কাছে গিয়ে সবিনয়ে বললেন, কর্ণ আপনাকে সারথি রূপে বরণ করতে চান। আমি সবিনয়ে প্রার্থনা করছি, ব্রহ্মা যেমন সারথি হয়ে মহাদেবকে রক্ষা করেছিলেন, কৃষ্ণ যেমন সমস্ত বিপদ থেকে অর্জুনকে রক্ষা করছেন, আপনিও সেইরূপ কর্ণকে রক্ষা করুন। পাণ্ডবরা ছলনা কোরে মহাধনুর্ধর বৃদ্ধ ভীষ্ম ও দ্রোণকে হত্যা করেছে, আমাদের বহু যোদ্ধা যথাশক্তি যুদ্ধ কোরে নিহত হয়েছে। পাণ্ডবরা বলবান, স্থিরচিত্ত ও বিক্রমশালী, আমাদের অবশিষ্ট সৈন্য যাতে তারা নষ্ট না করতে পারে আপনি তার উপায় করুন। আমাদের সেনার প্রধান বীরগণ নিহত হয়েছেন, কেবল আমার হিতৈষী মহাবল কর্ণ আছেন এবং বিখ্যাত মহারথ আপনি আছেন। জয়লাভ সম্বন্ধে কর্ণের উপর আমার বিপুল আশা আছে, কিন্তু আপনি ভিন্ন আর কেউ তার সারথি হতে পারেন না। অতএব, কৃষ্ণ যেমন অর্জুনের, আপনি সেইরূপ কর্ণের সারথি হন। অরুণের সঙ্গে সূর্য যেমন অন্ধকার দূর করেন আপনি তেমন কর্ণের সাথে মিলিত হয়ে অর্জুনকে বিনষ্ট করুন। নিজের কূল, ঐশ্বর্য, শাস্ত্রজ্ঞান ও শক্তির জন্য শল্যের গর্ব ছিলো। তিনি দুর্যোধনের কথায় ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এমন কাজে তুমি আমাকে নিযুক্ত করতে পারো না, উচ্চ জাতি নীচ জাতির দাসত্ব করে না। আমি উচ্চবংশীয়, মিত্ররূপে তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। তুমি যদি আমাকে কর্ণের সারাথি করো তবে অধমকে উত্তম করা হবে, ক্ষত্রিয় কখনও সূতজাতির আজ্ঞাবহ হতে পারে না। আমি রাজর্ষিকুলজাত মহারথ বলে বিখ্যাত। আমি সূতপুত্রের সারথি হতে পারি না। দুর্যোধন, তুমি আমার অপমান করছ, কর্ণকে আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করছ। কর্ণ আমার ষোল ভাগের এক ভাগও নয়। আমি সামান্য লোক নই, তোমার পক্ষে যোগ দিয়ে অপমানিত হয়ে আমি যুদ্ধ করতে পারি না। অতএব, আমাকে অনুমতি দাও আমি আমার রাজ্যে ফিরে যাই। এই কথা বলে শল্য রাজাদের মধ্য থেকে উঠে ফিরে যেতে উদ্যত হলেন।
তখন দুর্যোধন সসম্মানে শল্যকে ধরে সবিনয়ে মিষ্টবাক্যে বললেন, আপনি যা বললেন তা যথার্থ, কিন্তু আমার অভিপ্রায় শুনুন। কর্ণ বা অন্য কোনও রাজা আপনার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নন, কৃষ্ণও আপনার বিক্রম সইতে পারবেন না। আপনি যুদ্ধে শত্রুদের কাছে কাঁটা বা শল্যের মতো, সেজন্যই আপনার নাম শল্য। কর্ণ বা আমি আপনার অপেক্ষা বলবান নই, তথাপি আপনাকে যুদ্ধে সারথিরূপে বরণ করছি। কারণ, আমি কর্ণকে অর্জুন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করি এবং লোকে আপনাকে কৃষ্ণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কৃষ্ণ যেমন ঘোড়ার বিষয়ে অভিজ্ঞ, আপনি তার চেয়ে দ্বিগুণ অভিজ্ঞ।
শল্য দুর্যোধনকে বললেন, তুমি এই সৈন্যদের মধ্যে আমাকে কৃষ্ণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলছ সেজন্য আমি প্রীত হয়েছি। কর্ণ যখন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন তখন আমি তার সারথি হবো, কিন্তু এই নিয়ম থাকবে যে আমি তাকে আমার যা ইচ্ছা হবে তাই বলবো। দুর্যোধন ও কর্ণ শল্যের কথা মেনে নিয়ে বললেন, তাই হবে।
______________
(ক্রমশ)