Read Story of Mahabharat Part 152 Fight of Ashwaththama and Karna with Yudhisthir and Arjun on 17th day by Ashoke Ghosh in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 152

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৫২

সপ্তদশ দিনে অশ্বত্থামা ও কর্ণের সাথে যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের যুদ্ধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

সপ্তদশ দিনে অশ্বত্থামা ও কর্ণের সাথে যুধিষ্ঠির ও অর্জুনের যুদ্ধ

সপ্তদশ দিনে যুদ্ধ চলার সময় দুর্যোধন তার ভাইদের বললেন, কর্ণ বিপদে পড়েছেন, তোমরা শীঘ্র গিয়ে তাকে রক্ষা করো। তখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সকল দিক থেকে ভীমকে আক্রমণ করলেন। ভীমের ভল্ল ও নারাচের আঘাতে দুর্যোধনের ভাই বিবিৎসু, বিকট, ক্ৰাথ, নন্দ ও উপনন্দ নিহত হলেন। কর্ণ ভীমের ধনু ও রথ বিনষ্ট করলে ভীম গদা নিয়ে শত্রুসৈন্য বধ করতে লাগলেন।

এই সময়ে সংশপ্তক, কোশল ও নারায়ণ সৈন্যের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ হচ্ছিল। সংশপ্তকগণ অর্জুনের রথ ঘিরে ফেলে তার রথের ঘোড়া, চাকা ও দণ্ড ধরে গর্জন করতে লাগল। কয়েকজন কৃষ্ণের দুই বিশাল বাহু ধরলে দুষ্ট হাতি যেমন চালককে নিধন করে, কৃষ্ণ তেমন তার হাত দিয়ে সংশপ্তকগণকে নিধন করলেন। অর্জুন নাগপাশ অস্ত্র প্রয়োগ কোরে অন্যান্য সংশপ্তকদের সাপ দিয়ে বেঁধে ফেললে তারা বন্দী হয়ে রইল। তখন মহারথ সুশর্মা গরুড় অস্ত্র প্রয়োগ করলে সাপগুলি ভয়ে পালিয়ে গেল। অর্জুন ঐন্দ্র অস্ত্র নিক্ষেপ করলে, তা থেকে অসংখ্য বাণ বেরিয়ে শত্রুসৈন্য সংহার করতে লাগল। সংশপ্তকদের চোদ্দ হাজার পদাতিক, দশ হাজার রথী এবং তিন হাজার গজারোহী যোদ্ধা ছিলো, তাদের মধ্যে দশ হাজার অর্জুনের বাণের আঘাতে নিহত হোলো।

কৌরবসৈন্য অর্জুনের ভয়ে আতঙ্কিত হয়েছে দেখে কৃতবর্মা, কৃপ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, শকুনি, উলূক এবং ভাইদের সঙ্গে দুর্যোধন তাদের রক্ষা করতে এলেন। শিখণ্ডী ও ধৃষ্টদ্যুম্ন কৃপাচার্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অশ্বত্থামা আসংখ্য বাণ নিক্ষেপ কোরে পাণ্ডবসৈন্য বধ করছেন দেখে সাত্যকি, যুধিষ্ঠির, প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতি পাঁচ সহোদর এবং অন্যান্য বহু বীর সকল দিক থেকে তাকে আক্রমণ করলেন। যুধিষ্ঠির ক্রুদ্ধ হয়ে অশ্বত্থামাকে বললেন, তোমার মধ্যে কৃতজ্ঞতা নেই তাই তুমি আমাকেই বধ করতে চাইছ। ব্রাহ্মণের কাজ তপস্যা, দান ও অধ্যয়ন, তুমি নিকৃষ্ট ব্রাহ্মণ তাই ক্ষত্রিয়ের কাজ করছ। অশ্বত্থামা একটু হাসলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের কথা ন্যায্য ও সত্য জেনে কোনও উত্তর দিলেন না, তাঁর প্রতি বাণ বর্ষণ করতে থাকলেন। তখন যুধিষ্ঠির সত্বর রণভূমি থেকে চলে গেলেন।

দুর্যোধনের সঙ্গে ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘোর যুদ্ধ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের রথ নষ্ট হওয়ায় তিনি অন্য রথে উঠে চলে গেলেন। তখন কর্ণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে আক্রমণ করলেন। সিংহ যেমন হরিণের দলকে আতঙ্কিত করে, কর্ণ তেমন পাঞ্চাল-রথিগণকে আতঙ্কিত করতে লাগলেন। তখন যুধিষ্ঠির আবার রণস্থলে এসে শিখণ্ডী, নকুল, সহদেব, সাত্যকি, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং অন্যান্য যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে কর্ণকে ঘিরে ধরলেন। অন্যদিকে বাহ্লীক, মদ্র, সিন্ধু প্রভৃতি দেশের সৈন্যের সঙ্গে ভীম একাই যুদ্ধ করতে লাগলেন।

অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন,  এই সংশপ্তক সৈন্য পালিয়ে যাচ্ছে, এখন কর্ণের কাছে রথ নিয়ে চলো। কৃষ্ণ তখন অর্জুনের রথ কৌরববাহিনীর মধ্যে নিয়ে এলো। অশ্বত্থামা অর্জুনকে বাধা দিতে এলেন এবং শত শত বাণ নিক্ষেপ করে কৃষ্ণ ও অর্জুনকে আটকে দিলেন। অশ্বত্থামা অর্জুনকে আটকে দিচ্ছেন দেখে কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তোমার শক্তি আগের মতো আছে কি? তোমার হাতে গাণ্ডীব আছে তো? গুরুপুত্র মনে কোরে তুমি অশ্বত্থামাকে উপেক্ষা কোরো না। তখন অর্জুন দ্রুত ভল্লের আঘাতে অশ্বত্থামার রথ ও অস্ত্রশস্ত্র নষ্ট করলে এবং অশ্বত্থামা অচেতন হওয়ায় তার সারথি তাকে রণস্থল থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

এই সময়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দুর্যোধনাদির ঘোর যুদ্ধ হচ্ছিল। কৌরবরা যুধিষ্ঠিরকে ধরবার চেষ্টা করছে দেখে ভীম, নকুল, সহদেব ও ধৃষ্টদ্যুম্ন বহু সৈন্য নিয়ে তাকে রক্ষা করতে এলেন। কর্ণ বাণবর্ষণ করে সকলকেই নিরস্ত করলেন, যুধিষ্ঠিরের সৈন্য বিধ্বস্ত হয়ে পালাতে লাগল। কর্ণ তিনটি ভল্ল নিক্ষেপ করে যুধিষ্ঠিরের বুকে আঘাত করলেন। যুধিষ্ঠির রথে বসে পড়ে তার সারথিকে বললেন, ফিরে যাও। তখন দুর্যোধন ও তাঁর ভাইয়েরা যুধিষ্ঠিরকে ধরবার জন্য সকল দিক থেকে ধাবিত হলে কেকয় ও পাঞ্চালবীরগণ তাদের বাধা দিতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির ক্ষতবিক্ষত শরীরে নকুল ও সহদেবের মধ্যে থেকে শিবিরে ফিরছিলেন এমন সময় কর্ণ আবার তাকে তিন বাণে বিদ্ধ করলেন এবং নকুল ও সহদেব কর্ণকে বাণ নিক্ষেপ কোরে আহত করলেন। তখন যুধিষ্ঠির ও নকুলের রথের ঘোড়া বধ কোরে কর্ণ ভল্লের আঘাতে যুধিষ্ঠিরের শিরস্ত্রাণ কেটে ফেললে যুধিষ্ঠির ও নকুল আহত শরীরে সহদেবের রথে উঠলেন।

শল্য কর্ণকে বললেন, তুমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ না কোরে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ করছ কেন? এতে তোমার অস্ত্রশস্ত্রের বৃথা ক্ষয় হবে, তূণীর বাণশূন্য হবে, সারথি ও ঘোড়া ক্লান্ত হবে, তুমিও আহত হবে। এমন অবস্থায় অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে লোকে তোমাকে উপহাস করবে। তুমি অর্জুনকে মারবে বলেই দুর্যোধন তোমার সম্মান করেন, যুধিষ্ঠিরকে মেরে তোমার কি হবে? ওই দেখ, ভীম দুর্যোধনকে পীড়ন করছেন, তুমি দুর্যোধনকে রক্ষা করো। তখন যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেবকে ছেড়ে কর্ণ দ্রুত দুর্যোধনের দিকে গেলেন।

যুধিষ্ঠির লজ্জিত হয়ে ক্ষতবিক্ষত শরীরে শিবিরে ফিরে এলেন এংব রথ থেকে নেমে শয়নকক্ষে প্রবেশ করলেন। তার দেহে যে সমস্ত বাণ বিঁধে ছিলো তা তুলে ফেলা হোলো, কিন্তু তার মনের যন্ত্রণা দূর হোলো না। তিনি নকুল ও সহদেবকে বললেন, তোমরা দ্রুত ভীমের কাছে যাও, সে একা যুদ্ধ করছে।

এদিকে কর্ণ তার বিজয় নামক ধনু থেকে ভার্গব অস্ত্র মোচন করলে তা থেকে অসংখ্য বাণ সৃষ্টি হয়ে পাণ্ডবসৈন্য সংহার করতে লাগল। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন, কর্ণের ভার্গব অস্ত্রের শক্তি দেখো, আমি কোনও প্রকারে এই অস্ত্র নিবারণ করতে পারব না, কর্ণের সাথে যুদ্ধে পালাতেও পারব না। কৃষ্ণ বললেন, যুধিষ্ঠির কর্ণের সাথে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তুমি তার সঙ্গে দেখা কোরে তাকে আশ্বাস দাও, তার পর ফিরে এসে কর্ণকে বধ করবে। কৃষ্ণের উদ্দেশ্য কর্ণকে যুদ্ধে ব্যস্ত রেখে পরিশ্রান্ত করা, এজন্যই তিনি অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে চললেন।

______________

(ক্রমশ)