পৌরাণিক দেবতা ও দানব আসলে কী ?
মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু প্রতীক আছে, যেগুলো মানুষের চিন্তার আদিম স্তরগুলোর একেকটি কোড। “দেবতা” ও “দানব” সেই রকমই দুটি কোড বা প্রতীক।
এখনকার মানুষ এদের নাম শুনলেই ভালো-মন্দের লড়াই বলে কল্পনা করে। মানুষ মনে করে, দেবতা মানে পুণ্য, দানব মানে পাপ। কিন্তু আমাদের প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান এভাবে ভাবত না। ভারতীয় চিন্তার মূল কথা ছিল, বিরোধ নয়, ভারসাম্য। দেবতা ও দানব আসলে মানুষের চেতনা ও পদার্থবিজ্ঞানের দুই প্রান্ত। এই দুইয়ের পারস্পরিক সংঘাত, প্রতিযোগিতা ও সহযোগিতাই সভ্যতার বিবর্তনের পেছনে অন্যতম ইন্ধন হিসেবে কাজ করে এসেছে।
ঋষি কশ্যপের তিন স্ত্রী - অদিতি, দিতি ও দনু। এই তিন ঋষিপত্নী হলেন তিন প্রবাহের উৎস। অদিতির সন্তানরা দেবতা। তাঁরা ছিলেন আলোক, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ধারক। দিতির সন্তানরা অসুর। তাঁরা ছিলেন শক্তি, প্রাণশক্তি ও প্রকৃতির কার্যকারিতা নিয়ে ব্যস্ত। দনুর সন্তানরা দানব। তাঁরা ছিলেন প্রকৃতির গভীর রহস্য, প্রযুক্তি ও পদার্থবিজ্ঞানের অনুসন্ধানী। 
অদিতি মানে সীমাহীনতা; দিতি মানে বিভাজন; আর দনু মানে প্রবাহ বা স্রোত। অদিতি হলেন চেতনার অসীমতার প্রতীক, দিতি হলেন জীবনীশক্তি ও শক্তির প্রতীক, আর দনু হলেন জ্ঞানের অন্তঃপ্রবাহের প্রতীক। 
একজন খুঁজেছেন আত্মার আলোক, অন্যজন পদার্থের গঠন, আর তৃতীয়জন প্রকৃতির সূত্র। এই তিন শক্তির মেলবন্ধনেই মানুষ নিজের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডকে আবিষ্কার করতে পেরেছে।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস এই ভারসাম্য হারিয়েছে। যখন দর্শন শাসন করেছে, তখন বিজ্ঞানকে “অসুর” বলা হয়েছে; আর যখন বিজ্ঞান প্রভাব বিস্তার করেছে, তখন দর্শনকে অন্ধবিশ্বাস বলা হয়েছে। তবুও ইতিহাসের গহনে এই দুইয়ের মিলনের কিছু মুহূর্ত থেকে গেছে, যেমনটি আমরা দেখি সমুদ্র মন্থনের কাহিনিতে।
সমুদ্র মন্থনের দৃশ্য ভারতীয় পুরাণের এক মহাসংকেত। এখানে সমুদ্র কোনো জলরাশি নয়, বরং অসীম জ্ঞানের প্রতীক। দেবতা ও দানব দুই পক্ষ মিলে সেই জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে চায়, কেউ অমৃত খুঁজতে, কেউ খুঁজতে শক্তি। তাঁরা একত্রে মন্থন করে, অর্থাৎ তাঁরা একত্রে গবেষণা করে, চিন্তা করে, পরিশ্রম করে।
সেই মন্থন থেকে একে একে উঠে আসে - বিষ, রত্ন, ঐশ্বর্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, অগ্নি, সুরা, কামধেনু, ধন্বন্তরী, আর শেষ পর্যন্ত অমৃত।
এটাই মানবসভ্যতার প্রকৃত রূপক। যখন দর্শন (দেবতা) আর বিজ্ঞান (দানব) একসঙ্গে কাজ করে, তখন জ্ঞানের সমুদ্র থেকে উঠে আসে অমৃত - যা জীবনের অমরত্ব নয়, বরং চেতনার অমরত্ব প্রদান করে। এই কাহিনিই আমাদের শেখায় - যখন বিজ্ঞান দর্শনের দিকনির্দেশনায় চলে, তখন সে হয় মানবমুখী; আর যখন দর্শন বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে নিজেকে যাচাই করে, তখন সে বাস্তব হয়। এই দুই শক্তি একসঙ্গে কাজ করলে মানুষ অমরত্ব পায় - শরীর নয়, চেতনার স্তরে।
দানবরা অজ্ঞ ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন প্রকৃতিপূজক, পর্যবেক্ষক, গবেষক। তাঁদের গুরুশ্রেষ্ঠ ময়দানব রচনা করেছিলেন সূর্যসিদ্ধান্ত - যা পৃথিবীর ঘূর্ণন, গ্রহের গতি, সূর্য ও চন্দ্রের সময়চক্র নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। তাঁর আবিষ্কার আধুনিক বিজ্ঞানের হাজার হাজার বছর আগের কথা। তবুও তাঁকে বলা হলো “দানব”, কারণ তিনি প্রকৃতির অন্তরযন্ত্রে প্রবেশ করেছিলেন - যেখানে দেবতারা ছিলেন চেতনার ধ্যানে মগ্ন।
এই বিভাজনই মানব সভ্যতার দ্বন্দ্বের সূচনা। কিন্তু ময়দানব আসলে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন - আলো ও পদার্থ আলাদা নয়, দেবতা এবং দানবও আসলে এক অপরের প্রতিবিম্ব।
একই সত্য আমরা দেখতে পাই মহারাজ বলির কাহিনিতেও। বামন অবতার যখন তাঁকে পাতাললোকে পাঠালেন, তখন সেটি ছিল না কোনো শাস্তি - বরং এক নতুন সভ্যতার প্রতিষ্ঠা।
পুরাণ বলে, সেই পাতাল ছিল দীপ্ত, সুরম্য, ও বিজ্ঞানে উন্নত - যেখানে জ্ঞান, সংগীত, স্থাপত্য, শক্তি, সব একসঙ্গে চলত। কিছু গবেষক বলেন, বলি তখনকার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শাসক, সম্ভবত বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার “বালি” দ্বীপ সেই ইতিহাসেরই ছায়া। গতকাল রণবীর এলাহাবাদিয়ার একটি পডকাস্টে দেখলাম, জনৈক গবেষক বলছেন - এই ঘটনা অর্থাৎ বামন ও বলির ঘটনা ঘটেছিল প্রায় পঁচিশ হাজার বছর আগে; যখন পৃথিবীর জলস্তর অনেক নিচে ছিল, আর মানবসভ্যতা বিভিন্ন দিকের সঙ্গে যুক্ত ছিল। অতল, সুতল, রসাতল - এই সাত পাতাললোকের বর্ণনা আসলে সেইসব প্রাচীন, হারিয়ে যাওয়া প্রযুক্তি ও নগরসভ্যতার প্রতীক হতে পারে, যেগুলো পৃথিবীর ইতিহাস থেকে আজ বিলুপ্ত। কিন্তু আজও বেঁচে আছে আমাদের পুরাণের মধ্যে।
দেবতা মানে চেতনা, দানব মানে শক্তি। দেবতা মানে আদর্শ, দানব মানে প্রয়োগ। দেবতা মনোযোগ দেয় অভ্যন্তরে, দানব মনোযোগ দেয় বহির্জগতে। এঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু সেই দ্বন্দ্বই তো জীবনের চলার সুর। দেবতা ও দানব একত্রে মন্থন না করলে অমৃত আসে না; তেমনি দর্শন ও বিজ্ঞান একত্র না হলে সত্য আসে না।
আজও পৃথিবী সেই সমুদ্র মন্থনের মধ্যেই রয়েছে। প্রযুক্তি আর চেতনা, জ্ঞান আর বিশ্বাস, তথ্য আর প্রজ্ঞা - সব একসঙ্গে ঘূর্ণায়মান। আমরা আজ যদি এই দুই শক্তিকে একত্র করি, তাহলে আবারও মানবসভ্যতা অমৃতের সন্ধান পাবে - অমরত্বের নয়, অমৃতত্বের; যেখানে মানুষ বুঝবে সে প্রকৃতিরই এক অংশ, আর প্রকৃতিই তার ভেতরের দেবতা ও দানব উভয়ই।
সমুদ্র মন্থন এখনো শেষ হয়নি। শুধু তার দড়িটা বদলে গেছে। আগে ছিল নাগরাজ বাসুকি, এখন তার জায়গায় আছে জ্ঞানের তার, প্রযুক্তির তার, ইন্টারনেটের তার, মস্তিষ্কের স্নায়ু।
দেবতা এখন চিন্তক, দানব এখন বিজ্ঞানী, আর সমুদ্রটা এখন আমাদের নিজস্ব চেতনার গভীরতায়। যখন আমরা আবার একত্রে মন্থন করব, তখনই সেই অমৃত উঠবে - যা মানুষকে অমর করবে তার দেহ নয়, তার বোধে।