Read It is not the job of a guru to demonstrate miraculous powers. by DR RAJESH CHOUDHURI in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন গুরুর কাজ নয়


জন্মগত সংস্কার হোক,অজ্ঞতাই হোক,- অথবা পরিবার ও সমাজের শিক্ষাই হোক,- ঈশ্বর, গুরু বা আচার্য্যের সাথে অলৌকিকতার একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক আমাদের বিশ্বাসের জগতে বিদ্যমান। গুরু বা আচার্য্যদেব অবশ্যই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবেন,- এই একটা ধারনা আমাদের মনে গভীরভাবে বসে আছে। শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব বা শ্রীশ্রীঅবিনদাদার  লৌকিক গুনাবলী, মানবিক বৈশিষ্ট্য,  চারিত্রিক সৌন্দর্য, আদর্শে আপ্রানতা, নিষ্ঠা, প্রেম, সেবাপ্রানতা,ব্যাক্তিত্ব   ইত্যাদির উদাহরন ও আলোচনা আমাদের কাছে যতটা আকর্ষনীয় ও চর্চার বিষয়,- তার চেয়ে বহুগুন বেশী আকর্ষনীয়  যেন তাঁদের কোন অলৌকিক ঘটনা। কোন একটা অলৌকিক ঘটনা লিখে ফেইসবুকে পোস্ট করুন, বা ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে ছেড়ে দিন,- তবেই হল। হাজারে হাজারে মানুষ সেই লেখা বা ভিডিও শেয়ার করবে, প্রত্যেকের কাছে বলে বেড়াবে। যে যতবেশি অলৌকিক ঘটনা চর্চা করবে,- সে তত বড় ভক্ত!! যে যতবেশি অলৌকিক গল্প বলতে পারে,- তার অনুরাগী তত বেশী। অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করাই যেন শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব বা পূজ্যপাদ অবিনদাদার কাজ!!

পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের জীবনযাত্রা যদি লক্ষ করি তবে দেখতে পাব,- Punctuality র জীবন্ত মূর্তি তিনি। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় বছরের প্রত্যেকদিন নিজ বাসভবন থেকে পায়ে হেঁটে ঠাকুর বাংলায়  প্রার্থনায় যোগদান করা, - এক্কেবারে কাঁটায় কাঁটায় প্রার্থনার সময় এসে উপস্থিত হওয়া,- এ এক চরম বিস্ময়। কখনো এমন হয়নি যে তিনি প্রার্থনার দশমিনিট পূর্বে এসে বসে আছেন,- বা দশমিনিট পরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। সময়ের এমন অদ্ভুত জ্ঞান,- এই চরম নিয়মানুবর্তিতা তাঁর চরিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তা অবশ্যই আমাদের অনুসরনীয় এবং আলোচ্য।

প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে হাজার হাজার মানুষের সমস্যা শুনা এবং সেই সমস্যার নিরসন করা, - এ তাঁর অপার্থিব প্রেম, সহানুভূতি ও ইষ্টপ্রানতার নিদর্শন। আপনি আমি  পর পর চার পাঁচজনের সমস্যা শুনলেই বিরক্ত হয়ে যাই,- তিনি প্রতিদিন, বছরের পর বছর হাজার হাজার মানুষের সমস্যা শুনছেন এবং মুহুর্তে সেই সমস্যা নিরসনের ব্যাবস্থা করছেন। তাঁর  এই  সেবাপ্রানতা, প্রেম আমাদের শিক্ষনীয়, আলোচ্য।

সারাক্ষন শুধুমাত্র ঠাকুরকে নিয়েই কথা, শুধু ঠাকুরের স্বার্থরক্ষা, ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা, - এর বাইরে কোন চিন্তা নেই, কোন কথা নেই। চব্বিশ ঘন্টা শুধুমাত্র ঠাকুরকে মাথায় ধারন করা তাঁর আচরন থেকে আমরা শিখি।

শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর বানীসাহিত্যে একটি শব্দ ব্যাবহার করেছেন,-" ক্লেশসুখপ্রিয়তা"। এই শব্দটির বাস্তব রূপ দেখেছি আচার্য্যদেবের একশদিনের দীক্ষা পরিক্রমায়। এর বাস্তব রূপ দেখেছি পূজ্যপাদ অবিনদাদার ডিপি ওয়ার্ক সংক্রান্ত প্রস্তুতির সময়। তাদের এই ক্লেশসুখপ্রিয়তা আমাদের শিক্ষনীয়।

পূজ্যপাদ অবিনদাদার মধ্যে এই অল্প বয়সেই যে সাংগঠনিক ক্ষমতা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি,  বিচক্ষনতা, ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠার তাগিদ,  যে প্রেম, যে সহানুভূতি,দায়ীত্বশীলতা, পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য  দেখতে পাচ্ছি আমরা,- সেই লৌকিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলিই আমাদের চর্চার বিষয় হোক।

আচার্য্যদেব যেমন ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ  সেবক,- তেমনি  তিনি আদর্শ স্বামী, আদর্শ পিতা, আদর্শ ভাই, আদর্শ পুত্র, আদর্শ পরিবারের কর্তা। তাঁকে দেখে আমরা আদর্শ সংসারী হওয়ার শিক্ষা পাই। কেমন করে মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, কেমন করে কথায় কাজে মিল রাখতে হয়, কেমন করে আদর্শ রক্ষায় কঠোর হতে হয়, কেমন করে ঠাকুরকে ভালবাসতে হয়, কেমন করে সৎ হতে হয়- তাই আমরা দেখি শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব, শ্রীশ্রীঅবিনদাদা বা গুরু পরিবারের অন্যান্যদের মধ্যে। তাদের এই মানবিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিই আমাদের আলোচ্য বিষয় হোক, আমাদের আকর্ষনের মূল বিষয় হোক, আমাদের অনুসরনীয় হোক।

কিন্তু প্রায়শই দেখা যায়,- এইসব মানবিক বা লৌকিক গুনাবলী বাদ দিয়ে শুধুমাত্র তাদের অলৌকিক ঘটনাগুলো চর্চা করতেই আমরা পছন্দ করি। কেউ একজন নাকি বিনা অনুমতিতে আচার্য্যদেবের ফটো তুলেছিলেন,- সেই ফটোতে নাকি আচার্য্যদেবের হাত নেই,- ইউটিউবে এই ঘটনা একজন নাটকীয় ভাবে বললেন আর হাজার হাজার মানুষ হামলে পড়ে শেয়ার করছে। কোন ছেলের মাথায় নাকি টিউমার হয়েছিল,- আর পূজ্যপাদ অবিনদাদা ক্রিকেট খেলার ছলে বল ছুড়ে সেই টিউমার সারিয়ে দিলেন। আচার্য্যদেব কার দিকে তাকাতেই তার রোগ ভাল হয়ে গেল, তিনি আকাশের দিকে তাকাতেই বৃষ্টি থেমে গেল,- ইত্যাদি নানা অদ্ভুত অলৌকিক সব গল্প প্রচার করে আমরা যে তাঁর অবমাননা করছি,- সেটা বুঝতেই পারিনা। হাজারে হাজারে শেয়ার হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ লাইক কমেন্ট আর চর্চা,- এইসব অলৌকিক ঘটনার। এইসব অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য, ছুঁ মন্তর করে সব ঠিক করে দেওয়ার জন্য, মনের কথা বলে নিজের অন্তর্যামীত্বের প্রচার করার জন্য আজকাল দেশে রঙ বেরঙের পোশাক, পাগড়ী ও  অলংকার পরিবৃত বহু প্রবচনকারী বাবা,  বিশাল ক্ষমতাধর স্বামী বা স্বঘোষিত গুরু আছেন। যদি অলৌকিক ক্ষমতা নিয়েই চর্চা করতে হয়,- তাদের কাছে গেলেই হয়। আচার্য্যদেব বা পূজ্যপাদ অবিনদাদা এইসব অলৌকিক বা ছুঁ মন্তর জাত ক্ষমতা দেখাতে আসেন নি পৃথিবীতে।

আচার্য্যদেব নিজেই বহুবার বলেছেন,- " আমার যদি এই ক্ষমতা থাকত তবে আমার ছেলের অসুস্থতার সময় আমি তাকে ডাক্তারের কাছে না নিয়ে তার মাথায় হাত ছুইয়ে দিতাম। ছেলের পরীক্ষার সময় তার কলমটা কপালে ঠেকিয়ে দিতাম,- তার পরীক্ষা ভাল হয়ে যেত। "  তাঁকে বহুবার বলতে শুনেছি,-" আইন্সটাইনের হাতেখড়ি কে দিয়েছিল রে?"

তাঁর যদি সত্যিই সেই অলৌকিক ক্ষমতা থাকত যে তিনি কারো দিকে তাকিয়েই রোগ ভাল করে দিতে পারেন,- তবে পৃথিবীর সবাই রোগমুক্ত হয়ে যেত। কারন তিনি তো পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে ভালবাসেন, তিনি প্রত্যেকের সুস্থতা কামনা করেন, তাঁর একান্ত ইচ্ছা আমরা ভাল থাকি। তবে আমরা তাঁর সামনে গেলেই তিনি একবার করে তাকাতেন, - আর আমরা রোগমুক্ত হয়ে যেতাম। তিনি সারাদিন বসে বসে তাই করতেন।

তিনি বার বার বলছেন,-" যদি ঈশ্বর সব জানতেন তবে সীতা হরনের পর শ্রীরামচন্দ্র কেঁদে আকুল হয়ে জনে জনে সীতার খোঁজ জিজ্ঞেস করতেন না।" যদি শ্রীশ্রীঠাকুরের অলৌকিক ক্ষমতা থাকত তবে মাতা মনমোহিনী দেবীকে তিনি দেহত্যাগ করতে দিতেন না৷ তিনি তাঁর প্রানপ্রিয় মাতৃদেবীকে হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদতেন না।

শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব বার বার বলছেন,-" অন্তর্যামীত্ব মানে মনের কথা বলে দেওয়ার ক্ষমতা নয়। বরং,- তাঁকে ভালবাসলে, তাঁর কাছে উম্মুক্ত হলে তিনি আমার অন্তর্জগত নিয়ন্ত্রন করে দিতে পারেন,- এটাই অন্তর্যামীত্ব। "

হ্যা,- শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রী আচার্য্যদেব, পূজ্যপাদ অবিনদাদা বা গুরু পরিবারের কারো কোন কোন আচরন ও কর্ম আমাদের সাধারণ ধারনা ও বুদ্ধির বাইরে থাকতে পারে। তাদের দ্বারা কৃত অনেক কিছুরই কার্যকারণ আমরা বুঝতে পারিনা, আমাদের স্বাভাবিক বোধ-বুদ্ধি ও জ্ঞানের বাইরে থাকে। সেইগুলিকেই আমরা অলৌকিক ভাবি।

তার কারন,- তাঁদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি,  তাদের Will power,  কোন বিষয়ের কার্যকারণ বের করার ক্ষমতা, তাদের জ্ঞান ও বোধ আমাদের মত প্রবৃত্তিপরায়ন সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক অনেক বেশী প্রখর, অত্যন্ত সূক্ষ্ম,  অনেক গভীর ও বহুদা বিস্তৃত৷ কিন্তু তাদের কোন কিছুই অলৌকিক নয়, বুজরুকি নয়,- কোন কিছুই বিজ্ঞানের বাইরে নয়।

শ্রীশ্রীঠাকুর বা আচার্য্যদেবের অলৌকিক ক্ষমতা থাকেও যদি,- তাতে আমার আপনার কি লাভ? আচার্য্যদেবের ফটোতে যদি সত্যি সত্যি তাঁর হাত না দেখা যায়,- তাতে কি আসে যায়? তিনি কি এইসব যাদুকান্ড করার জন্য বসে আছেন? পি সি সরকারের কাছে গেলেই হয়,- এর চেয়েও আরো বড় বড় যাদু, দারুন দারুন অলৌকিক ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে৷ আধ্যাত্মিকতা, গুরুসেবা, মনুষত্বের উন্নতির সাথে এইসব কান্ডের কোন সম্পর্ক নেই।

আমরা যত বাস্তবভাবে তাঁকে গ্রহন করব, যত বেশী তাঁর লৌকিক ও মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলি চর্চা করব,- ততই আমাদের মঙ্গল।

পূজ্যপাদ অবিনদাদার যদি সত্যি সত্যি কারো মনের কথা বলে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে, যদি তিনি সত্যি সত্যি চোখ বুঝে আমার হারানো জিনিসের খোঁজ বলে দিতে পারেন,- তাতে কি আসে যায়? আমার কি লাভ তাতে? আমি কি তাঁর এই গুন নিজের মধ্যে আয়ত্ত করতে পারব? আমার জীবন চলনায় তাতে কোন উন্নতি ঘটবে? তাতে কি আমার ইষ্টচলনা, ইষ্টনিষ্ঠা, আমার সাধনায় কোন উন্নতি হচ্ছে তাতে?

বরং এইভাবে তাঁদের সম্পর্কে অলৌকিক ঘটনা প্রচার করে নব্যদীক্ষিত ও অদীক্ষিত মানুষজনদের মনে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি করছিনা?  এইসব ঘটনা শুনে তাদের মনে ধারণা জন্মাবে,- বুঝি শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব বা শ্রীশ্রীঅবিনদাদার কাছে আসলে তারা এইরকম অলৌকিক ক্ষমতা বলে তাদের সমস্যা নিরসন করে দেবে, তাদের মনের কথা বলে দেবে, ভবিষ্যৎ বানী করে দেবে।  যখন তাদের এই মনোবাসনা পূরন হবেনা তখন তারা ব্যার্থমনোরথ হয়ে ফিরে যাবে। ঠাকুর ধরার প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে বঞ্চিত হবে৷ তাদের জীবন ঠাকুর থেকে দূরে চলে যাবে।

তাছাড়া,- স্যোসাল মিডিয়ায় এইসব অলৌকিক ক্ষমতার প্রচারের ঘনঘটা দেখে সমাজের শিক্ষিত ও বাস্তববাদী মানুষেরা শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব ও শ্রীশ্রীঅবিনদাদাকে অন্যান্য স্বঘোষিত বাবা, অদ্ভুত ক্ষমতাশালী স্বামী বা জটাধারী সাধুদের মতই ভাববে। ভাববে উনারা বুঝি অলৌকিক ক্ষমতা দেখিয়ে মানুষকে প্রলোভিত করেন৷ তাতে কি তাঁদের অবমাননা হচ্ছে না? মানুষের মনে একটা ভুল ধারণা সৃষ্টি করছি না আমরা?

শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব বা শ্রীশ্রীঅবিনদাদার প্রাত্যহিক জীবনে লৌকিক ঘটনা এত এত আছে,- সেগুলো বলে বলে শেষ করা যায়না৷ অলৌকিক ঘটনার কি আদৌ প্রয়োজন আছে?

শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে অনেকেরই অলৌকিকভাবে জীবন রক্ষা হয়েছে, বিরাশী মাইলে কুল গাছের নীচে এক মুসলিম মা শ্রীশ্রী বড়দার দর্শন পেয়েছেন অদ্ভুত ভাবে, শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব ও শ্রীশ্রীঅবিনদাদার নির্দেশ পালন করে অনেকেরই এরকম নানা  অভিজ্ঞতা হয়েছে যেগুলোর কোন ব্যাখ্যা নেই ৷ কিন্তু, - এই ঘটনাগুলোর পেছনেও একটা বিজ্ঞান আছে। তাঁর প্রতি গভীর বিশ্বাস, নির্ভরতা, সমর্পন, ভালবাসা, টান ও একানুরক্তি থাকলে এমন বহু অনুভূতি আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই ঘটে,- অহরহ ঘটছে৷ গভীর বিশ্বাস ও সমর্পন যার আছে,- সে তাঁর নির্দেশ পালনে সদা সচেষ্ট থাকে, নিজের জীবন চলনা তাঁর ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রন করার সাধনায় রত থাকে, তাঁর ইচ্ছাপূরনের কর্মে সদা যুক্ত থাকে। বিশ্বাস আছে,- কিন্তু সেই অনুযায়ী কর্ম নেই, সাধনা নেই, জীবন চলনা নেই,- তা কখনো হয়না। এই কর্মহীন বিশ্বাস শুধু মাত্র অলৌকিকতাই খুঁজে বেড়ায়৷