Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

যার-তার হাতে অন্নজল গ্রহন শাস্ত্র বিরোধী কেন?

ভগবান শংকরাচার্য তাঁর গুরুর সাথে সাধন উদ্দেশ্যে হিমালয়ে যাচ্ছেন। যাত্রাপথে সন্ধ্যা নেমে আসায় হিমালয়ের পাদদেশে এক গৃহস্থের বাড়ীতে তারা আশ্রয় নিলেন। 

এই বাড়ীর কর্তার যুবতী কন্যা রান্না করে রাত্রিবেলা খাবার পরিবেশন করলেন। গুরুদেব রাতে আহার করেন না,-তাই শুধু শংকরাচার্য খেলেন। খেয়েদেয়ে গুরুশিষ্য ঘুমিয়ে পড়লেন।

গভীর রাতে শংকরাচার্যের মনে প্রচন্ড কামভাবের সৃষ্টি হয়৷ তিনি ছটফট করছেন। কিন্তু সেই সাথে তার মনে এক গভীর অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে। তিনি ভাবছেন,-" আমি গুরুদেবের সাথে থেকে এত কঠোর সাধনা করছি৷ আমার মনে কেন এই ভাবের সৃষ্টি হল? আমার মনের উপর আমার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে যাচ্ছে কেন?" 

তিনি থাকতে না পেরে গুরুদেবকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। গুরুদেবের পায়ে শংকরাচার্য তাঁর মনের সমস্যা জানালেন। ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলেন, - মনের এই নিম্নগামী চিন্তার জন্য৷ 

গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন,-" আজ অন্ন কার হাতে গ্রহন করেছিস?" 

" আজ্ঞে গুরুদেব,- এই বাড়ীর যুবতী কন্যা রন্না করে আমায় খাবার পরিবেশন করেছে।" 

গুরুদেব বললেন,-" শাস্ত্রে আছে,- অন্ন বাহী মন। এই যুবতী কন্যা তোমার প্রতি যে মনোভাব নিয়ে অন্ন পাক করেছে এবং তোমায় পরিবেশন করেছে,- সেই ভাব অন্নের মাধ্যমে তোমার মনে সঞ্চারিত হয়েছে৷ তাই তোমার মনের এই পরিবর্তন। আজ থেকে তুমি শুধু স্বপাক অন্ন গ্রহন করবে।" 

২০২০ সালের ২১শে এপ্রিল Times of India তে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়,- " Do positive or negative thoughts while cooking get transferred to the food?" এই আর্টিকেলের একটি অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে,-" যিনি খাদ্য প্রস্তুত করছেন তার থেকে এক অদৃশ্য এনার্জি খাদ্যে সঞ্চারিত হয়। খাদ্যে সঞ্চারিত এই শক্তি, -যিনি খাদ্যটি গ্রহন করছেন তার মনে প্রভাব ফেলে। খাদ্যের স্বাদ এবং সূক্ষ গঠনও এই অদৃশ্য শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়।

যিনি খাদ্য প্রস্তুত করছেন তিনি খাদ্য গ্রহনকারীর মনে অনেক সূক্ষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম। তাই রান্না করার সময় আনন্দ ও সৎচিন্তায় নিমগ্ন থাকা উচিত।"

 ১৯৯০ সালে Dr. Masaru Emoto নামে এক জাপানীজ বিজ্ঞানী ও গবেষক জলের crystalline structure এর উপর বিভিন্ন শব্দ, সংগীত, মানুষের মানসিক শক্তি,ভাব  এবং পরিবেশের প্রভাব নিয়ে এক সুদীর্ঘ গবেষণা করেন। বিভিন্ন পজিটিভ ও নেগেটিভ এনার্জী প্রয়োগ করার পর তিনি জলের crystalline structure এর ছবি তুলে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তিনি তার গবেষণায় প্রমান করেন মানুষের মানসিক ভাব, চেতনা ও শক্তি জলের সূক্ষ আনবিক গঠনে পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

তিনি তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন পজিটিভ চিন্তা, ভাব, কথা ও শক্তি জলের  সূক্ষ আনবিক গঠনে এক সামঞ্জস্যপূর্ন পরিবর্তন ( Harmonious crystal formation) আনতে সক্ষম। অন্যদিকে নেগেটিভ চিন্তা, ভাব ও শব্দ জলের ক্রিস্টাল গঠনে এক ছন্নছাড়া ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে।

 Dr. Masaru Emoto র এই গবেষণার বহু হাজার বৎসর পূর্বেই আমাদের দেশের ঋষিগন অন্ন ও জলের মাধ্যমে মনের ভাব সঞ্চারনা সম্পর্কিত প্রভাব উপলব্ধি করেছিলেন। এবং হিন্দু শাস্ত্রে,- যার তার হাতে অন্ন-জল গ্রহন করার ব্যাপারে অনেক বিধিনিষেধ বহু মুনি ঋষিগন বলে গেছেন।

 আমরা, সাধারণ মানুষজন, এই প্রভাব খুব একটা অনুভব করতে পারিনা,- কারন,- আমাদের সাড়াপ্রবনতা ও অনুভব ক্ষমতা অনেকটাই স্থূল ও ভোঁতা হয়ে গেছে। একটি সাদা কাগজে একটি কলমের অগ্রভাগ দিয়ে ছোট্ট একটি বিন্দু দিলে,- তা নজরে আসে। কিন্তু যে কাগজে বহু আজেবাজে আকাঁবুকি লেখায় ভর্তি হয়ে আছে সেই কাগজে এমন তিন চারটি বিন্দু দিলেও তা নজরে পড়বে না। তেমনি আমাদের মন, বোধ ও চেতনা বহু আজেবাজে আঁকাবুকিতে ভর্তি হয়ে আছে বলে অনুভব ক্ষমতা ভোঁতা হয়ে আছে,- অনুভব করতে পারিনা।

 কিন্তু  যারা সাধন ভজন করেন, সূক্ষ চিন্তা  ও গভীর মনোনিবেশে মগ্ন থাকেন, উচ্চতর চিন্তায় যুক্ত থাকেন,- তাদের মনে ও ভাবে অন্ন-জলের এই প্রভাব সহজেই প্রতীয়মান।

 অন্ন-জলের এই সূক্ষ্ম মানসিক প্রভাব ছাড়াও স্থূল শারীরিক প্রভাবও রয়েছে। যিনি খাদ্য প্রস্তুত করছেন বা পরিবেশন করছেন,- তিনি যদি সদাচার সম্পন্ন না হন,- তবে সেই অন্ন-জল গ্রহনকারী ব্যাক্তি বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধীতে আক্রান্ত হতে পারেন।

 শিক্ষায়-ডিগ্রীতে অনেক উচ্চ, পোষাকে কেতাদুরস্ত, কথায় পন্ডিত অমন বহু মানুষ রয়েছে,- যাদের সামান্যতম সদাচারী অভ্যাস নেই৷ সর্দি ফেলে হাত ধোয় না, যে কাপড় ও জুতা পড়ে পায়খানায় যাচ্ছেন সেই কাপড় ও জুতা পড়েই রান্নাঘরে ঢুকছেন- রান্না করছেন, পায়খানা করে ঠিকঠাক ভাবে হাত ধুয়ে অভ্যাস নেই, পেচ্ছাব করে জল নেন না, রান্না করতে করতে গা চুলকিয়ে হাত না ধুয়েই সবজি মাখছেন, -অমন কু অভ্যাস সম্পন্ন বহু শিক্ষিত মানুষ রয়েছে। এইরকম অসদাচারী মানুষের হাতে অন্ন জল গ্রহন করলে রোগগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।

 যেহেতু, বাইরে থেকে দেখে বুঝার কোন উপায় নেই,- কে কতটুকু সদাচার সম্পন্ন, -তাই যার তার হাতে খাওয়ার অভ্যাস বর্জন করলেই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা সম্ভব।

অনেকেই হয়ত আছে,- নোংড়া, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকেন,- পেশাগত কারনে, অভ্যাসগত কারনে বা যেকোনো কারনেই হোক। সেই পরিবেশে থাকতে থাকতে তিনি immune হয়ে যান৷ কিন্তু যার এই immunity নেই তিনি যদি এই ব্যাক্তির দ্বারা সংক্রামিত হন,- তবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 

শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ থাকাটাই যেহেতু ধর্মের প্রথম এবং প্রধান অংশ,- তাই যেখানে-সেখানে, যার তার হাতে অন্ন-জল গ্রহন না করাই ধর্ম।

 আমার মা-বাবা, স্ত্রী, শ্রদ্ধেয় গুরুজন বা অন্য কোন ব্যাক্তি,- যার সদাচারী অভ্যাস সম্পর্কে আমার কোন সংকোচ নেই, যিনি আমার প্রতি শুভাকাঙ্ক্ষী, যিনি মানসিকভাবে পজিটিভ চিন্তাসম্পন্ন, সৎ ও মংগলজনক মনোভাব সম্পন্ন,- তার হাতে আমি নিশ্চিন্তে অন্ন-জল গ্রহন করতে পারি।

অন্যথায়,- দৃঢ়তার সাথে, - কিন্তু বিনয়, ভদ্রতা ও শিষ্ঠাচার বজায় রেখে যার তার হাতে অন্ন জল গ্রহন বর্জন করে চলাই শ্রেয়।