কেউ হয়ত আমার সামনে এক বোতল মধু এনে রাখল। এখন, আমি এই মধুকে দুইভাবে ব্যাবহার করতে পারি। সেই মধুর বোতল ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গেলাম,- নানাভাবে সেই মধুর chemical analysis করলাম,মধুর নানা উপাদাগুলির গুনাগুন ব্যাখ্যা করলাম, মধুর উপর দিনরাত গবেষণা করে-দেশবিদেশের বিজ্ঞানীদের রেফারেন্স পড়াশোনা করে phd ডিগ্রী অর্জন করলাম। মধুর গুনাগুন নিয়ে দেশেবিদেশে সেমিনার করলাম,- মধু সেবনের স্বাস্থ্যকর দিক নিয়ে ইউটিউব ভিডিও বানিয়ে লাখ লাখ ফলোয়ার বানালাম। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে analysis করতে করতে মধুর বোতল খালি হয়ে গেল,- আমি নিজের জিহবায় এক ফোঁটা মধু ঢেলে তার মিষ্টতা অনুভব করার প্রয়োজন মনে করিনি। মধু সম্পর্কে আমার তাত্ত্বিক জ্ঞান কিন্তু অগাধ!! মধু বিশেষজ্ঞ আমি৷
আরেকভাবে তার ব্যাবহার হতে পারে। আমার সামনে মধুর বোতল রাখা মাত্রই তার ঢাকনা খোলে কয়েক চামচ মধু মুখে দিয়ে দিলাম। আর অনুভব করলাম,- মধু কি ভীষণ মিষ্টি। আহাঃ এমন মিষ্টি তো আগে পাইনি। বন্ধু বান্ধব প্রিয়জন যাদের সামনে পেলাম তাদের মুখে এক চামচ করে মধু দিলাম,- তারাও বুঝল কি মিষ্টি!! আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাকে পাচ্ছি তাকেই জানাচ্ছি,- মধু কত্ত মিষ্টি!!
ঠাকুরকে সেইরকম,- দুইভাবেই গ্রহন করা যায়।
আমি তাঁকে গ্রহন করে আচার্য্যনিষ্ঠা নিয়ে,- আচার্য্যদেব যখন যেমনটা বলেন সহজ সরলভাবে বোকার মত সেই নির্দেশ পালন করে, - সেই বাস্তব করার মধ্য দিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের অস্তিত্ব ও তাঁর দয়া প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর সেই দয়া ও ভালবাসার অনুভূতি আমাকে এক দিব্য আনন্দে ডুবিয়ে রাখে সারাক্ষন। আমি হয়ত তাঁর কঠিন কঠিন বানী মূখস্ত বলতে পারিনা, বানীর ব্যাখ্যা জানিনা, সংস্কৃত শ্লোক জানিনা, যুক্তিতর্ক-তথ্যবিশ্লেষন জানিনা,- কিন্তু তিনি যে আমায় সারাক্ষন আগলে আছেন,তিনি যে আমায় কতটা ভালবাসেন তা সহজবোধে বুঝতে পারি। নিত্য তাঁর দয়া অনুভব করে পরমানন্দে ভাসতে থাকি।
আরেকটা হতে পারে,- আমি শ্রীশ্রীঠাকুরের দীক্ষা নিয়ে তাঁর হাজার হাজার বানী ও কথাগুলি মূখস্ত করে সেগুলির নানা ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণ নিয়ে দিবারাত্র ব্যাস্ত রইলাম, নানা সংস্কৃত-ইংরেজী-উর্ধু ইত্যাদি শাস্ত্রের উক্তি উল্লেখ করে শ্রীশ্রীঠাকুরকে ভীষণ তাত্ত্বিকভাবে পরিবেশন করতে লাগলাম, দেশে-বিদেশে সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে লাগলাম। মানুষ মুগ্ধ হয়ে বাঃ বাঃ করতে লাগল,- আমার প্রশংসায় চারিদিক মূখরিত। কিন্তু আচার্য্যদেব কি চান, কি তাঁর নির্দেশ, তিনি কিসে খুশী হন - সেই ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। আচার্য্যদেবের ইচ্ছাপূরন আমার জীবনে মূখ্য হয়ে উঠেনি। তাঁর নির্দেশ পালন করার জন্য প্রচেষ্টা নেই,- বরং তাঁর ইচ্ছা পালনের উদ্দেশ্যে হাটে-ঘাটে-মাঠে-বস্তিতে-গ্রামে-শহরে প্রত্যেকের ঘরে ঘরে যেতে আমার মত জ্ঞানী-পন্ডিত-পদমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের একটু ইগোতে বাঁধছে,- তবে শ্রীশ্রীঠাকুরের বানী ও কথাগুলি শুধুমাত্র আমার intellectual entertainment এর মাধ্যম হয়েই থাকবে। তাঁকে বাস্তবে বোধ করা হয়ত আর হয়ে উঠেনা। আমি নিজে যেমন শুধুমাত্র সেই intellectual entertainment এ ব্যাস্ত থেকে নিজের জীবন ব্যার্থতায় পর্যবাসিত করছি,- তেমনি যারা আমার intellectual চর্চা শুনে মুগ্ধ হয়ে আমার অনুরাগী ভক্ততে পরিনত হচ্ছে,- তাদেরও ডুবিয়ে মারব।
শিশুর মত সরলতায় পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্য্যদেবের উপর বিশ্বাস ও নির্ভরতা নিয়ে চলাই,- শ্রীশ্রীঠাকুরকে উপলব্ধি করার একমাত্র সহজ রাস্তা। আচার্য্যদেব আমাদেরকে ঠাকুরের দিকেই ঠেলে দেন সদাসর্বদা। আচার্য্যে আনুগত্য ছাড়া শ্রীশ্রীঠাকুরকে তাত্ত্বিকভাবে হয়ত অনুধাবন করতে পারি,- কিন্তু অন্তরের সহজ উপলব্ধি ও অনুভব কঠিন। সহজ সরলতা ও গভীর বিশ্বাসই একমাত্র উপায় তাঁকে অনুভব করার।
শ্রদ্ধেয় কেষ্টদা অনেক বড় বিজ্ঞানী ছিলেন,- ভীষন পন্ডিত ব্যাক্তি। কত কত দেশ বিদেশের গ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন তিনি,- শ্রীশ্রীঠাকুরকে কত কত গভীর তাত্ত্বিক প্রশ্ন করে করে তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে বানীর আশীষধারা বের করেছেন।
একদিন সন্ধায় শ্রীশ্রীঠাকুর যখন তাঁর জন্মভূমি হিমায়েতপুরে যাওয়ার জন্য শিশুর মত ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন-বার বার বায়না করছেন তাঁকে এক্ষুনি বাংলাদেশ হেমায়েতপুর নিয়ে যাওয়ার জন্য, - তখন সামনে উপস্থিত কেষ্টদা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ভক্তরা সবাই শ্রীশ্রীঠাকুরকে এই বলে নিবৃত্ত করছিলেন, -" ঠাকুর,- এখন তো বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার হয়ে গেছে। পাসপোর্ট ভিসা করতে হয়। আমরা এইসব কিছু করে পরবর্তী সময় আপনাকে হেমায়েতপুর নিয়ে যাব। এক্ষুনি এই অবস্থায় তো যাওয়া সম্ভব না ঠাকুর।"
শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন,-" আমার জন্মভূমিতে আমি যাব,- কিসের পাসপোর্ট কিসের ভিসা? আমি এক্ষুনি যাব।"
সবাই শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করছেন। শেষে অপরাগ হয়ে শ্রীশ্রীবড়দাকে সংবাদ দেওয়া হল।শ্রীশ্রীবড়দা ছুটে এসেই শ্রীশ্রীঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলেন,-
" ঠাকুর,- আমায় বলুন কি করতে হবে?"
শ্রীশ্রীঠাকুর শিশুর মত আবদার করে বললেন,-" বড়খোকা,- আমায় এক্ষুনি হিমায়েত নিয়ে যাবি? তারা কেউ নিয়ে যাচ্ছে না।"
শ্রীশ্রীবড়দা সাথে সাথে বললেন,-" আজ্ঞে ঠাকুর,- আমি এক্ষুনি ব্যাবস্থা করছি।"
এই বলে তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরকে গাড়ীতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভ করে হেমায়েতপুরের উদ্দেশ্যে রউয়ানা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষন যাবার পর শ্রীশ্রীঠাকুরের ইচ্ছা পরিবর্তন হওয়ায় তিনি গাড়ী ঘুরিয়ে দেওঘর ফিরে আসলেন।
আসার পর কেষ্টদা সহ অন্যরা শ্রীশ্রীবড়দাকে জিজ্ঞেস করলেন,-" আপনি এই রাত বিরেতে ঠাকুরকে নিয়ে হেমায়েতপুর রউয়ানা হয়ে গেলেন,- বর্ডার পার হতেন কিভাবে? রাস্তায় যদি কোন পুলিশি ঝামেলা হত কি বিপদ হত!!"
তখন শ্রীশ্রীবড়দা উত্তর দিয়েছিলেন,-" শুনুন,- যিনি আমাকে হেমায়েতপুর নিয়ে যাওয়ার আদেশ করেছেন,- আমি যদি বিশ্বাস করি তিনিই বিশ্বপিতা-তিনি বিশ্বস্রষ্টা তবে আমি এইও বিশ্বাস করি,- তিনি তাঁর ইচ্ছা পূরন করার সমস্ত উপায় নিজেই তৈরি করে রাখেন। তিনি যদি এই রাতের বেলায় হেমায়েতপুর যেতে চান তবে তার এই ইচ্ছা পূরন করার জন্য আকাশ-বাতাস-প্রকৃতি সহায় হবে। তিনি যেমন আদেশ করেন ঠিক তেমন তেমন করাই আমার কাজ। আমার কোন অধিকার নেই নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধি দিয়ে তাঁর ইচ্ছাকে খন্ডন করার।"
শ্রীশ্রীবড়দার সাথে সেখানে উপস্থিত বাকীসব উচ্চশিক্ষিত-গভীর পান্ডিত্যসম্পন্ন ভক্তদের পার্থক্য এই জায়গাতেই। তাই শ্রীশ্রীবড়দাকেই আমরা আচার্য্যদেব রূপে পেয়েছি,- শ্রীশ্রীঠাকুরের উপর যার বিশ্বাস-নির্ভরতা ও আত্মত্যাগ সবচেয়ে বেশী, সবচেয়ে গভীর।
আর শ্রীশ্রীঠাকুরই বলে দিলেন,-" বিশ্বাসীকে অনুসরন কর-তোমারও বিশ্বাস আসবে।" তাই আচার্য্য অনুসরন বিহীন শ্রীশ্রীঠাকুরের সাধনা তাত্ত্বিক সাধনাতেই সীমাবদ্ধ।