" কি দরকার শুধু শুধু দীক্ষার নামে নিজের ব্যাক্তিত্বকে আরেকজনের পায়ে সমর্পণ করার? নিজে সৎভাবে চললেই তো হয়, একটা নীতিআদর্শকে মেনে চললেই তো হয় সারাজীবন। অনেক মানুষই তো আছে,- যারা খুব সৎ, পরোপকারী, অত্যন্ত ভাল মানুষ,- কিন্তু কোন ঠাকুরের দীক্ষাটিক্ষা নেয়নি!! সৎভাবে চলতে হলে দীক্ষার আদৌ কি কোন প্রয়োজন আছে?"
অনেক বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে আলাপচারিতায় এই প্রশ্নের সম্মুখীন হই। অনেকে আবার প্রশ্ন করেন,-
" দীক্ষা নিলেই জীবনে উন্নতি হবে,- নতুবা হবেনা,- এইসব কথার কোন মানে নেই। পৃথিবীতে বহু মানুষ আছেন যারা অর্থে-বিত্তে-ক্ষমতায়- প্রতিষ্ঠায়-পান্ডিত্যে তোমার আমার চেয়ে অনেক বেশী উন্নত,- কিন্তু কোন গুরুর দীক্ষাটিক্ষা নেয়নি। তারা যদি পারে,- তাহলে আমিও দীক্ষা না নিয়ে উন্নত জীবনের অধিকারী হতে পারব। শুধু শুধু দীক্ষা,গুরুকরন, আধ্যাত্মিকতা এইসবের জন্য সময় নষ্ট করে কি লাভ?"
কথাগুলো নেহাৎ ফেলনা নয়। সত্যিই তাই,- দীক্ষা না নিয়েও, সদগুরুর পায়ে নিজেকে সমর্পিত না করেও বহু মানুষ সৎভাবে, ন্যায়পরায়ণ হয়ে উন্নত জীবন অতিবাহিত করছে। আমি এতদিন ঠাকুরের দীক্ষা নিয়ে চলছি,- কিন্তু আমার চেয়ে অনেক বেশী ভাল ও উন্নত স্বভাব চরিত্রের মানুষ অহরহ দেখতে পাই যারা দীক্ষাটিক্ষা নেয়নি।
যেমনটা ছিল মহাভারতের পিতামহ ভীস্ম এবং দানবীর কর্ন। তারা কেউ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গুরুরূপে গ্রহন করেননি,- কিন্তু সেইযুগে অত্যন্ত সৎ, নীতিবান, ন্যায়পরায়ণ এবং মহাবীর হিসাবে সুপরিচিত ছিলেন। তারা প্রত্যেকেই একটা নীতি আদর্শকে অটূটভাবে জীবনে পালন করে চলেছিলেন,- সৎ ব্যাক্তি ছিলেন।
পিতামহ ভীস্ম বিশ্বাস করতেন,- নিজের প্রতিজ্ঞা যেকোনো মূল্যে সারাজীবন পালন করে চলাই ধর্ম। এই চলাই সততার লক্ষন,- বীরত্বের পরিচায়ক।
তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,- তিনি আজীবন কৌরব সম্রাটের অনুগত থাকবেন, নিজের জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও কৌরব বংশকে রক্ষা করবেন। এই প্রতিজ্ঞা রক্ষার প্রতি তিনি এতটাই obsessed ছিলেন যে রাজসভায় যখন উনার সামনে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হচ্ছিল,- তিনি চুপচাপ অসহায়ের মত তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন। প্রচন্ড ক্রোধে তার সিংহাসনের হাতল ভেঙে ফেলেছিলেন,- কিন্তু একবার উঠে দাড়িয়ে দুর্যোধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটুকু করেননি। অথচ,- শুধুমাত্র তিনি যদি একবার মৌখিক প্রতিবাদটুকু করতেন,- তাহলেই দুর্যোধন এই দু:সাহস করত না৷
তিনি জানতেন,- দুর্যোধন পান্ডবদের উপর ভীষণ অন্যায় করছে, তিনি জানতেন,- পান্ডবপক্ষ ধর্মের পথে আছে,- তথাপি শুধুমাত্র নিজের প্রতিজ্ঞার প্রতি আবদ্ধ থাকায় তিনি দুর্যোধনের পক্ষে দাড়িয়ে পান্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন।
এই হল, - জীবন্তধর্মস্বরূপ সদগুরুকে গ্রহন না করে শুধুমাত্র নীতিআদর্শকে আঁকড়ে ধরে সৎ ও নীতিগত জীবন কাটানোর কুফল। কখন কোন অবস্থায় এই নীতি বর্জন করাটাই ধর্ম,- তা পিতামহ ভীস্ম জানতেন না। কারন,- তিনি রক্তমাংসের জীবন্ত ধর্ম,- ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সামনে পেয়েও গ্রহন করেননি। বরং নিজের মনগড়া একটা নীতিকেই ধর্ম মনে করে পালন করে গেছেন। আর,- এই কারনে তিনি পরাজিত হলেন, যুদ্ধে হেরে শরশয্যায় কষ্ট পেলেন, অন্যায় ও অপরাধীর পক্ষ সমর্থন করার অনুসূচনা বয়ে বেড়ালেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের জীবনে কিন্তু আমরা ভিন্ন ঘটনা দেখতে পাই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন,- মহাভারতের যুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারন করবেন না। কিন্তু ভীস্মের সাথে অর্জুনের মহাযুদ্ধকালে যখন দেখলেন অর্জুনের জীবন রক্ষায় অস্ত্র ধরতে হবে - তখন নিজের প্রতিজ্ঞা ত্যাগ করে রথের চাকা হাতে নিয়ে ভীস্মের দিকে তেড়ে গেলেন। এই হল,- নীতিগত ধর্ম আর জীবন্ত ধর্মের পার্থক্য। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কোনকিছুর দ্বারা আবদ্ধ নন, কোনকিছুর প্রতি obsessed নন,- প্রতিজ্ঞা দ্বারাও না। তিনি জানেন,- শিষ্যের জীবনরক্ষায় যদি নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে সমাজে হেয় হতে হয়,- সেটাই ধর্ম। নিজের মহানত্ব প্রমান করতে গিয়ে অর্জুনের মৃত্যু চোখের সামনে দেখতে তিনি রাজী ছিলেন না।
এমনকি,- অর্জুনও নিজে কোন নীতির দ্বারা আবদ্ধ না হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশ প্রশ্নহীনভাবে পালন করাটাই ধর্ম মনে করতেন। তাই তিনি নিজে সহায়সম্বলহীন হয়েও প্রবল শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন।
রথের চাকা আটকে কর্ন যখন মাটিতে নেমে রথ মেরামত করতে ব্যাস্ত,- তখন গুরু শ্রীকৃষ্ণের আদেশে তিনি কর্নের উপর বান চালাতে দ্বিধা করেননি৷ যদি সেই অবস্থায় অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের কথা না শুনে ভাবত,- " ছি: এটা তো অন্যায়!! এইভাবে কাপুরুষের মত শত্রুর উপর তীর নিক্ষেপ করে জয়ী হওয়ার চেয়ে পরাজিত হওয়া অনেক ভাল।" - তাহলে এই মহাযুদ্ধে ধর্মের জয় আর হতনা। কোনরকম ন্যায়অন্যায়ের ধার না ধরে,- গুরুর আদেশ পালন করাটাই সে ধর্ম বলে মেনেছে। এখানেই ভীস্ম ও অর্জুনের মধ্যে পার্থক্য।
পিতামহ ভীস্মের মতই আরেক বীর, সৎ ও নীতিবান ব্যাক্তি ছিলেন দানবীর কর্ন। তিনি বিশ্বাস করতেন- দান করাই পরমধর্ম। তিনি বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞতা বয়ে বেড়ানোটাই ধর্ম বলে জানতেন।
তিনি দানবীর হিসাবে পৃথিবীতে বিখ্যাত ছিলেন। কখনো কোন দানপ্রার্থীকে তিনি ফেরাননি। এই দান করার অভ্যাস তার অহংকেই পোষন দিচ্ছিল,- দানবীর হিসাবে নিজের পরিচিতি রক্ষায় মরিয়া করে তুলেছিল। তাই,- যখন কুন্তী এসে কবচ কুন্ডল চেয়ে বসল,- কর্ন একমুহূর্ত দেরী না করে তা কুন্তীকে দিয়ে দেন। তিনি ভুলে গেছিলেন,- নিজের জীবন রক্ষা করাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। সেই মুহুর্তে নিজের জীবনকে মৃত্যুমুখে ফেলে কবচ কুন্ডল দান করে তিনি যে কতবড় অধর্ম করে বসলেন,- তা বুঝতেই পারেননি। কারন,- কর্ন তার সামনে জীবন্ত ধর্মস্বরূপ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পেয়েও তাঁর পায়ে নিজেকে সমর্পন করেননি। শ্রীকৃষ্ণ মাথায় থাকলে তিনি তা করতেন না।
তেমনি,- যে বন্ধু তার অসহায়ত্বের দিনে উপকার করেছে,- সেই বন্ধু দুর্যোধনের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থেকে তার সকল অপরাধ ও পাপকে নীরবে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন। বন্ধুকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরনকেও সমর্থন করেছেন। এই হল শুধু নীতিকে আঁকড়ে ধরে সৎ হতে চাওয়ার কুফল।
আমরা জানি,- চুরি করা মহাপাপ। কিন্তু হনুমান পরমধার্মিক হয়েও ভগবান রামচন্দ্রের আদেশে রাবনের অন্ত:পুরে ঢুকে মন্ধোধরীর সাথে প্রতারনা করে রাবনের মৃত্যুবান চুরি করে আনল। যদি প্রভু রামচন্দ্রের মত জীবন্ত গুরুর পায়ে নিজেকে তিনি সমর্পন না করতেন,- যদি নীতিগত আদর্শকে আকঁড়ে ধরে ধার্মিক হতে চাইতেন তাহলে এই চুরি করা এবং প্রতারনা করা তার পক্ষে সম্ভব হতনা। গুরুর শরনাগত হয়ে চলা,- আর নিজের মনগড়া নীতিকে আকঁড়ে ধরে সৎভাবে জীবন কাটানোর মধ্যে এখানেই পার্থক্য।
যদি গুরুর প্রতি সমর্পিত না হয়ে শুধুমাত্র নীতি জেনে, নিয়ম মেনে, বিধি পালন করেই সফল ও ধার্মিক জীবন কাটানো যেত, - তাহলে বিশ্ববিখ্যাত ফুটবল খেলোয়ারদের কোচের প্রয়োজন হতনা। কারন ফুটবল খেলার নিয়মকানুন তাদের যথেষ্টই জানা আছে। তাহলে,- সংগীত গুরুর কাছে না গিয়ে শুধুমাত্র বই পড়েই রাগ সংগীতে দক্ষ হওয়া যেত।
যেকোন বিষয়ে দক্ষ যোগ্য হতে গেলে সেই বিষয়ে যিনি বিশেষজ্ঞ,- তার শরন নিতে হয়, তার আদেশমত অনুশীলন করতে হয়, তার বাধ্য হতে হয়। ক্রিকেট, ফুটবল, সংগীত, বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিদ্যা, রাজনীতি ইত্যাদি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। তাহলে,- সফল ও দক্ষ জীবনচলনা কোন গুরু ছাড়া শুধুমাত্র পুঁথিগত নীতিবিধান মেনেই সম্ভব হয়ে যাবে,- তা ভাবার কোন কারন নেই। বই পড়, নিয়ম মূখস্ত করে কখনো জলে সাঁতার কাটা শেখা যায়না।
তবে হ্যাঁ,- গুরুর দীক্ষা না নিয়েও আমাদের সমাজে আশেপাশে বহু মানুষ অর্থে-বিত্তে-ক্ষমতায়-পান্ডিত্যে-যশে অনেক অনেক উন্নতিতে অবস্থান করছে। যেমনটা ত্রেতাযুগে রাবনের হয়েছিল। তিনি ঈশ্বররূপী শ্রীরামচন্দ্রকে সামনে পেয়েও গ্রহন করেননি, বারবার অবহেলা অপমান করেছেন,- কিন্তু তৎকালীন যুগে অর্থ-বিত্ত-শক্তি-ক্ষমতা-যশ-পান্ডিত্য সর্বদিকে উন্নতির এক চরম শিখরে অবস্থান করছিলেন। তিনি বেদজ্ঞ ছিলেন, শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন,- পরম জ্ঞানী ছিলেন। এতটাই জ্ঞানী ছিলেন যে,- এত হাজার বছর পূর্বে রাবনের রচিত শিবস্ত্রোস্ত্র আজও শিবসাধকদের মুখে প্রতিদিন উচ্চারিত হয়৷ এমন স্ত্রোত্র আজ অব্দি কেউ রচনা করতে পারেনি।
কিন্তু এত পন্ডিত, এত জ্ঞানী, এত ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়েও যখন তিনি পরনারীর প্রতি লালায়িত হলেন, যখন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠলেন,- সেই প্রবৃত্তির আবেশ তার সকল পান্ডিত্য, সকল জ্ঞান,সকল বুদ্ধি ও শক্তিকে অবশ করে তাকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। তিনি এই প্রবৃত্তির খেলা ঠাহরও করতে পারেননি। নিজের প্রবৃত্তির প্রাবল্যের দরুন,- সবংশে ধ্বংস হলেন।
আমাদের বাস্তব জীবনে আশেপাশে অমন ঘটনা অহরহ দেখতে পাই। আমি যতই পন্ডিত হই, কেষ্টবিষ্টু হই, ক্ষমতাধর ও ঐশ্বর্যশালী হই,- আমার মাথায় যখন বৃত্তি-প্রবৃত্তি (complex) চেপে বসে তখন আমি ভুতেধরা মানুষের মত নিজেকে নিজেই টেনেহিঁচড়ে জাহান্নামের পথে নিয়ে যেতে থাকি। সবাই বুঝতে পারে আমি ধ্বংসের পথে চলছি - আমি ঠাহর করতে পারিনা। তখন মানুষ কেমন যেন বোকার মত আচরন করে। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, প্রতিহিংসা, যশলিপ্সা, ক্ষমতালিপ্সা, নারীলিপ্সা,- এমনই। বড় বড় বুদ্ধিমান, জ্ঞানী, ধুরন্ধর, পন্ডিত, অতি চালাক মানুষকে অবশ করে দেয়। কত কত মানুষ এইসবের পাল্লায় পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল।
নিজের জীবনকে এই বৃত্তি-প্রবৃত্তির আবেশ থেকে মুক্ত রাখতে হলে একজন উচ্চ জীবন্ত আদর্শের সাথে অটুট ভালবাসা ও সমর্পন নিয়ে যুক্ত হতে হয়। এই যুক্ত হবার প্রক্রিয়াটিই হল সদদীক্ষা।
ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি খুব সুন্দর কথা বলেন,-" একটা কলা গাছের আঁটির উপর একটা দড়ি দিয়ে গিঁট দিলাম। এই গিঁটটাকে ঢিলা করতে হলে তার উপর আরেকটি দড়ি দিয়ে গিঁট দিতে হয়। উপরের গিঁটটা যত কষতে থাকবে,- ততই নীচের গিঁট ঢিল হয়ে খসতে থাকবে।"
অর্থাৎ গুরুর প্রতি ভালবাসা ও সমর্পনের বন্ধন যত দৃঢ় হতে থাকে,- প্রবৃত্তির বন্ধন ততই খসতে থাকে। নিজের জীবনকে সুরক্ষিত রাখার এই একমাত্র পথ। দ্বিতীয় কোন পথ নাই।
হ্যাঁ,- আমি ঠাকুর ধরে যতটুকু উন্নত স্বভাব, উন্নত চলনা ও উন্নত জীবনের অধিকারী হয়েছি,- ঠাকুর না ধরেও অনেকেই এর চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে আছে। তারা কেন দীক্ষা নেবে?
দীক্ষা নিয়ে সবাই যার যার স্তর থেকেই সাধনার পথচলা শুরু করে। আমি যেস্তর থেকে শুরু করেছি,- তারা আরেকটু উন্নত স্তর থেকে সাধনা শুরু করবে। যার যার স্তর থেকে সবাই ঠাকুরের পথধরে এগোতে থাকবে। তারা আরো উন্নত হবে,- আরো অনেক বেশী এগিয়ে যাবে।
ঈশ্বর অনন্ত,- জীবনের পথ চলাও অনন্ত। আমি যতই অগ্রসর হই,- ঐ দীগন্তের প্রান্তের মতই তিনি আমার কাছে চিরকাল অধরা থাকেন। তাইতো তিনি বলেন,- " চরৈবতি!! চরৈবতি!! " তাঁকে লক্ষ করে অনন্তের পথচলাই জীবন। ঈশ্বর অসীম অনন্ত,- আমাদের হয়ে উঠাও অসীম অনন্ত।