একজন গুরুভাইয়ের সাথে পরিচয় হল। উনিশ বছর পূর্বে দীক্ষা নিয়েছেন,- নিয়মিত ইষ্টভৃতি করেন। কিন্তু একবারও দেওঘর ঠাকুরবাড়ি যাননি।
জিজ্ঞেস করলাম,-" এতদিন হল ঠাকুর ধরে চলছেন,- একবারও ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি?"
-" দাদা,- কি বলব!! আমি এমন একটা অফিসিয়াল পদে আছি,- একদিন অফিসে না গেলে ভীষণ অসুবিধা হয়ে যায়। এমন কতগুলো দায়ীত্ব আমার উপর রয়েছে,- আমার ছুটি নেওয়া খুব কঠিন। তাছাড়া, - মেয়েটা দুই বছর পর মাধ্যমিক দেবে,- তার পড়াশোনা, স্যারের বাড়ি নিয়ে যাওয়া সাবকিছু আমাকেই সামলাতেই হয়। ঠাকুর বাড়ি যাবার ইচ্ছা তো হয়,- কিন্তু সময় পাইনা। " দাদাটি উত্তরে জানালেন।
আমি বললাম,-" দাদা, নিজেকে এতটা ব্যাস্ত করবেন না যে,- গুরুর কাজ করতে এবং গুরুর কাছে যেতে আপনার সময়ের অভাব পড়ে যাচ্ছে। আপনি আমি কেউ এতটা বিরাট গুরত্বপূর্ণ নই যে,- আপনি আমি এই পৃথিবীতে না থাকলে পৃথিবীর গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে। আপনি আমি আগামীকাল সকালে যদি পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই,- তবে আমাদের অফিসও বন্ধ হবেনা, পরিবারও না খেয়ে মরবে না। নিজেকে এতটা সাংঘাতিক গুরত্বপূর্ণ ও অপরি্হার্য ভাবার কোন কারন নেই। কিছুদিন হয়ত মানুষ মনে করবে, বলাবলি করবে - কিন্তু কয়েকদিন পরেই সবাই যার যার কাজ, সংসার ও আনন্দ উল্লাস নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়বে।
আজকে আপনি এতটা ব্যাস্ত যে,-গুরুর বাড়ি যাওয়ার সময় পাচ্ছেন না, আচার্য্যদেবের সামনে যাওয়ার ফুসরত হচ্ছেনা,- কোনদিন আপনি কোন মারাত্মক সমস্যায় পড়ে যদি আচার্য্যদেবের নিকটে সমাধানের জন্য যান,- আর তখন আচার্য্যদেব যদি বলেন,-" বাপু আমি খুব ব্যাস্ত,- তোমার জন্য আমার সময় নেই"- তখন কোথায় যাবেন? "
তিনি শুনলেন আমার কথা,- কিন্তু ঠিক বুঝলেন না। দায়সারা ভাবে বললেন,-" দেখি দাদা,- ঠাকুর যেদিন নেওয়ান সেদিন যাব। "
আমি চলে আসলাম৷ প্রায় মাসখানেক পর এক গুরুভাই জানাল,- ঐ দাদাটি বাইক এক্সিডেন্ট করে জিবি হাসপাতালে ভর্তি। আমি যেন একবার দেখে আসি।
খবর পেয়ে আমি গেলাম,- সার্জারী যেন তাড়াতাড়ি হয় সেই ব্যাবস্থা করে দিলাম। দেড়মাস পর তিনি সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলেন।
তখন একদিন উনার বাড়ির পাশে ইষ্টকাজে গেলে উনাকে দেখতে গেলাম৷ তখনও তিনি মেডিকেল লিভে আছেন। জিজ্ঞেস করলাম,-" দাদা,- আমায় একদিন বলছিলেন আপনি ঠাকুরবাড়িতে যাবার সময় পাচ্ছিলেন না, - কারন আপনি একদিন ছুটি নিলে অফিসের গুরত্বপূর্ণ কাজ আটকে থাকবে, মেয়ের পড়াশোনা ভীষণ অসুবিধা হবে। তা,- গত দেড়মাস যাবৎ যে আপনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন,- এখন আপনার অফিস ও মেয়ের পড়াশোনা কি স্তব্ধ হয়ে আছে? "
তিনি কোন উত্তর দেননি,- চুপ করে রইলেন। বোধহয় এতদিনে আমার কথা বোধগম্য হল।
এমন অনেক গুরুভাই ও মায়েদেরই পাই,- ভীষণ ব্যাস্ত!! সংসারের দায়দায়িত্ব, ছেলেমেয়ে, ব্যাবসা, চাকরি, সামাজিক দায়দায়িত্ব সবকিছু নিয়ে এতটা ব্যাস্ত যে বছরে একবার গুরুবাড়ি যাবার ফুসরত নেই। সপ্তাহে একবার সৎসঙ্গে যাবার সময় নেই, ঠাকুরের মন্দিরে মাসে একবার যাবার সময় নেই, সকাল বিকাল প্রার্থনায় বসার সময় নেই, - কারো কারো তো ইষ্টভৃতি করারও সময় নেই।
শ্রীশ্রীঠাকুরের বলা,- বছরে অন্তত একবার গুরুগৃহে যেতে হয়। তাতে সারা বছর সংসারের ঘানি টানতে টানতে জীবনে যে গ্লানি, হতাশা, অহংকার, অজ্ঞানতা, প্রবৃত্তিগামীতা জমা হয়,- সেগুলো দূর হয়। জীবনটা নতুন করে সঞ্জিবীত হয়, নতুন উদ্যম ও আশা জাগে, সংসারের গ্লানি কেটে যায়। আবার আনন্দে ও শান্তিতে জীবনের গতি চলার জন্য পজিটিভ এনার্জি পাওয়া যায়।
নদী তারা উৎসস্থল থেকে শুরু করে কত দেশবিদেশ অতিক্রম করে নিরন্তর বয়ে চলেছে,- শেষে সমুদ্রে গিয়ে মিলিত হয়। চলার পথে নদীর জলে কত আবর্জনা, নোংরা, মলমূত্র, পচাগলা গরু কতকিছু জমা হয়।কিন্তু নদী তার গতি নিয়ে সমুদ্রে মিশছে বলে এইসকল আবর্জনা ও নোংড়া সমুদ্রে ভেসে যায়,- নদীর জল স্বচ্ছ ও নির্মল থাকে। যদি নদীর গতিপথ সমুদ্র খোঁজে না পেত, যদি কেউ নদীর উপর বাঁধ দিয়ে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখত,- তবে কি হত? নদীর জল পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠত,- চতুর্দিকে বন্যা সৃষ্টি করে কত কত মানুষের জীবনে ক্ষতির কারন হয়ে উঠত।
ঠিক তেমনি আমাদের জীবনেও। আমাদের জীবনটাও নদীর মত। বছরে অন্তত একবার গুরুগৃহে না গেলে, আচার্য্যসঙ্গ না করলে, নিরন্তর নিজেকে ইষ্টের সাথে যুক্ত না রাখতে,- জীবনটা পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠে একসময়, নিজের সাথে সাথে অন্যের ক্ষতির কারনও হয়ে উঠে।
ঈশ্বর প্রাপ্তি কি এতই সহজ? গৌতম বুদ্ধ, নিমাই আদি কত কত সাধক ঈশ্বরপ্রাপ্তির জন্য স্ত্রী,পুত্র, সংসার সব চিরতরে ত্যাগ করে সন্নাষী হয়ে গেছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের আমলেও কত কত উচ্চশিক্ষিত পন্ডিত, জ্ঞানীগুণী, জমিদার নিজের আরাম আয়েসপূর্ন সংসার চিরতরে বর্জন করে শ্রীশ্রীঠাকুরের আশ্রমে এসে কায়ক্লেশে দিনযাপন করেছেন হাসিমুখে।
আর,- আমরা বছরে একবার গুরুবাড়ি যাওয়ার সময় পাইনা সংসারের চাপে!! মাসে একবার মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনায় বসার সময় হয়না। অথচ,- ঈশ্বরের দয়া চাই আপদে বিপদে প্রতিনিয়ত!! ঈশ্বরের দয়া এতই সস্তা?
এটাই তো সাধনা। ঠাকুরবাড়িতে যাবার কথা মনে আসলেই নানা বাধা সৃষ্টি হবে, সাংঘাতিক ব্যাস্ততার চাপ আসবে, অসুবিধা হবে, অবচেতন মনে বাস করা গ্রহগুলি নানা নেগেটিভ ভাব সৃষ্টি করবে। এইসব বাঁধা অতিক্রম করে গুরুর নিকট যাওয়াটাই সাধনা। এই সামান্য সাধনার জোর না থাকলে কি ঈশ্বর দর্শন সম্ভব?
আরেকটি দারুন ফাঁকিবাজির যুক্তি হল,-" ঠাকুর যেদিন নেওয়ান সেদিন যাব। " আমার মা বাবা হয়ত দূরবর্তী কোন শহরে থাকেন। আমি ছুটি পেলেই মা বাবাকে দেখতে চলে যাই। কারন, - মা বাবাকে আমি ভালবাসি। কখনো বলিনা যে,- মা বাবা যেদিন তাদের কাছে নেওয়ান সেদিন যাব। প্রেমিক তার প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্য নানা ফন্দিফিকির খুঁজে। মা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে যেভাবেই হোক প্রেমিকার সাথে দেখা করতে চলে যায়৷ সে কি কখনো বলে,-" প্রেমিকা যেদিন আমায় নিয়ে যাবে,- সেদিন যাব"?
তাই,- এইরকম অজুহাত প্রেমের লক্ষন নয়। গুরুর প্রতি ভক্তির নিদর্শন নয়। যত অসুবিধাই থাকুক, যত অভাবই থাকুক, যত বাধাই থাকুক,- আমি গুরুবাড়ি যাবই, আচার্য্যদর্শন করবই, অন্তত সপ্তাহে এক দুইবার নিকটবর্তী মন্দিরে প্রার্থনায় যোগ দেবই, সপ্তাহে এক দুইদিন সৎসঙ্গে যাবই, ডিপি ওয়ার্ক করবই। ঠাকুর এবং ঠাকুরের স্বার্থ একনম্বরে,- আমার পরিবার,সংসার,চাকরি,ব্যাবসা, সামাজিকতা সব এর পরের নম্বরে। "ইষ্টের চেয়ে থাকলে আপনছিন্নভিন্ন তার জীবন। "...... শ্রীশ্রীঠাকুরের এই কথাটির বাস্তবায়ন অহরহ দেখতে পাই কত কত মানুষের জীবনে।
সুখে থাকার একটাই উপায়,- ঠাকুরকে এক নম্বরে রাখা।