Read Storey of Mahabharat Part 12 Birth of Bichitrabirya dhritarastra and Bidur by Ashoke Ghosh in Bengali আধ্যাত্মিক গল্প | মাতরুবার্তি

Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 12

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১২

বিচিত্রবীর্য, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম বৃত্তান্ত

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

বিচিত্রবীর্য, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম বৃত্তান্ত

 

বৈশম্পায়ন ভীষ্মের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করার পর রাজা জনমেজয় বিচিত্রবীর্য, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্মের কাহিনি বর্ণনা করার অনুরোধ করলে, বৈশম্পায়ন বিচিত্রবীর্য, ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্মের কাহিনি বলতে শুরু করলেন।

শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর বিবাহের পরে সত্যবতীর গর্ভে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে শান্তনুর দুই পুত্রের জন্ম হোলো। কনিষ্ঠ পুত্র যৌবনলাভ করবার পূর্বেই শান্তনুর মৃত্যু হোলো এবং সত্যবতীর মত নিয়ে ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন। চিত্রাঙ্গদ অতিশয় বলশালী ছিলেন কিন্তু মানুষ দেবতা অসুর গন্ধর্ব সকলকেই নিকৃষ্ট মনে করতেন। একদিন গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ তাকে বললেন, তোমার আর আমার নাম একই, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর নতুবা অন্য নাম নাও। কুরুক্ষেত্রে হিরন্মতী নদীর তীরে দুজনের ঘোর যুদ্ধ হোলো আর সেই যুদ্ধে শান্তনুনন্দন চিত্রাঙ্গদ নিহত হলেন। তখন ভীষ্ম নাবালক বিচিত্রবীর্যকে রাজপদে বসালেন।

বিচিত্রবীর্য যৌবনলাভ করলে ভীষ্ম তার বিবাহ দেওয়া স্থির করলেন। কাশীরাজের তিন পরমা সুন্দরী কন্যার একসঙ্গে স্বয়ংবর হবে শুনে, ভীষ্ম বিমাতার অনুমতি নিয়ে রথারোহণে একাকী বারাণসীতে গেলেন। তিনি দেখলেন নানা দেশ থেকে রাজারা স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়েছেন। যখন পরিচয় দেবার জন্য রাজাদের নাম ঘোষণা করা হোলো তখন কন্যারা ভীষ্মকে বৃদ্ধ ও একাকী দেখে তাঁর কাছ থেকে সরে গেলেন। সভায় অন্য যে সকল রাজা ছিলেন, তারা হেসে বললেন, এই পরম ধর্মাত্মা পক্ককেশ নির্লজ্জ বৃদ্ধ এখানে কেন এসেছে? যে প্রতিজ্ঞাপালন করে না তাকে লোকে কি বলবে? ভীষ্ম বৃথাই ব্রহ্মচারী খ্যাতি পেয়েছেন।

উপহাস শুনে ভীষ্ম রেগে গিয়ে তিনটি কন্যাকে জোর কোরে নিজের রথে তুলে নিলেন এবং জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, রাজগণ, বহুপ্রকার বিবাহ প্রচলিত আছে, কিন্তু ধর্মাত্মাগণ বলেন যে স্বয়ংবর সভায় বিপক্ষদের পরাভুত করে কন্যা হরণ করাই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। আমি এই কন্যাদের নিয়ে যাচ্ছি, তোমাদের শক্তি থাকে তো যুদ্ধ কর। রাজারা ক্রোধে সভা থেকে উঠলেন এবং অলংকার খুলে ফেলে বর্ম ধারণ করে নিজ নিজ রথে উঠে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন। সর্বশস্ত্রবিশারদ ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে রাজারা পরাজিত হলেন, কিন্তু মহারথ শাল্বরাজ তার পশ্চাতে যেতে যেতে বললেন, থাম, থাম। ভীষ্মের শরাঘাতে শাল্বের সারথি ও অশ্ব নিহত হোলো এবং শাল্ব ও অন্যান্য রাজারা যুদ্ধে বিরত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে চলে গেলেন। বীরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম তিন কন্যাকে পুত্রবধূ, ছোটো বোন বা মেয়ের ন্যায় যত্নসহকারে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন।

ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যের বিবাহের উদযোগ করছেন জেনে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা তাকে বললেন, আমি স্বয়ংবরে শাম্বরাজকেই পতিরূপে বরণ করতাম, তিনিও আমাকে চান, আমার পিতারও তাতে সম্মতি আছে। ধর্মজ্ঞ, আপনি ধর্ম পালন করুন। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে অম্বাকে শাল্বরাজের কাছে পাঠালেন এবং অন্য দুই কন্যা অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলেন। বিচিত্রবীর্য সেই দুই সুন্দরী পত্নীকে পেয়ে কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। সাত বৎসর পরে তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন এবং সুহৃৎ ও চিকিৎসকগণের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও মৃত্যুবর্ণ করলেন।

পুত্রশোকে কাতর সত্যবতী তার দুই বধূকে সান্ত্বনা দিয়ে ভীষ্মকে বললেন, রাজা শান্তনুর বংশ রক্ষার ভার এখন তোমার উপর। তুমি ধর্মের তত্ত্ব ও কুলাচার সবই জান, এখন আমার আদেশে বংশরক্ষার জন্য দুই ভ্রাতৃবধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করো, অথবা স্বয়ং রাজ্যে অভিষিক্ত হও এবং বিবাহ করো।

ভীষ্ম বললেন, মাতা, আমি ত্রিলোকের সমস্তই ত্যাগ করতে পারি কিন্তু যে প্রতিজ্ঞা করেছি তা ভঙ্গ করতে পারি না। শান্তনুর বংশ যাতে রক্ষা হয় তার জন্য ক্ষাত্রধর্মসম্মত উপায় বলছি শুনুন। “পুরাকালে পরশুরাম কর্তৃক পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় হলে ক্ষত্রিয়নারীগণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের সহবাসে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন, কারণ বেদে বলা আছে যে, ক্ষেত্রজ পুত্র বিবাহকারীর পুত্ররূপে গণ্য হয়। ধর্মাত্মা বলি এই ধর্মসম্মত উপায় অবলম্বন কোরে মহর্ষি দীর্ঘতমার দ্বারা তার স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র, ও সুহ্ম নামে পাঁচটি তেজস্বী পুত্র লাভ করেছিলেন”।

তারপর ভীষ্ম বললেন, মাতা, বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের জন্য আপনি কোনও গুণবান ব্রাহ্মণকে নিয়োগ করুন। সত্যবতী একটু লজ্জিতভাবে হেসে নিজের পূর্ব ইতিহাস জানালেন এবং পরিশেষে বললেন, কন্যাবস্থায় আমার একটি পুত্র হয়েছিল তার নাম দ্বৈপায়ন, তিনি মহাযোগী মহর্ষি এবং চতুর্বেদ বিভক্ত করে ব্যাস উপাধি পেয়েছেন। তিনি কৃষ্ণবর্ণ সেজন্য তাঁর অন্য নাম কৃষ্ণ। আমার এই পুত্র জন্মগ্রহণ করেই পিতা পরাশরের সঙ্গে চলে যান এবং যাবার সময় আমাকে বলেছিলেন যে, প্রয়োজন হলে আমি ডাকলেই তিনি আসবেন। ভীষ্ম, তুমি আর আমি অনুরোধ করলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন তাঁর ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন।

ভীষ্ম এই প্রস্তাবের সমর্থন করলে সত্যবতী ব্যাসকে স্মরণ করলেন। ক্ষণকালমধ্যে ব্যাস উপস্থিত হলেন। মাতাকে প্রণাম কোরে ব্যাস বললেন, আপনার অভিলাষ পূরণ করতে এসেছি, কি করতে হবে আদেশ করুন। সত্যবতী তার প্রার্থনা জানালে ব্যাস বললেন, কেবল ধর্মপালনের উদ্দেশ্যে আমি আপনার নির্দেশ পালন করবো। আমার নির্দেশ অনুসারে দুই রানী এক বৎসর ব্রতপালন করে শুদ্ধ হন, তারপর তারা আমার কাছে আসতে পারবেন। সত্যবতী বললেন, অরাজক রাজ্যে বৃষ্টি হয় না, দেবতা প্রসন্ন হন না, অতএব যাতে রানীরা দ্রুত গর্ভবতী হন তার ব্যবস্থা করো, সন্তান হলে ভীষ্ম তাদের পালন করবেন। ব্যাস বললেন, যদি এখনই পুত্র উৎপাদন করতে হয় তবে রানীরা যেন আমার কুৎসিত রূপ, গন্ধ আর পোশাক সহ্য করেন।

সত্যবতী তার পুত্রবধূ অম্বিকাকে কোনও প্রকারে সম্মত করে শয়নগৃহে পাঠালেন। অম্বিকা উত্তম শয্যায় শুয়ে ভীষ্ম এবং অন্যান্য কুরুবংশীয় বীরগণকে চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর ঘরে ব্যাস প্রবেশ করলেন। তার কৃষ্ণ বর্ণ, দীপ্ত নয়ন ও পিঙ্গল জটা-শ্মশ্রু দেখে অম্বিকা ভয়ে চোখ বন্ধ কোরে রইলেন। ব্যাস বাইরে এলে সত্যবতী প্রশ্ন করলেন, এর গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো? ব্যাস উত্তর দিলেন, এই পুত্র শতহস্তির মতো বলবান, বিদ্বান, বুদ্ধিমান এবং শতপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে অন্ধ হবে। সত্যবতী বললেন, অন্ধ ব্যক্তি কুরুকুলের রাজা হবার যোগ্য নয়, তুমি আর একটি পুত্র দাও। সত্যবতীর অনুরোধে তার দ্বিতীয় পুত্রবধূ অম্বালিকা শয়নগৃহে এলেন কিন্তু ব্যাসের মূর্তি দেখে তিনি ভয়ে পাণ্ডবর্ণ হয়ে গেলেন। সত্যবতীকে ব্যাস বললেন, এই পুত্র বিক্রমশালী খ্যাতিমান এবং পঞ্চপুত্রের পিতা হবে, কিন্তু মাতার দোষে পাণ্ডুবর্ণ হবে।

যথাকালে অম্বিকা একটি অন্ধ পুত্র এবং অম্বালিকা পাণ্ডুবর্ণ পুত্র প্রসব করলেন, তাদের নাম ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। পরে সত্যবতী অম্বিকাকে আর একবার ব্যাসের কাছে যেতে বললেন, কিন্তু মহর্ষির রূপ আর গন্ধ মনে করে অম্বিকা নিজে না গিয়ে অপ্সরার ন্যায় রূপবতী এক দাসীকে পাঠালেন। দাসীর অভ্যর্থনা ও পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাস বললেন, কল্যাণী, তুমি আর দাসী হয়ে থাকবে না, তোমার পুত্র ধর্মাত্মা ও পরম বুদ্ধিমান হবে। এই দাসীর গর্ভে বিদুর জন্মগ্রহণ করেন।

মাণ্ডব্য নামে এক মৌনব্রতী উবাহু তপস্বী ছিলেন। তিনি অণীমাণ্ডব্য নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ধর্মরাজ যমকে অভিশাপে দিয়েছিলেন যে তিনি শূদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করবেন। অণীমাণ্ডব্য আরো এক বিধান দিয়ে বলেছিলেন যে চোদ্দ বছর বয়সের মধ্যে কেউ কিছু অন্যায় করলে তা পাপ বলে গণ্য হবে না। অণীমাণ্ডব্যের সেই অভিশাপের ফলেই ধর্মরাজ যম দাসীর গর্ভে বিদুররূপে জন্মগ্রহণ করেন।

______________

(ক্রমশ)