Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 15

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৫

পঞ্চপাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শন

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

পঞ্চপাণ্ডব ও কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শন

যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব ও দুর্যোধনাদি কৌরব ভ্রাতাদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পন্ন হওযার পরে একদিন বেদব্যাস, কৃপাচার্য, ভীষ্ম, বিদূর প্রভৃতির উপস্থিতিতে দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে, আপনি অনুমতি দিলে তারা নিজ নিজ শিক্ষা প্রদর্শন করবেন। ধৃতরাষ্ট্র খুশি হয়ে বললেন, আপনি মহৎ কর্ম সম্পন্ন করেছেন, আমার ইচ্ছা চক্ষুষ্মান লোকের ন্যায় আমিও রাজকুমারগণের পরাক্রম দেখি।

ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে এবং দ্রোণের নির্দেশ অনুসারে বিদুর সমতল স্থানে বিশাল রঙ্গভূমি নির্মাণ করালেন এবং অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনের শুভদিন ঘোষণা করে সাধারণকে জানিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। নির্দিষ্ট দিনে ভীষ্ম ও কৃপাচার্যকে সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী কুন্তী প্রভৃতি রাজপুরনারীগণ উত্তম পরিচ্ছদে ভূষিত হয়ে মঞ্চের পাশে সুসজ্জিত প্রেক্ষাগারে এসে বসলেন। নানা দেশ থেকে আসা দর্শকদের কোলাহলে ও বাদ্যধ্বনিতে সেই সভা মুখরিত হোয়ে উঠলো।

তারপর দ্রোণাচার্য শুভ্র বস্ত্র ও মালা পরে পুত্র অশ্বত্থামার সঙ্গে রঙ্গভূমিতে এলেন এবং মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণদের দিয়ে মঙ্গলাচরণ করালেন। ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে অনেক সোনা ও রত্নাদি দক্ষিণা দিলেন। তারপর ধনু ও তুণীর এবং আরো নানা অস্ত্রশস্ত্র ধারণ করে রাজপুত্রগণ রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে সবার সামনে রেখে জ্যেষ্ঠানুক্রমে অস্ত্রপ্রয়োগ কৌশল দেখাতে লাগলেন। এই প্রদর্শন চলার সময় পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত হোয়ে দুর্যোধন ও ভীম গদা হাতে কোরে মত্ত হস্তীর মতো গর্জন কোরে পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। রাজকুমারগণ রঙ্গভূমিতে কি করছেন তার বিবরণ বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে এবং কুন্তী গান্ধারীকে জানাতে থাকলেন। দর্শকদের একদল ভীমের এবং আর একদল দুর্যোধনের পক্ষপাতী হওয়ায় জনতা দুই ভাগে ভাগ হোয়ে গেলো। একদল দুর্যোধনের জয় আর একদল ভীমের জয় বলে চিৎকার করতে থাকলো। তখন দ্রোণাচার্য তার পুত্র অশ্বত্থামাকে বললেন, তুমি ওই দুই মহাবীরকে নিবারণ কর। অশ্বত্থামা গদাযুদ্ধে উদ্যত ভীম আর দুর্যোধনকে থামিয়ে দিলেন।

এরপর বাদ্যধ্বনি থামিয়ে দিয়ে দ্রোণাচার্য বললেন, যে আমার পুত্রের চেয়ে প্রিয়, সর্ব অস্ত্রে বিশারদ, সেই অর্জুনের শিক্ষা আপনারা দেখুন। দর্শকগণ উৎসুক হয়ে অর্জুনের অস্ত্র প্রয়োগের নানাপ্রকার কৌশল দেখে প্রশংসা করতে লাগল। ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন, হঠাৎ এত চিৎকার হোচ্ছে কেনো? বিদুর বললেন, অর্জুন অস্ত্র প্রয়োগের নানাপ্রকার কৌশল প্রদর্শন করছে, তাই দেখে সবাই উচ্চস্বরে প্রশংসা করছে।

অর্জুনের অস্ত্রকৌশল প্রদর্শন শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় সহসা কবচকুণ্ডলশোভিত মহাবিক্রমশালী কর্ণ রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হোলেন এবং দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে প্রণাম করলেন। অর্জুন যে তাঁর ভাই তা না জেনে কর্ণ বললেন, পার্থ, তুমি যা দেখিয়েছ তার সবই আমি দেখাবো। এই বলে তিনি দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন যা যা করেছিলেন তাই করে দেখালেন। দুর্যোধন আনন্দিত হয়ে কর্ণকে আলিঙ্গন করে বললেন, তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি, তুমি এই কুরুরাজ্য ইচ্ছামত ভোগ কর। কর্ণ বললেন, আমি তোমার বন্ধুত্ব চাই আর অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই। দুর্যোধন বললেন, তুমি সখা হয়ে আমার সঙ্গে আমার সমস্ত ধনদৌলত ভোগ করো আর শত্রুদের দমন করো।

অর্জুন নিজেকে অপমানিত জ্ঞান করে বললেন, কর্ণ, যারা বিনা আমন্ত্রণে আসে আর অযাচিত কথা বলে, তারা যে নরকে যায় আমি তোমাকে সেখানে পাঠাব। কর্ণ বললেন, এই রঙ্গভূমিতে সকলেরই আসবার অধিকার আছে। দুর্বলের ন্যায় আমার নিন্দা করছ কেন, যা বলবার তীরধনু দিয়েই বল। আজ গুরুর সামনেই শরাঘাতে তোমার শিরচ্ছেদ করব। তার পর দ্রোণের অনুমতি নিয়ে অর্জুন কর্ণের সম্মুখীন হলেন, দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা কর্ণের পক্ষে গেলেন। দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য ও ভীষ্ম অর্জুনের কাছে গেলেন। রঙ্গভূমি দুই পক্ষে বিভক্ত হোয়ে গেলো।

কর্ণকে চিনতে পেরে কুন্তী বিভ্রান্ত হয়ে মূৰ্ছিত হোয়ে গেলেন। এই সময়ে কৃপাচার্য কর্ণকে বললেন, এই অর্জুন কুরুবংশজাত রাজা পাণ্ডু ও কুন্তীর পুত্র, ইনি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। কর্ণ, তুমি তোমার মাতা পিতার কুল বলো, কোন রাজবংশে তোমার জন্ম? তোমার পরিচয় পেলে অর্জুন যুদ্ধ করা বা না করা স্থির করবেন, রাজপুত্রেরা নীচ কুলশীল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন না। কৃপাচার্যের কথায় কর্ণ লজ্জায় মাথা নত করলেন। দুর্যোধন বললেন, আচার্য, অর্জুন যদি রাজা ভিন্ন অন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না চান, তবে আমি কর্ণকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করছি। দুর্যোধন তখনই কর্ণকে স্বর্ণময় পীঠে বসালেন, মন্ত্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণগণ তাঁকে অঙ্গরাজ্যের রাজপদে অভিষিক্ত করলেন।

ভীম সহাস্যে বললেন, কর্ণ তুমি সূতপুত্র, তুমি অর্জুনের হাতে মরবার যোগ্য নও। কুকুর যেমন যজ্ঞের প্রসাদ খেতে পারে না, তুমিও অঙ্গরাজ্যের রাজা হোতে পারো না। দুর্যোধন বললেন, ভীম, এমন কথা বলা তোমার উচিত হয় নি। দ্রোণাচার্য কলস থেকে এবং কৃপাচার্য শরস্তম্ভ থেকে জন্মেছিলেন, আর তোমাদের জন্মবৃত্তান্তও আমার জানা আছে। কবচকুণ্ডলধারী সুলক্ষণযুক্ত কর্ণ নীচ বংশে জন্মাতে পারেন না। কেবল অঙ্গরাজ্য নয়, সমস্ত পৃথিবীই ইনি ভোগ করবার যোগ্য।

এই সময়ে সূর্যাস্ত হওয়ায় অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শন সমাপ্ত হোলো এবং দুর্যোধন কর্ণের হাত ধরে রঙ্গভূমি থেকে প্রস্থান করলেন। পাণ্ডবগণ, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, ভীষ্ম প্রভৃতিও নিজ নিজ ভবনে চলে গেলেন। কর্ণ অঙ্গরাজ্য পেলেন দেখে কুন্তী আনন্দিত হলেন। যুধিষ্ঠিরের মনে এই বিশ্বাস হোলো যে কর্ণের তুল্য ধনুর্ধর পৃথিবীতে নেই।

______________

(ক্রমশ)