মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৬
যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষেক ও জতুগৃহে পাণ্ডবদাহের ষড়যন্ত্র
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষেক ও জতুগৃহে পাণ্ডবদাহের ষড়যন্ত্র
যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব ও দুর্যোধনাদি কৌরব ভ্রাতাদের অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শিত হওযার এক বৎসর পরে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। ধৈর্য, স্থৈর্য, দয়া, সরলতা প্রভৃতি গুণে যুধিষ্ঠির তাঁর পিতা পাণ্ডুর কীর্তিও অতিক্রম করলেন। ভীম বলরামের কাছে অসিযুদ্ধ গদাযুদ্ধ ও রথযুদ্ধ শিখতে লাগলেন। অর্জুন নানাবিধ অস্ত্রের প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন করলেন। সহদেব সব রকমের নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ হলেন। দ্রোণের শিক্ষার ফলে নকুলও অতিরথ এবং চিত্রযোধী নামে খ্যাত হলেন। অর্জুন প্রভৃতি পাণ্ডবগণ বহু দেশ জয় করে নিজেদের রাজ্য বিস্তার করলেন।
পাণ্ডবদের বিক্রমের খ্যাতি অতিশয় বৃদ্ধি পাচ্ছে শুনে ধৃতরাষ্টের মনে ভয়ানক ঈর্ষায় তাঁর নিদ্রার ব্যাঘাত হ’তে লাগল। তিনি কূটনীতিজ্ঞ কণিককে বললেন, পাণ্ডবদের খ্যাতি শুনে আমার হিংসা হচ্ছে, আপনি বলুন কিভাবে আমি পাণ্ডবদের বিনষ্ট করবো।
রাজনীতি কণিক বললেন, মহারাজ, উপযুক্ত কাল না আসা পর্যন্ত শত্রুকে কলসের মতো কাঁধে বইবেন, তার পর সুযোগ এলেই তাকে পাথরের উপর আছড়ে ফেলবেন। যার সর্ব্নাশ করতে চান তার সাথে বিনীত হোয়ে হাসিমুখে কথা বলবেন, কিন্তু তাকে মনোভাব বুঝতে দেবেন না। পরের অনিষ্ট না কোরে ও নিষ্ঠুর কাজ না করে বিপুল ঐশ্বর্যলাভ হয় না। কুরুরাজ, এমন উপায় অবলম্বন করুন যাতে শত্রু বিনষ্ট হয় অথচ আপনাকে অনুতাপ করতে না হয়।
ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছায় পাণ্ডবদের বিনাশের জন্য দুর্যোধন তার মাতুল শকুনি ও কর্ণের সঙ্গে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, পিতা, পুরবাসিগণ যুধিষ্ঠিরকে রাজা করতে চায়। আপনি অন্ধ বলে রাজ্য পাননি, পাণ্ডু পেয়েছিলেন। কিন্তু পাণ্ডুর পুত্ররাই যদি বংশানুক্রমে রাজ্য পায় তবে আমাদের বংশ অবহেলিত হয়ে থাকবে। আপনি কৌশল করে পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসিত করুন, তা হলে আমাদের আর ভয় থাকবে না।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পাণ্ডু যেমন প্রজাদের প্রিয় ছিলেন যুধিষ্ঠিরও তেমন হয়েছেন, তাকে আমরা কি করে নির্বাসিত করতে পারি? ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ তা সমর্থন করবেন না। দুর্যোধন বললেন, আমি অর্থ দিয়ে প্রজাদের বশ করেছি, অমাত্যগণ এবং ধনাগার আমাদের হাতে। ভীষ্মের কোনও পক্ষপাত নেই, অশ্বত্থামা আমাদের পক্ষে আছেন, দ্রোণ ও কৃপ আমাদের পক্ষে থাকবেন। বিদুর আমাদের অর্থে পালিত হয়েও গোপনে পাণ্ডবদের পক্ষে, কিন্তু তিনি একলা আমাদের বাধা দিতে পারবেন না। আপনি পঞ্চপাণ্ডব আর কুন্তীকে বারণাবতে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বললেন, আমি শুনেছি যে বারণাবত অতি রমণীয় নগর এবং সেখানে এখন পশুপতি উৎসব হোচ্ছে, তোমরা সেখানে উৎসব দেখে এবং ব্রাহ্মণদের ধনদান করে কিছুকাল আনন্দে থেকে এসো। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের মতলব বুঝতে পেরেও সম্মত হলেন এবং ভীষ্ম দ্রোণ প্রভৃতির আশীর্বাদ নিয়ে মা ও ভাইদের সঙ্গে নিয়ে বারণাবত যাত্রা করলেন।
দুর্যোধন অতিশয় খুশি হোলেন এবং পুরোচন নামক এক মন্ত্রীকে গোপনে বললেন, তুমি আমার অত্যন্ত বিশ্বাসী। তুমি দ্রুতগামী রথে আজই বারণাবতে যাও এবং শণ, ধুনা প্রভৃতি দিয়ে একটি সুসজ্জিত গৃহ নির্মাণ করাও। মাটির সঙ্গে প্রচুর ঘী, তেল, জতু (গালা) মিশিয়ে তার দেওয়ালে প্রলেপ দেবে এবং চারদিকে কাঠ, তেল প্রভৃতি দাহ্য পদার্থ এমন করে রাখবে যাতে পাণ্ডবরা বুঝতে না পারে। তুমি সমাদর করে পাণ্ডবদের সেখানে বাসের জন্য নিয়ে গিয়ে সেখানে যত্ন কোরে থাকতে দেবে। কিছুকাল পরে যখন তারা নিশ্চিন্তমনে নিদ্রিত থাকবে তখন দ্বারে অগ্নিসংযোগ কোরবে। পুরোচন তখনই দুর্যোধনের আদেশ পালন করতে বারণাবতে গেলেন।
বুদ্ধিমান বিদুর দুর্যোধনের দুষ্ট মতলব বুঝতে পেরেছিলেন। বিদুর ও যুধিষ্ঠির দুজনেই ম্লেচ্ছভাষা জানতেন যা অন্য কেউ জানতেন না। যুধিষ্ঠিরের যাত্রাকালে বিদুর ম্লেচ্ছভাষায় তাকে বললেন, শত্রুর মতলব যে জানে সে বিপদ থেকে নিস্তারের উপায় করে। লোহার অস্ত্র ছাড়া অন্য অস্ত্রেও প্রাণনাশ হয়। আগুনে বন দগ্ধ হয় কিন্তু গর্তবাসীর প্রাণহানি হয় না। মানুষ শজারুর মতো সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারে। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, বুঝেছি।
পথে যেতে যেতে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন, বিদুর তোমাকে অবোধ্য ভাষায় কি বললেন আর তুমিও বুঝেছি বললে, এর অর্থ কি? যুধিষ্ঠির বললেন, বিদুরের কথার অর্থ “আমাদের ঘরে আগুন লাগবে, পালাবার জন্য সকল পথই যেন আমরা চিনে রাখি”।
পাণ্ডবগণ বারণাবতে এলে পুরোচন মহা সমাদরে তাদের এক বাসভবনে নিয়ে গেলেন এবং আহার শয্যা প্রভৃতির ব্যবস্থা করলেন। সেখানে দশ রাত্রি বাসের পর তিনি পাণ্ডবদের অন্য এক ভবনে নিয়ে গেলেন, যে ভবনটি মাটির সঙ্গে প্রচুর ঘী, তেল, জতু (গালা) মিশিয়ে তৈরী। যুধিষ্ঠির সেখানে গিয়ে ঘী, চর্বি ও জতুর গন্ধ পেয়ে ভীমকে বললেন, নিপুণ শিল্পীরা এই গৃহ দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরী করেছে। পাপী পুরোচন আমাদের দগ্ধ করতে চায়। ভীম বললেন, যদি মনে করেন এখানে আগুনের ভয় আছে তবে আগের বাসস্থানে চলুন। যুধিষ্ঠির তাতে রাজি হোলেন না। যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা সন্দেহ করছি জানলে পুরোচন বলপ্রয়োগ করে আমাদের দগ্ধ করবে। যদি পালিয়ে যাই তবে দুর্যোধনের চরেরা আমাদের হত্যা করবে। আমরা মৃগয়ার নাম কোরে এই এলাকায় বিচরণ করে পথ জেনে রাখব এবং এই জতুগৃহের ভূমিতে গর্ত করে তার ভিতরে বাস করবো।
সেই সময়ে একটি লোক এসে নির্জনে পাণ্ডবদের বললো, আমি খনন কার্যে দক্ষ, বিদুর আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনাদের যাত্রার পূর্বে তিনি ম্লেচ্ছভাষায় যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করেছিলেন তা আমি জানি। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর রাতে পুরোচন এই গৃহের দ্বারে আগুন দেবে। এখন আমাকে কি করতে হবে বলুন। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি গোপনে আমাদের রক্ষার উপায় কর। তখন সেই লোকটি গৃহমধ্যে গর্ত করে এক বৃহৎ সুড়ঙ্গ প্রস্তুত করে তার প্রবেশের পথে কপাট লাগিয়ে ভূমির সমান করে দিল, যাতে কেউ বুঝতে না পারে। পুরোচন গৃহের দ্বারেই বাস করও, সেজন্য সুড়ঙ্গের মুখ ঢেকে দেওয়া হোলো। পাণ্ডবরা দিনের বেলা এক বন থেকে অন্য বনে মৃগয়া করতেন। এবং রাত্রিকালে সশস্ত্র ও সতর্ক হয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে বাস করতেন।
বেশ কিছুদিন পরে পুরোচন ঠিক করলো যে এখন পাণ্ডবদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। অন্যদিকে যুধিষ্ঠির তাঁর ভাইদের বললেন, এখন আমাদের পলায়নের সময় এসেছে, আমরা রাতের অন্ধকারে আগুন দিয়ে পুরোচনকে এবং অন্য ছ জনকে দগ্ধ করবো এবং এখানে রেখে চলে যাবো। তারপর, পরিকল্পনা অনুযায়ী একদিন কুন্তী ব্রাহ্মণভোজন করালেন, অনেক স্ত্রীলোকও এল, তারা যথেচ্ছ পানভোজন করে রাতের বেলা চলে গেলো। কিন্তু, এক নিষাদের স্ত্রী তার পাঁচ পুত্রকে নিয়ে খেতে এসেছিল, সে পুত্রদের সঙ্গে প্রচুর মদ্যপান করে অচেতন হোয়ে গৃহমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। সকলে ঘুমিয়ে পড়লে ভীম পুরোচনের শয়নকক্ষে, জতুগৃহের দ্বারে এবং চতুর্দিকে আগুন লাগিয়ে দিলেন। পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী সুড়ঙ্গপথে নিরাপদে বেরিয়ে গেলেন। প্রবল বায়ুতে জতুগৃহের সবদিক জ্বলে উঠল, আগুনের উত্তাপে ও শব্দে নগরবাসীরা জেগে উঠে বলতে লাগল, পাপিষ্ঠ পুরোচন দুর্যোধনের আদেশে এই গৃহদাহ করে পাণ্ডবদের বধ করেছে।
পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী গোপনে সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু ভয়ে এবং ক্লান্তিতে তারা সবাই ঠিকমতো চলতে পারছিলেন না। তখন ভীম কুন্তীকে কাঁধে এবং নকুল ও সহদেবকে কোলে নিয়ে যুধিষ্ঠির এবং অর্জুনের হাত ধরে দ্রুতবেগে চললেন। এদিকে বিদুরের একজন বিশ্বস্ত অনুচর নদীর তীরে একটি দ্রুতগামী নৌকা রেখেছিল। পাণ্ডবগণকে নদীর অপর পারে এনে বিদুরের অনুচর করে চলে গেলো।
নৌকা থেকে নেমে পাণ্ডবরা নক্ষত্র দেখে দক্ষিণ দিকে যেতে লাগলেন। দুর্গম দীর্ঘ পথ অতিক্রম কোরে পরদিন সন্ধ্যায় তারা এক গভীর বনে উপস্থিত হোলেন। কুন্তী প্রভৃতি সকলে তৃষ্ণায় কাতর হওয়ায় ভীম পদ্মপাতায় এবং উত্তরীয় ভিজিয়ে জল নিয়ে এলেন। সকলে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, কেবল ভীম জেগে থেকে পাহারা দিতে থাকলেন।
সকাল হোলে বারণাবতবাসীরা আগুন নিবিয়ে দেখলে পুরোচন পুড়ে মরেছে। পাণ্ডবদের খুঁজতে খুঁজতে তারা নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রের পোড়া শরীর দেখতে পেয়ে মনে করলো যে কুন্তী ও পঞ্চপাণ্ডব নিহত হয়েছেন। তারা সুড়ঙ্গ দেখতে পেল না, কারণ বিদুরের বিশ্বস্ত লোক তা ইতিমধ্যে মাটি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল। হস্তিনাপুরে কুন্তিসহ পাণ্ডবদের মৃত্যুসংবাদ গেলে ধৃতরাষ্ট্র বহু বিলাপ করলেন এবং কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদির অন্ত্যেষ্টির জন্য বারণাবতে লোক পাঠালেন।
______________
(ক্রমশ)