Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 17

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-১৭

ভীম ও হিড়িম্বার বিবাহ এবং ঘটোৎকচের জন্ম

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

ভীম ও হিড়িম্বার বিবাহ এবং ঘটোৎকচের জন্ম
 

পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী জাতুগৃহ থেকে গোপনে সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় তারা এক গভীর বনে উপস্থিত হোলেন। সকলে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, কেবল ভীম জেগে থেকে পাহারা দিতে থাকলেন।

কুন্তী, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল ও সহদেব যেখানে ঘুমিয়ে ছিলেন তার কাছেই একটি বিশাল গাছের উপর বিশাল শরীর, রক্তের মতো লাল চোখ, বড় বড় হলুদ রঙের দাঁতবিশিষ্ট হিড়িম্ব নামে এক ভয়ংকর রাক্ষস ছিলো। হিড়িম্ব ওই বনে তার বোন হিড়িম্বার সঙ্গে থাকতো আর নানা রকম জন্তু-জানোয়ার ও মাঝে মাঝে মানুষের মাংস খেতো। পাণ্ডবদের দেখে হিড়িম্বের মনে মানুষের মাংস খাওয়ার ইচ্ছা হোলো। হিড়িম্ব তার বোন হিড়িম্বাকে বললো, বহু কাল পরে আমার প্রিয় খাদ্য মানুষ এসেছে,  আজ আমরা মানুষের নরম মাংস খাবো। তুই গিয়ে ওদের মেরে নিয়ে আয়, আজ আমরা দুজনে প্রচুর নরমাংস খাবো।

ভাইয়ের কথা শুনে হিড়িম্বা গাছের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে পাণ্ডবদের কাছে এসে দেখল সকলেই ঘুমিয়ে আছে, কেবল একজন জেগে আছে। ভীমকে দেখে সে ভাবলে, এই বিরাট শক্তিশালী উজ্জ্বলকান্তি পুরুষই আমার স্বামী হবার যোগ্য। আমি ভাইয়ের কথা শুনবো না, ভাইয়ের চেয়ে পতি বড়। এই ভেবে হিড়িম্বা সুন্দরী সালংকারা নারীর রূপ ধারণ করে ভীমের কাছে এসে লাজুক হেসে বললো, পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি কে আর কোথা থেকে এসেছেন? এই ঘুমিয়ে থাকা দেবতুল্য পুরুষরা এবং এই কল্যাণময়ী রমণী যাঁরা ঘুমিয়ে রয়েছেন এঁরা কে? এই বনে আমার ভাই হিড়িম্ব নামে এক রাক্ষস থাকে, সে আপনাদের মাংস খেতে চায় সেজন্য আমাকে পাঠিয়েছে। আপনাকে দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি, আপনি আমাকে বিয়ে করুন। আমি আকাশপথে চলতে পারি, আমি আপনার সঙ্গে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াবো। ভীম বললেন, রাক্ষসী, ঘুমিয়ে থাকা মা ও ভাইদের রাক্ষসের কবলে ফেলে কে চলে যেতে পারে? হিড়িম্বা বললো, এঁদের জাগান, আমি সকলকে রক্ষা করব। ভীম বললেন, এঁদের আমি এখন জাগাতে পারব না। রাক্ষস বা যক্ষ গন্ধর্ব সকলকেই আমি পরাস্ত করতে পারি। তুমি যাও বা থাকো বা তোমার ভাইকে এখানে পাঠিয়ে দাও, আমি কাঊকে ভয় পাই না।

হিড়িম্বার ফিরতে দেরী হোচ্ছে দেখে হিড়িম্ব দ্রুতবেগে পাণ্ডবদের কাছে আসতে লাগলো। ভাইকে আসতে দেখে, হিড়িম্বা ভীমকে বলল, আপনারা সকলেই আমার পিঠে চড়ে বসুন, আমি আকাশপথে আপনাদের নিয়ে যাবো। ভীম বললেন, তোমার ভয় নেই, মানুষ বলে আমাকে দুর্বল ভেবোনা। হিড়িম্ব এসে দেখল, তার বোন সুন্দরী নারীর রূপ ধরে, অপুর্ব সুন্দর পোশাক, অলংকার এবং মাথায় ফুলের মালা পরে ভীমের পাশে বসে আছে। সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বললে, তুই অসতী, তাই এদের সঙ্গে তোকেও মেরে ফেলবো। এই বলে সে পাণ্ডবদের দিকে ধেয়ে এল। ভীম বলল, রাক্ষস, এঁদের জাগিয়ে কি হবে, আমার সঙ্গে লড়াই করো। তার পর ভীম আর হিড়িম্বের ঘোর লড়াই আরম্ভ হল। পাছে মা ও ভাইদের নিদ্রাভঙ্গ হয় সেজন্য ভীম রাক্ষসকে দূরে টেনে নিয়ে গেলো, কিন্তু লড়াইযের শব্দে সকলেই জেগে উঠলেন।

কুন্তী হিড়িম্বাকে বললেন, দেবকন্যার মতো দেখতে তুমি কে? হিড়িম্বা নিজের পরিচয় দিয়ে বললো যে সে ভীমের পত্নী হোতে চায়। অর্জুন ভীমকে বললেন, আপনি দেরী করবেন না, ওই রাক্ষসটাকে তাড়াতাড়ি মেরে ফেলুন। তখন ভীম হিড়িম্বকে তুলে ধরে ঘোরাতে লাগলেন এবং তার পর ভূমিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে মেরে ফেললেন।

অর্জুন বললেন, আমার মনে হয় এখান থেকে নগর বেশী দূরে নয়, চলুন আমরা তাড়াতাড়ি সেখানে যাই। ভীম হিড়িম্বাকে বললেন, রাক্ষসেরা নানা মায়ার বলে শত্রুতা করে, আমি তোমাকেও মেরে ফেলবো। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি স্ত্রীহত্যা করো না। হিড়িম্বা কুন্তীকে প্রণাম করে করজোড়ে বললে, মা, আমি স্বজন ত্যাগ করে আপনার এই বীর পুত্রকে পতিরূপে বরণ করেছি, আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমি বাঁচব না, আপনি আমাকে দয়া করুন। আপনার পুত্রের সঙ্গে আমাকে বিবাহ দিন। আমি ওঁকে নিয়ে ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াবো, তার পর আমাকে মনে মনে ভাবলেই আমি ওঁকে নিয়ে উপস্থিত হবো।

যুধিষ্ঠির বললেন, হিড়িম্বা, ভীমের সঙ্গে তোমার বিয়ে হোতে পারে, কিন্তু তোমাকে এই নিয়ম পালন করতে হবে যে, ভীম স্নান আহ্নিক কোরে দিনের বেলা তোমার সঙ্গে থাকবে এবং সূর্যাস্ত হলেই আমাদের কাছে ফিরে আসবে। ভীম হিড়িম্বাকে বললেন, যত দিন তোমার পুত্র না হয় তত দিনই আমি তোমার সঙ্গে থাকব। হিড়িম্বা সম্মত হোয়ে ভীমকে নিয়ে আকাশপথে চলে গেলো।

কিছুকাল পরে হিড়িম্বার একটি ভয়ঙ্কর শক্তিশালী পুত্রের জন্ম হোলো। হিড়িম্বার পুত্র জন্মাবার পরে যৌবনলাভ করে সর্বপ্রকার অস্ত্র চালনায় অত্যন্ত দক্ষ হোলো। তার মা মাথায় চুল ছিলো না, সেজন্য হিড়িম্বা পুত্রের নাম রাখল ঘটোৎকচ। ঘটোৎকচ কুন্তী ও পাণ্ডবদের প্রণাম করে বললো, এবার আমাকে কি করতে হবে আদেশ করুন। কুন্তী বললেন, বৎস, তুমি সাক্ষাৎ ভীমের পুত্র এবং পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তুমি প্রয়োজনে আমাদের সাহায্য করো। ঘটোৎকচ বলল, আপনাদের প্রয়োজন হোলে আমাকে স্মরণ করলেই আমি উপস্থিত হব। এই বলে সে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

তারপর পাণ্ডবরা তপস্বীর বেশে মৎস্য, ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল ও কীচক দেশের ভিতর দিয়ে চললেন। যেতে যেতে পিতামহ বেদব্যাসের সঙ্গে তাদের দেখা হোলো। বেদব্যাস বললেন, আমি তোমাদের সমস্ত বৃত্তান্ত জানি, বিষণ্ণ হয়ো না, তোমাদের মঙ্গল হবে। যত দিন আমার সঙ্গে আবার দেখা না হয় তত দিন তোমরা ছদ্মবেশে একচক্রা নগরে আমার পরিচিত এক ব্রাহ্মণের গৃহে বাস কর। এই কথা বলে বেদব্যাস পাণ্ডবগণকে সেই ব্রাহ্মণের গৃহে রেখে চলে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)