মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২১
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর ও অর্জুনের লক্ষ্যভেদ
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
দ্রৌপদীর স্বয়ংবর ও অর্জুনের লক্ষ্যভেদ
পাণ্ডবগণ ধৌম্যের আশ্রমে গিয়ে তাকে পুরোহিত নিয়ুক্ত করবার পরে পাণ্ডবগণ তাঁদের মাতাকে নিয়ে ব্রহ্মচারীর বেশে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর দেখবার জন্য পাঞ্চালদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। পাঞ্চালযাত্রী বহু ব্রাহ্মণের সঙ্গে তাদের পথে আলাপ হল। ব্রাহ্মণরা বললেন, তোমরা দেবতুল্য রূপবান, দ্রুপদকন্যা কৃষ্ণা হয়তো তোমাদের একজনকে পতিরূপে বরণ করবেন। পাঞ্চালদেশে এসে পাণ্ডবরা ভার্গব নামে এক কুম্ভকারের অতিথি হলেন এবং ব্রাহ্মণের বেশে ভিক্ষাবৃত্তি দ্বারা জীবিকানির্বাহ করতে লাগলেন।
দ্রুপদের ইচ্ছা ছিল যে অর্জুনকে কন্যাদান করবেন। অর্জুনকে যাতে পাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে তিনি এমন এক ধনু নির্মাণ করালেন যা নোয়ানো প্রায় অসম্ভব। তা ছাড়া তিনি শূন্যে একটি ছিদ্রয়ুক্ত যন্ত্র স্থাপিত করে তার উপরে লক্ষ্য বস্তুটি রাখলেন। দ্রুপদ ঘোষণা করলেন, যিনি এই ধনুতে গুণ পরাতে পারবেন এবং যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে শর দ্বারা লক্ষ্যভেদ করবেন তিনি আমার কন্যাকে পাবেন। এই ঘোষণা শুনে কর্ণের সঙ্গে দুর্যোধনাদি এবং বহু দেশ থেকে রাজা ও ব্রাহ্মণরা স্বয়ংবর-সভায় এলেন। দ্রুপদ তাদের সেবার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিলেন। নগরের একদিকে সমতলভূমিতে বিশাল সভা নির্মিত হোলো তার চতুর্দিক বাসভবন, প্রাচীর, পরিখা ও তোরণে শোভিত। আগন্তুক রাজারা উচ্চ শুভ্র প্রাসাদে মহা সুখে বাস করতে লাগলেন।
রাজারা বহুমূল্য পোশাকে সজ্জিত হোয়ে সভাস্থলে নির্দিষ্ট আসনে এসে বসলেন। নগরবাসী ও গ্রামবাসীরা দ্রৌপদীকে দেখবার জন্য উৎসুক হয়ে তাদের জন্য নির্দিষ্ট মঞ্চের উপরে বসল, পাণ্ডবরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বসে পাঞ্চালরাজের ঐশ্বর্য দেখতে লাগলেন। অনেকদিন ধরে নাচ, গান ও ধনরত্নদান চলার পর ষোলোতম দিনে দ্রৌপদী স্নান করে বহুমূল্য বসন ও অলংকারে ভূষিতা হোয়ে সভায় উপস্থিত হোলেন। দ্রুপদের কুলপুরোহিত যথানিয়মে হোম করে আহুতি দিলেন এবং স্বস্তিবাচন করিয়ে সমস্ত নাচ-গান থামিয়ে দিলেন। সভা নিঃশব্দ হোলে ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীকে সভার মধ্যদেশে নিয়ে এলেন এবং উচ্চস্বরে বললেন, সমবেত ভূপতিগণ, আমার কথা শুনুন - এই ধনু, বাণ এবং ওই লক্ষ্য। ওই যন্ত্রের ছিদ্র দিয়ে পাঁচটি বাণ চালিয়ে লক্ষ্য বিদ্ধ করতে হবে। উচ্চকুলজাত রূপবান ও বলবান যে ব্যক্তি এই লক্ষ্য বিদ্ধ করতে পারবেন, আমার বোন কৃষ্ণা তার স্ত্রী হবেন।
তার পর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীকে সভায় উপস্থিত রাজাগণের পরিচয় দিলেন, যথা — দুর্যোধন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, কর্ণ, শকুনি, অশ্বত্থামা, ভোজরাজ, বিরাটরাজ, পৌণ্ড্রক বাসুদেব, ভগদত্ত, কলিঙ্গরাজ, শল্য, বলরাম, কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, জয়দ্ৰথ, শিশুপাল, জরাসন্ধ এবং আরও বহু রাজা।
সুবেশী যুবক রাজারা গর্ব কোরে বলতে লাগলেন, দ্রৌপদী আমারই পত্নী হবেন। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে থাকলেও পঞ্চপাণ্ডবকে দেখে কৃষ্ণ চিনতে পারলেন এবং বলরামকে তাদের কথা বললেন। বলরামও তাদের দেখে আনন্দিত হলেন। অন্যান্য রাজা ও রাজপুত্রগণ দ্রৌপদীকে অপলকে দেখছিলেন এবং তারা পাণ্ডবদের দেখতে পেলেন না। যুধিষ্ঠির ও তার ভাইয়েরা সকলেই দ্রৌপদীকে দেখে মুগ্ধ হোলেন। তারপর একে একে রাজারা ও রাজপুত্রেরা সদর্পে লক্ষ্যভেদ করতে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু তারা ধনুতে গুণ পরাতে পারলেন না।
তখন কর্ণ এগিয়ে গিয়ে সেই ধনু তুলে নিয়ে তাতে গুণ পরালেন। পাণ্ডবগণ এবং আর সকলে স্থির করলেন, কর্ণ নিশ্চয় সিদ্ধিলাভ করবেন। কিন্তু কর্ণকে দেখে দ্রৌপদী উচ্চস্বরে বললেন, আমি সূতপুত্রকে বরণ করব না। কর্ণ সূর্যের দিকে চেয়ে সক্রোধে ধনু ত্যাগ কোরে ফিরে গেলেন।
তার পর শিশুপাল ধনুতে গুণ পরাতে গেলেন, কিন্তু না পেরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। মহাবীর জরাসন্ধেরও ওই অবস্থা হোলে, তিনি উঠে নিজ রাজ্যে চলে গেলেন। শল্যও অক্ষম হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। তখন ব্রাহ্মণদের মধ্য থেকে অর্জুন উঠে দাঁড়ালেন। কেউ তাকে বারণ করলেন, কেউ বললেন, শল্য প্রভৃতি মহাবীর অস্ত্রজ্ঞ ক্ষত্রিয়রা যা পারলেন না একজন দুর্বল ব্রাহ্মণ তা কি করে পারবে। একজন বললেন, এই শ্রীমানকে দেখে বোধ হচ্ছে এ কৃতকার্য হবে।
ধনুর কাছে গিয়ে অর্জুন কিছুক্ষণ অচল হয়ে রইলেন, তার পর ধনু প্রদক্ষিণ কোরে মহাদেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম এবং কৃষ্ণকে স্মরণ কোরে ধনু তুলে নিলেন। তার পর তাতে অনায়াসে গুণ পরিয়ে পাঁচটি শর সন্ধান করে যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন। লক্ষ্য বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। সভামধ্যে তুমুল কোলাহল উঠল, দেবতারা অর্জুনের মস্তকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন, ব্রাহ্মণেরা তাদের উত্তরীয় নাড়তে লাগলেন, রাজারা লজ্জিত হয়ে হায় হায় বলতে লাগলেন। দ্রুপদ অতিশয় আনন্দিত হোলেন। সভায় কোলাহল বাড়তে লাগল, নকুল-সহদেবকে সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠির তাদের বাসভবনে চলে গেলেন।
দ্রৌপদী হাসিমুখে সেই সভায় উপস্থিত রাজা ও ব্রাহ্মণগণের সামনে অর্জুনের গলায় বরমাল্য পরালেন। তার পর ব্রাহ্মণগণের প্রশংসাবাক্য শুনতে শুনতে অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন।
______________
(ক্রমশ)