Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 29

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-২৯

যুধিষ্ঠিরকে নারদের উপদেশ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

 

যুধিষ্ঠিরকে নারদের উপদেশ

একদিন দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সঙ্গে ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের নবনির্মিত সভায় উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির যথাবিধি আসন দিয়ে পঞ্চঋষিকে সংবর্ধনা করলে, নারদ যুধিষ্ঠিরকে নানা প্রশ্ন করলেন এবং ধর্ম, কাম ও অর্থ বিষয়ক বহু উপদেশ দিলেন।

নারদ বললেন - মহারাজ, তুমি অর্থচিন্তার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মচিন্তাও কর তো? সময়কে কাল অনুযায়ী বিভাগ করে সমভাবে ধর্ম অর্থ ও কামের সেবা কর তো? তোমার সকল দুর্গ যেন ধন, ধান্য, জল, অস্ত্র, যন্ত্র, যোদ্ধা, ও শিল্পিগণে পরিপূর্ণ থাকে। কঠোর দণ্ড দিয়ে তুমি যেন প্রজাদের বিরাগভাজন হয়ো না। বীর, বুদ্ধিমান, পবিত্র স্বভাব, সদ্বংশজ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে সেনাপতি করবে। সৈন্যগণকে যথাকালে খাদ্য ও বেতন দেবে। শরণাগত শত্রুকে সন্তানের মতো রক্ষা করবে। পরের রাজ্য জয় করে যে ধনরত্ন পাওয়া যাবে, তার ভাগ প্রধান প্রধান যোদ্ধাদের যোগ্যতা অনুসারে দেবে। তোমার যা আয় তার অর্ধেক অংশে বা এক-তৃতীয়াংশে বা এক-চতুর্থাংশে নিজের ব্যয় নির্বাহ করবে। প্রত্যেক দিনের শুরুতে হিসাবরক্ষক ও করণিক গণ তোমাকে আয়ব্যয়ের হিসাব দেবে। লোভী, চোর, হিংসাশ্রয়ী আর অল্পবয়স্ক লোককে কাজের দায়িত্বভার দেবে না। তোমার রাজ্যে যেন বড় বড় জলাশয় থাকে, যাতে কৃষিকাজ কেবল বৃষ্টির উপর নির্ভর না করে। কৃষকদের যেন বীজ আর খাদ্যের অভাব না হয় এবং তারা যেন অল্প সুদে ঋণ পায়। তুমি নারীদের সঙ্গে মিষ্টবাক্যে আলাপ করবে কিন্তু কখনও কোনো গোপনীয় বিষয় বলবে না। লক্ষ্য রাখবে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে বিবাদ হলে তোমার অমাত্যরা যেন উৎকোচ নিয়ে অন্যায় বিচার না করে। অন্ধ, বোবা, পঙ্গু, অনাথ ও ভিক্ষুকদের পিতার ন্যায় পালন করবে। অতিরিক্ত নিদ্রা, আলস্য, ভয়, রাগ, ঢিলেমি ও লঘুভাব এই ছয় প্রকার দোষ পরিহার করবে।

নারদকে প্রণাম কোরে যুধিষ্ঠির বললেন, আপনার উপদেশে আমার জ্ঞানবৃদ্ধি হোলো, আপনি যা বললেন তাই আমি পালন করবো। আপনি যে রাজধর্ম বিবৃত করলেন, তা আমি যথাশক্তি পালন করে থাকি। আমি সৎপথেই চলতে ইচ্ছা করি, কিন্তু আগে ভূপতিগণ যে ভাবে কর্তব্যপালন করতেন, তা আমি পারি না। তার পর যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি সব জায়্গায় বিচরণ কোরে থাকেন, তাই আমাকে কৃপা কোরে বলুন আপনি আমার এই সভার তুল্য বা এর চেয়ে ভাল কোনও সভা দেখেছেন কি? নারদ সহাস্যে বললেন, তোমার এই সভার তুল্য অন্য সভা আমি মনুষ্যলোকে দেখি নি, শুনিও নি। তবে, আমি ইন্দ্র, যম, বরুণ, কুবের ও ব্রহ্মার সভার কথা বলছি শোন-

ইন্দ্রের সভা দেড় শত যোজন দীর্ঘ, শত যোজন বিস্তার, পাঁচ যোজন উচ্চ। সেই সভা ইচ্ছা মতো আকাশে চালিত করা যায়। সেখানে জরা, শোক, ক্লান্তি নেই। ইন্দ্রাণী শচী সেখানে লক্ষ্মী, কীর্তি, ও দ্যুতি দেবীর সঙ্গে বিরাজ করেন। দেবগণ, সিদ্ধ ও সাধু পুরুষগণ, বহু মহর্যি, রাজা হরিশ্চন্দ্র, গন্ধর্ব ও অপ্সরা সকল সেখানে থাকেন। যমের সভা সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বল, তার বিস্তার শত যোজন, দৈর্ঘ্য আরও বেশী। স্বর্গীয় ও পার্থিব সমস্ত ভোগ্য বস্তু সেখানে আছে। যযাতি, নহুষ, পুরু, মান্ধাতা, ধ্রুব, কার্তবীর্যার্জুন, ভরত, নল, ভগীরথ, রাম-লক্ষ্মণ, তোমার পিতা পাণ্ডু প্রভৃতি সেখানে থাকেন। বরুণের সভা জলের মধ্যে নির্মিত, যা দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে যমের সভার সমান, তার প্রাচীর ও তোরণ শুভ্র। সেই সভা অধিক শীতল নয় উষ্ণও নয়, সেখানে বাসুকি, তক্ষক প্রভৃতি নাগগণ এবং দৈত্যরাজ বলি থাকেন। চার সমুদ্র, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি নদী, তীর্থ-সরোবর, পর্বতসমূহ এবং জলচরগণ সেখানে বরুণের উপাসনা করে। কুবেরের সভা এক শ যোজন দীর্ঘ, সত্তর যোজন বিস্তৃত, কৈলাস পর্বতের মতো উচ্চ ও শুভ্র। যক্ষগণ সেই সভা আকাশে বহন করে। কুবের সেখানে বাস করেন, দেবতা ও গন্ধর্বগণ অপ্সরাদের সঙ্গে গান করেন। মিশ্রকেশী, মেনকা, উর্বশী প্রভৃতি অপ্সরা, যক্ষ ও রাক্ষসগণ, বিশ্বাবসু, হাহা হুহু প্রভৃতি গন্ধর্ব এবং বিভীষণ সেখানে থাকেন। পুলস্ত্যের পুত্র কুবের শিবকে নতশিরে প্রণাম করে সেই সভায় উপবেশন করেন।

মহারাজ, আমি সূর্যের আদেশে হাজার বছর ব্রহ্মব্রত অনুষ্ঠান করি, তার পর তার সঙ্গে ব্রহ্মার সভায় যাই। সেই সভা অবর্ণনীয়, তার রূপ ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। সেখানে ক্ষুধা, পিপাসা বা ক্লান্তি নেই, তার উজ্জ্বলতা সূর্যের উজ্জ্বলতার থেকেও অধিক। দক্ষ, প্রচেতা, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, দুর্বাসা, সনৎকুমার, অসিতদেব, প্রভৃতি মহাত্মা, আদিত্য, বসু, রুদ্র প্রভৃতি গণদেবতা, এবং শরীরী ও অশরীরী পিতৃগণ সেখানে ব্রহ্মার উপাসনা করেন। যুধিষ্ঠির, দেবতাদের এই সকল সভা আমি দেখেছি এবং মনুষ্যলোকে সর্বশ্রেষ্ঠ তোমার সভাও এখন দেখলাম।

যুধিষ্ঠির বললেন, মুনিবর, ইন্দ্রসভার বর্ণনায় আপনি একমাত্র রাজর্ষি হরিশ্চন্দ্রের নামই বললেন। তিনি কোন্ পূণ্যকর্মের ফলে সেখানে গেলেন? আপনি যমের সভায় আমার পিতা পাণ্ডুকে দেখেছেন। তিনি কি বলেছেন তাও জানতে আমার পরম কৌতুহল হচ্ছে।

নারদ বললেন, রাজা হরিশ্চন্দ্র সকল রাজার অধীশ্বর সম্রাট ছিলেন, তিনি রাজসূয় যজ্ঞে ব্রাহ্মণগণকে বিস্তর ধন দান করেছিলেন। যে রাজারা রাজসূয় যজ্ঞ করেন, যাঁরা পলায়ন না করে সংগ্রামে নিহত হন এবং যাঁরা তীব্র তপস্যায় কলেবর ত্যাগ করেন, তারা ইন্দ্রসভায় নিত্য বিরাজ করেন। হরিশ্চন্দ্রের শ্রীবৃদ্ধি দেখে তোমার পিতা পাণ্ডু বিস্মিত হয়েছেন এবং আমাকে অনুরোধ করেছেন যেন মর্ত্যলোকে এসে তার এই কথা আমি তোমাকে বলি। যুধিষ্ঠির, তুমি পৃথিবী জয় করতে সমর্থ, তোমার ভাইয়েরা তোমাকে মান্য করে। এখন তুমি শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ রাজসূয়ের অনুষ্ঠান করো, তা হলে পাণ্ডুও হরিশ্চন্দ্রের ন্যায় ইন্দ্রসভায় বহুকাল সুখভোগ করতে পারবেন। অতএব যুধিষ্ঠির, তুমি তোমার পিতার এই ইচ্ছা পালন করো। এই উপদেশ দিয়ে নারদ তার সঙ্গী ঋষিদের নিয়ে দ্বারকার অভিমুখে যাত্রা করলেন।

______________

(ক্রমশ)