মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৪১
ইন্দ্রলোকে অর্জুন ও উর্বশীর সাক্ষাৎকার
প্রাককথন
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।
সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।
অশোক ঘোষ
ইন্দ্রলোকে অর্জুন ও উর্বশীর সাক্ষাৎকার
অর্জুনকে যম তাঁর দণ্ড, বরুণ তাঁর পাশ এবং কুবের অন্তর্ধান নামক অস্ত্র দান করার পরে ইন্দ্র বললেন, অর্জুন, উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তোমাকে দেবলোকে যেতে হবে, সেখানেই তোমাকে সমস্ত দিব্যাস্ত্র দান করবো। অর্জুনকে অস্ত্র দান করবার পরে বরুণ, কুবের, যম, এবং ইন্দ্র চলে গেলো।
বরুণ, কুবের, যম, এবং ইন্দ্র চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আকাশ আলোকিত কোরে গম্ভীর শব্দে ইন্দ্রের রথ অর্জুনের সামনে উপস্থিত হোলো। সেই রথের মধ্যে অসি, শক্তি, গদা, প্রাস, বিদ্যুৎ, বজ্র ইত্যাদি নানাবিধ ভয়ঙ্কর অস্ত্র ছিল। মাতলি বললেন, অর্জুন রথে ওঠো, দেবরাজ ও অন্য দেবগণ তোমাকে দেখবার জন্য প্রতীক্ষা করছেন। অর্জুন বললেন, তুমি আগে রথে ওঠো, তার পর আমি উঠব। অর্জুন গঙ্গায় স্নান করে পবিত্র হয়ে মন্ত্রজপ ও পিতৃতর্পণ করলেন, তার পর হিমালয়ের স্তব করে রথে উঠলেন। সেই আশ্চর্য রথ আকাশে উঠে মানুষের অদৃশ্য লোকে এল, যেখানে চন্দ্র, সূর্য বা আগুনের দীপ্তি নেই। পৃথিবী থেকে যে উজ্জ্বল তারকাসমূহ দেখা যায়, সেগুলি আকারে বিশাল হলেও দূরত্বের জন্য প্রদীপের মতো ক্ষুদ্র বোধ হয়। অর্জুন সেইসব তারকাদের দীপ্তিমান দেখলেন। মাতলি বললেন, অর্জুন, ভূতল থেকে যাঁদের তারকারূপে দেখেছ, তারা এখানে অবস্থান করছেন।
অর্জুন অমরাবতীতে এলে দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ খুশি হয়ে তার সংবর্ধনা করলেন। তিনি সবাইকে প্রণাম করলে ইন্দ্র তাঁকে নিজের সিংহাসনে বসালেন। তখন গন্ধর্বগণ গান গাইতে লাগলেন, ঘৃতাচী, মেনকা, রম্ভা, উর্বশী প্রভৃতি মনোহারিণী অপ্সরারা নাচতে লাগলেন। তার পর দেবগণ অর্জুনকে সাদরে ইন্দ্রের ভবনে নিয়ে গেলেন।
ইন্দ্রের নিকট নানাবিধ অস্ত্র শিক্ষা করে অর্জুন অমরাবতীতে পাঁচ বৎসর সুখে বাস করলেন। তিনি ইন্দ্রের আদেশে গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে নৃত্য,,গীত, বাদ্য শিখলেন। একদিন চিত্রসেন উর্বশীর কাছে গিয়ে বললেন, দেবরাজের আদেশে তোমাকে জানাচ্ছি যে অর্জুন তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন, তিনি আজ তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। উর্বশী নিজেকে সম্মানিত জ্ঞান করে হাসিমুখে বললেন, আমিও তাঁর প্রতি অনুরক্ত। তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হবো।
উর্বশী স্নান করে মনোহর অলংকার ও সুগন্ধিত ফুলের মালা ধারণ করলেন এবং চন্দ্রোদয় হলে অর্জুনের ভবনে যাত্রা করলেন। উর্বশী তাঁর ফুল দিয়ে সাজানো কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশ, শরীর দিব্য অঙ্গরাগে চর্চিত, প্রতি পদক্ষেপে চন্দন ও হারে বিভূষিত তাঁর সুমুখ স্তনযুগল ঈষৎ দোলায়মান, অল্প মদ্যপান, কামাবেশ ও বিলাসবিভ্রমের জন্য তিনি নিজেকে অতিশয় দর্শনীয়া করলেন।
দ্বাররক্ষীর মুখে উর্বশীর আগমন সংবাদ পেয়ে অর্জুন এগিয়ে এলেন এবং উর্বশীকে দেখে লজ্জায় নিজের চোখ ঢেকে বললেন, দেবী আপনাকে অভিবাদন করছি, বলুন আমাকে কি করতে হবে, আমি আপনার আজ্ঞাবহ। অর্জুনের কথা শুনে উর্বশীর যেন চৈতন্য লোপ হোয়ে গেল। তিনি বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন, চিত্রসেন আমাকে যা বলেছেন শোন। তোমার আগমনের জন্য ইন্দ্র যে আনন্দ উৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন তাতে দেবতা, মহর্ষি, রাজর্ষি প্রভৃতির সামনে গন্ধর্বগণ বীণা বাজিয়েছিলেন, শ্রেষ্ঠ অপ্সরারা নৃত্য করেছিলেন। পার্থ, সেই সময়ে তুমি নাকি অনিমেষ নয়নে শুধু আমাকেই দেখেছিলে। সভা শেষ হওয়ার পরে তোমার পিতা ইন্দ্র চিত্রসেনকে দিয়ে আমাকে আদেশ জানালেন, আমি যেন তোমার সঙ্গে মিলিত হই। এই কারণেই আমি তোমার কাছে এসেছি। তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমি কামার্ত হয়েছি।
লজ্জায় কান ঢেকে অর্জুন বললেন, আপনার কথা আমার শোনা উচিৎ নয়। কু্ন্তী ও সতীর মতো আপনি আমার ণ্ডরুপত্নীতুল্য। আপনি পুরুবংশের জননী, ণ্ডরুর অপেক্ষাও শ্রদ্ধেয়া। সেজন্যই অনিমেষ নয়নে আপনাকে দেখেছিলাম।উর্বশী বললেন, অর্জুন, আমাকে ণ্ডরুস্থানীয়া মনে করা অনুচিত, অপ্সরারা কোনো নিয়মাধীন নয়। পুরুবংশের পুত্র বা পৌত্র, যে কেউ স্বর্গে এলে আমাদের সঙ্গে সহবাস করেন। তুমি আমার কামনা পূর্ণ করো। অর্জুন বললেন, বরবর্ণিনী, আমি আপনার পায়ে মাথা রাখছি, আপনি আমার মায়ের মতো পূজনীয়া, আমি আপনার পুত্রের মতো। উর্বশী ভীষণ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে উর্বশী বললেন, পার্থ, আমি তোমার পিতার আদেশে স্বয়ং তোমার গৃহে কামার্তা হয়ে এসেছি তথাপি তুমি আমাকে আদর করলে না। এর ফলে তুমি সম্মানহীন নপৃংসক নর্তক হয়ে স্ত্রীদের মধ্যে বিচরণ করবে।এই বলে উর্বশী ফিরে গেলেন।
উর্বশী শাপ দিয়েছেন শুনে ইন্দ্র হাসিমুখে অর্জুনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বৎস, তোমার জন্য কুন্তী আজ সুপুত্রবতী হলেন। তুমি ধৈর্ষে ঋষিগণকেও পরাজিত করেছ। উর্বশীর অভিশাপ তোমার কাজে লাগবে, অজ্ঞাতবাসকালে তুমি এক বৎসর নপুংসক নর্তক হয়ে থাকবে, তারপর আবার পুরুষত্ব পাবে। অর্জুন নিশ্চিন্ত হয়ে চিত্রসেন গন্ধর্বের সঙ্গে সুখে স্বর্গবাস করতে লাগলেন।
______________
(ক্রমশ)