Featured Books
বিভাগ
শেয়ারড

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব 33

মহাভারতের কাহিনি – পর্ব-৩৩

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ এবং কৃষ্ণের শিশুপাল বধ

 

প্রাককথন

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস মহাভারত নামক মহাগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি এই গ্রন্থে কুরুবংশের বিস্তার, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, বিদুরের প্রজ্ঞা, কুন্তীর ধৈর্য, বাসুদেবের মাহাত্ম্য, পাণ্ডবগণের সত্যপরায়ণতা এবং ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণের দুর্বৃত্ততা বিবৃত করেছেন। নানা কাহিনি সংবলিত এই মহাভারতে সর্বমোট ষাট লক্ষ শ্লোক আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস পূর্বে নিজের পুত্র শুকদেবকে এই গ্রন্থ পড়িয়ে তার পর অন্যান্য শিষ্যদের শিখিয়েছিলেন। তিনি ষাট লক্ষ শ্লোকে আর একটি মহাভারতসংহিতা রচনা করেছিলেন, তার ত্রিশ লক্ষ শ্লোক দেবলোকে, পনের লক্ষ পিতৃলোকে, চোদ্দ লক্ষ গন্ধর্বলোকে এবং এক লক্ষ মনুষ্যলোকে প্রচলিত আছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসের শিষ্য বৈশম্পায়ন শেষোক্ত এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করেছিলেন। অর্জুনের প্রপৌত্র রাজা জনমেজয় এবং ব্রাহ্মণগণের বহু অনুরোধের পর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তাঁর শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত শোনাবার জন্য আজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সেইসব মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য, যাঁরা বিশালাকার মহাগ্রন্থ মহাভারত সম্পূর্ণ পাঠ করেছেন। অধিকাংশ মানুষই মহাভারতের কিছু কিছু গল্প পড়েছেন, শুনেছেন বা দূরদর্শনে সম্প্রসারিত ধারাবাহিক চলচ্চিত্রায়ণ দেখেছেন, যা মহাভারতের খণ্ডাংশ মাত্র এবং মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের বিষয়ীভূত ও শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নির্মিত।

মহাগ্রন্থ মহাভারত রচিত হয়েছে অসংখ্য কাহিনির সমাহারে, যে কাহিনিসমূহের অধিকাংশই কৌরব ও পাণ্ডবদের কাহিনির সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।

সেই সমস্ত কাহিনিসমূহের কিছু কিছু কাহিনি সহজবোধ্য ভাষায় সুহৃদ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে ধরাবাহিকভাবে উপস্থাপনা করার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস আশা করি ভালো লাগবে।

অশোক ঘোষ

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ এবং কৃষ্ণের শিশুপাল বধ

রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন সম্পূর্ণ হওয়ার পর যুধিষ্ঠির অত্যন্ত তৃপ্ত হোয়ে শুভদিন নির্ণয় কোরে অভিষেকের জন্য প্রস্তুত হলেন।

অভিষেকের দিনে আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ ও রাজাদের সঙ্গে নারদাদি মহর্ষিগণ যজ্ঞশালায় প্রবেশ করলেন। ঋষিগণ কাজের অবকাশে গল্প করতে লাগলেন। তর্কবাগীশ দ্বিজগণ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ভিন্ন ভিন্ন মতামত জানাতে লাগলেন। কয়েকজন সর্ববেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ধর্ম ও অর্থ বিষয়ক আলাপে মগ্ন হলেন।

যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞে সর্বদেশের রাজাগণ সমবেত হয়েছেন দেখে নারদ ভাবতে থাকলেন যেন সাক্ষাৎ নারায়ণ প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য ক্ষত্ৰকুলে জন্মেছেন। তিনি পূর্বে দেবগণকে আদেশ দিয়েছিলেন - তোমরা পরস্পরকে বধ করে পুনর্বার স্বর্গালোকে আসবে। ইন্দ্রাদি দেবতা যাঁর বাহুবল আশ্রয় করেন, তিনিই পৃথিবীতে অন্ধক-বৃষ্ণিদের বংশ উজ্জ্বল করেছেন। এই মহাবিস্তৃত বলশালী ক্ষত্রগণকে নারায়ণ নিজেই সংহার করবেন!

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এখন রাজাগণকে যথাযোগ্য অর্ঘ্য দেবার ব্যবস্থা করো। গুরু, পুরোহিত, আত্মীয়, ব্রাহ্মণ, বন্ধু ও রাজা এই ছয় জন অর্ঘ্যদানের যোগ্য। এঁরা বহুদিন পরে আমাদের কাছে এসেছেন। তুমি এঁদের প্রত্যেককেই অর্ঘ্য দিতে পারো অথবা যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তাকে দিতে পারো। যুধিষ্ঠির বললেন, পিতামহ, আপনি এঁদের মধ্যে একজনের নাম করুন যিনি অর্ঘ্যদানের যোগ্য। ভীষ্ম বললেন, জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে যেমন ভাস্কর, সেইরূপ সমাগত সকল জনের মধ্যে তেজ বল ও পরাক্রমে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ। সূর্য যেমন অন্ধকারময় স্থান আলোকিত করেন, বায়ু যেমন সর্বত্র বহমান, সেইরূপ কৃষ্ণ আমাদের এই সভা আলোকিত ও আমোদিত করেছেন।

ভীষ্মের অনুমতি নিয়ে সহদেব কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য যথাবিধি নিবেদন করলেন, কৃষ্ণও তা গ্রহণ করলেন। চেদিরাজ শিশুপাল কৃষ্ণের এই অর্ঘ্য সইতে পারলেন না, তিনি সভামধ্যে ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরকে ভৎর্সনা করে কৃষ্ণের নিন্দা করতে লাগলেন।

শিশুপাল বললেন, যুধিষ্ঠির, এখানে মহামহিম রাজারা উপস্থিত থাকতে কৃষ্ণ রাজার যোগ্য অর্ঘ্য পেতে পারেন না। তোমরা বালক, সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্ব জান না, ভীষ্মেরও বুদ্ধিলোপ হয়েছে। তারপর ভীষ্মকে বললেন, তোমার ন্যায় ধর্মহীন লোক নিজের প্রিয়কার্য করতে গিয়ে সাধুজনের অবজ্ঞাভাজন হয়। কৃষ্ণ রাজা নন, তিনি তোমাদের অর্ঘ্য কেন পাবেন? যদি বয়োবৃদ্ধকে অর্ঘ্য দিতে চাও তবে বসুদেব থাকতে তার পুত্রকে দেবে কেন? যদি কৃষ্ণকে পাণ্ডবদের হিতৈষী আর অনুগত মনে কর তবে হিতৈষী হিসাবে দ্রুপদ অর্ঘ্য পাবেন না কেন ? যদি কৃষ্ণকে আচার্য মনে কর, তবে আচার্য দ্রোণকে অর্ঘ্য দিলে না কেন? যদি কৃষ্ণকে পুরোহিত ভেবে থাক তবে দ্বৈপায়ন বেদব্যাস থাকতে কৃষ্ণকে অর্ঘ্য প্রদান করলে কেন? মহারাজ যুধিষ্ঠির, মৃত্যু যাঁর ইচ্ছাধীন সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম এখানে রয়েছেন, সর্বশাস্ত্রবিশারদ বীর অশ্বত্থামা, রাজেন্দ্র দুর্যোধন, ভরতকুলের আচার্য কৃপ, তোমার পিতা পাণ্ডুর ন্যায় গুণবান মহাবল ভীষ্মক, মদ্ৰরাজ শল্য এবং পরশুরামের প্রিয়শিষ্য বহু যুদ্ধজয়ী মহারথ কর্ণও এখানে আছেন — এঁদের কাউকেও অর্ঘ্য দেওয়া হোলো না কেন? কৃষ্ণের সমাদর করাই যদি তোমাদের উদ্দেশ্য হয় তবে অপমান করবার জন্য অন্য রাজাদের কেন ডেকে আনলে? আমরা যে কর দিয়েছি তা যুধিষ্ঠিরের ভয়ে, অনুরোধে বা লোভেও নয়। তিনি ধর্মকার্য করছেন, সম্রাট হোতে চান, এই কারণেই দিয়েছি। কিন্তু এখন ইনি আমাদের গ্রাহ্য করছেন না। যে দুরাত্মা অন্যায় উপায়ে জরাসন্ধকে নিহত করেছে, সেই ধর্মচ্যুত কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দিয়ে যুধিষ্ঠিরের ধর্মাত্মা-খ্যাতি নষ্ট হল। আর কৃষ্ণ, হীনবুদ্ধি পাণ্ডবরা অর্ঘ্য দিলেও তুমি অযোগ্য হয়ে কেন তা গ্রহণ করলে? কুকুর যেমন ঘী পেয়ে ভোজন করে কৃতার্থ হয়, তুমিও সেইরূপ অর্ঘ্য পেয়ে গৌরব বোধ করছ। পাণ্ডবগণ তোমাকে অর্ঘ্য দিয়ে উপহাস করেছে। নপুংসকের যেমন বিবাহ, অন্ধের যেমন রূপদর্শন, রাজা না হয়েও রাজযোগ্য অর্ঘ্য নেওয়া তোমার পক্ষে সেইরূপ। রাজা যুধিষ্ঠির কেমন, ভীষ্ম কেমন, আর এই কৃষ্ণও কেমন তা আমরা আজ দেখলাম। এই কথা বলে শিশুপাল স্বপক্ষীয় রাজাদের আসন থেকে উঠিয়ে সদলে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

যুধিষ্ঠির তখনই শিশুপালের পিছনে পিছনে গিয়ে মিষ্টবাক্যে বললেন, চেদিরাজ, তোমার কথা ন্যায়সংগত হয়নি, শান্তনুপুত্র ভীষ্মকে তুমি অবজ্ঞা করতে পার না। এখানে তোমার চেয়ে প্রবীণ বহু রাজা রয়েছেন, তারা যখন কৃষ্ণের অর্ঘ্য মেনে নিয়েছেন, তখন তোমার আপত্তি করা উচিত নয়। কৃষ্ণকে ভীষ্ম যেমন জানেন, তুমি তেমন জান না।

ভীষ্ম বললেন, যিনি ত্রিভূবনের মধ্যে প্রবীণতম সেই কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দেওয়ায় যার সম্মতি নেই সে অনুরোধ বা মিষ্টবাক্যের যোগ্য নয়। কৃষ্ণ কেবল আমাদের অর্চনীয় নন, ইনি ত্রিভূবনে সকলের অর্চনীয়। বহু ক্ষত্রিয়কে কৃষ্ণ যুদ্ধে জয় করেছেন, সমগ্র জগৎ তার প্রতিষ্ঠিত, সেজন্য অনেক বৃদ্ধ রাজারা এখানে থাকলেও আমি কৃষ্ণকেই অর্চনীয় মনে করি। জন্মাবধি ইনি যা করেছেন তা আমি যেমন বহুলোকের কাছে বহুবার শুনেছি, তেমন অনেকেই জানেন। এই সভায় উপস্থিত বালক বৃদ্ধ সকলকে পরীক্ষার পর কৃষ্ণের যশ, শৌর্য ও জয় জেনেই আমরা তাকে অর্ঘ্য দিয়েছি। ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যিনি সর্বাধিক বলশালী, বৈশ্যদের মধ্যে যিনি সর্বাধিক ধনী, এবং শূদ্রদের মধ্যে যিনি বয়োবৃদ্ধ, তিনিই বৃদ্ধ রূপে গণ্য হন। দুটি কারণে কৃষ্ণ সকলের পূজ্য — বেদ বেদাঙ্গের জ্ঞান এবং অমিত বিক্রম। নরলোকে কৃষ্ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কে আছে? দানশীলতা, দক্ষতা, বেদজ্ঞান, শৌর্য, শালীনতা, কীর্তি, উত্তম বুদ্ধি, বিনয়, ধৈর্য, বুদ্ধি, সমস্তই কৃষ্ণে বিদ্যমান। ইনি ঋত্বিক, গুরু, আত্মীয়, ব্রাহ্মণ, রাজা, বন্ধু সবই, সেজন্য আমরা এঁকে অর্ঘ্য দিয়েছি। কৃষ্ণই সর্বলোকের উৎপত্তি ও বিনাশের কারণ, ইনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান, এই অর্বাচীন শিশুপাল তা বোঝে না তাই অমন কথা বলেছে। সে যদি মনে করে যে কৃষ্ণের পূজা অন্যায়, তবে তার যা ইচ্ছা করুক।

সহদেব বললেন, যিনি কেশীকে নিহত করেছেন, যাঁর পরাক্রম অসীম, সেই কৃষ্ণকে আমি অর্ঘ্য দিয়েছি। ওহে রাজাগণ, আপনাদের মধ্যে যাঁরা বুদ্ধিমান আছেন তারা মানুন যে কৃষ্ণই অর্ঘ্যদানের যোগ্য। ভূত-ভবিষ্যৎ বক্তা সর্বজ্ঞ নারদ বললেন, কৃষ্ণকে যারা অর্চনা করে না তারা জীবনমৃত, তাদের সঙ্গে কখনও কথা বলা উচিৎ নয়।

তারপর সহদেব অর্ঘ্যদান কার্য শেষ করলেন। কৃষ্ণকে অর্ঘ্যদান হোয়ে গেলে, শিশুপাল ক্রোধে চোখ লাল কোরে রাজাদের বললেন, আমি আপনাদের সেনাপতি, আদেশ দিন, আমি বৃষ্ণি আর পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। শিশুপাল ও তার সমর্থ্ক সকল রাজাই ক্রোধে বলতে লাগলেন, যুধিষ্ঠিরের অভিষেক আর বাসুদেবের অর্ঘ্য যাতে পণ্ড হয় তাই আমাদের করতে হবে। তারা নিজেদের অপমানিত মনে করে ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হলেন। কৃষ্ণ বুঝলেন যে এই সমস্ত রাজাগণ যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে।

যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বললেন, পিতামহ, এই বিশাল সংখ্যক রাজাগণ যাতে যজ্ঞের বিঘ্ন না করতে পারে এবং আমাদের মঙ্গল হয়, সেই বিষয়ে উপদেশ দিন। ভীষ্ম বললন, ভয় পেয়ো না, কুকুরের দল যেমন ঘুমন্ত সিংহের নিকটে এসে ডাকে, এই রাজারাও তেমনি কৃষ্ণের নিকট চিৎকার করছে। অল্পবুদ্ধি শিশুপাল সকল রাজাকেই যমালয়ে পাঠাতে উদ্যত হয়েছে। কৃষ্ণ যাকে বিনাশ করতে ইচ্ছা করেন তার এইপ্রকার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে।

শিশুপাল বললেন, কুলাঙ্গার ভীষ্ম, তুমি বৃদ্ধ হয়ে রাজাদের ভয় দেখাচ্ছ, তোমার লজ্জা নেই? তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে একজন গোপের স্তব করতে চাও! বাল্যকালে কৃষ্ণ পুতনাকে বধ করেছিল, যুদ্ধে অক্ষম অশ্বাসুর আর বৃষভাসুরকে মেরেছিল, একটা কাঠের শকট পা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল, এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? সপ্তাহকাল গোবর্ধন ধারণ করেছিল যা একটা উইঢিবির সমান মাত্র এবং বিচিত্র কিছু নয়। যে কংসের অন্ন কৃষ্ণ ভোজন করতো তাকেই সে হত্যা করেছে এইটেই পরমাশ্চর্য। ধার্মিক সাধুরা বলেন, স্ত্রী, গো, ব্রাহ্মণ, অন্নদাতা, আর আশ্রয়দাতার উপর অস্ত্রাঘাত করবে না। এই কৃষ্ণ গোহত্যা ও স্ত্রীহত্যা করেছে, আর তোমার উপদেশে তাকেই অর্ঘ্যদান করা হয়েছে। তুমি বলেছ, কৃষ্ণ বুদ্ধিমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণ জগতের প্রভু, কৃষ্ণও তাই ভাবে। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, তুমি নিজেকে প্রাজ্ঞ মনে করো, তবে অন্য পুরুষে আকৃষ্টা কাশীরাজকন্যা অম্বাকে হরণ করেছিলে কেন? তুমি প্রাজ্ঞ, অথচ তোমার সম্মুখে অন্য একজন তোমার ভাইয়ের স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। তোমার কোনো ধর্ম আছে? তোমার ব্রহ্মচর্যও মিথ্যা, ক্লীবত্বের জন্য তুমি ব্রহ্মচারী হয়েছ। নিঃসন্তানের যজ্ঞ, দান, উপবাস সবই ব্যর্থ। একটি প্রাচীন কাহিনি শোন - এক বৃদ্ধ হংস সমুদ্রতীরে বাস করত, সে মুখে ধর্মকথা বলত কিন্তু তার স্বভাব বিপরীত ছিলো। সেই সত্যবাদী হংস সর্বদা বলত, ধর্মাচরণ কর, অধর্ম করো না। অন্য পক্ষীরা সমুদ্র থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে তাকে দিত এবং তার কাছে নিজেদের ডিম রেখে যেত। সেই পাপী হংস সুবিধা পেলেই ডিমগুলি খেয়ে ফেলত। অবশেষে জানতে পেরে পক্ষীরা সেই মিথ্যাচারী হংসকে মেরে ফেলেছিল। ভীষ্ম, এই ক্রুদ্ধ রাজারা তোমাকেও সেই হংসের ন্যায় বধ করবেন।

তার পর শিশুপাল বললেন, মহাবল জরাসন্ধ রাজা আমার অতিশয় সম্মানের পাত্র ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে দাস মনে করতেন তাই তার সঙ্গে যুদ্ধ করেননি। কৃষ্ণ ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পিছনের দ্বার দিয়ে গিরিব্রজপুরে প্রবেশ করেছিল। ব্রাহ্মণভক্ত জরাসন্ধ কৃষ্ণ আর ভীম ও অর্জুনকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণ তা নেয়নি। মুর্খ ভীষ্ম, কৃষ্ণ যদি জগতের কর্তা হয় তবে নিজেকে ব্রাহ্মণ মনে করে না কেন?

শিশুপালের কথা শুনে ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন, তার নয়ন রক্তবর্ণ হল। তিনি ক্রোধে সবেগে আসন থেকে উঠলেন, কিন্তু ভীষ্ম তাকে ধরে নিরস্ত করলেন। শিশুপাল হেসে বললেন, ভীষ্ম, ওকে ছেড়ে দাও, রাজারা দেখুন ও আমার তেজে পতঙ্গের মতো দগ্ধ হবে। ভীষ্ম বললেন, এই শিশুপাল তিনটি চোখ আর চার হাত নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এবং জন্মকালে গর্দভের ন্যায় চিৎকার করেছিল। এর মা বাবা  ভয় পেয়ে একে ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তখন দৈববাণী হল -রাজা, তোমার পুত্রটিকে পালন কর, এর মৃত্যুকাল এখনও আসে নি, যদিও এর মৃত্যুদণ্ডদাতা জন্মগ্রহণ করেছেন। শিশুপালের জননী নমস্কার করে বললেন, আপনি দেবতা বা অন্য যাই হোন, বলুন কার হাতে এর মৃত্যু হবে। পুনর্বার দৈববাণী হল — যিনি কোলে নিলে এর অতিরিক্ত দুই হাত খসে যাবে এবং যাঁকে দেখে এর তৃতীয় নয়ন লুপ্ত হবে, তিনিই এর মৃত্যুর কারণ হবেন। চেদিরাজের অনুরোধে বহু সহস্র রাজা শিশুকে কোলে নিলেন, কিন্তু কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। কিছুকাল পরে বলরাম ও কৃষ্ণ তাঁদের পিসিকে (শিশুপালের মা) দেখতে এলেন। শিশুপালের মা কুশল প্রশ্ন করে শিশুটিকে কৃষ্ণের কোলে দিলেন, তৎক্ষণাৎ তার অতিরিক্ত দুই বাহু খসে গেলো, তৃতীয় চোখ কপালে মিলিয়ে গেলো। মহিষী বললেন, কৃষ্ণ, আমি ভয়ার্ত হয়েছি, তুমি বর দাও যে শিশুপালের অপরাধ ক্ষমা করবে। কৃষ্ণ উত্তর দিলেন, পিসি, ভয় নেই, আমি এর একশত অপরাধ ক্ষমা করবো। ভীম, এই মন্দমতি শিশুপাল কৃষ্ণের বরে অন্ধ হয়েই তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছে। এই বুদ্ধি এর নিজের নয়, কৃষ্ণের ইচ্ছাতেই শিশুপাল এমন করছে।

শিশুপাল বললেন, ভীষ্ম, যদি স্তব করেই আনন্দ পাও তবে বাহ্মীকরাজ, মহাবীর কর্ণ, অশ্বত্থামা, দ্রোণ, জয়দ্রথ, কৃপ, ভীষ্মক, শল্য প্রভৃতির স্তব করো না কেন? তুমি এই সব ভূপতিদের ইচ্ছায় বেঁচে আছ। ভীষ্ম বললেন, চেদিরাজ, যাদের ইচ্ছায় আমি বেঁচে আছি সেই রাজাদের আমি তৃণতুল্যও জ্ঞান করি না। ভীষ্মের কথায় কেউ হাসলেন, কেউ গালি দিলেন, কেউ বললেন, একে পুড়িয়ে মার। ভীষ্ম বললেন, যে কৃষ্ণকে আমরা অর্ঘ্যদান করেছি তিনি এখানেই রয়েছেন, মরবার জন্য যে ব্যস্ত হয়েছে সে কৃষ্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করুক।

শিশুপাল বললেন, কৃষ্ণ, তোমাকে আহ্বান করছি, আমার সঙ্গে যুদ্ধ কর, সমস্ত পাণ্ডবদের সঙ্গে আজ তোমাকেও বধ করব। তুমি রাজা নও, কংসের দাস, পূজার অযোগ্য। যে পাণ্ডবরা বাল্যকাল থেকে তোমার অর্চনা করছে তারাও আমার বধ্য।

কৃষ্ণ কোমল স্বরে সমবেত রাজাদেরকে বললেন, রাজাগণ, যাদবরা এই শিশুপালের কোনও অপকার করেনি তথাপি এ আমাদের শত্রুতা করেছে। আমরা যখন প্ৰাগজ্যোতিষপুরে যাই তখন আমাদের পিসির পুত্র হয়েও এই নৃশংস দ্বারকা অগ্নিদগ্ধ করেছিল। ভোজরাজ রৈবতকে বিহার করছিলেন, তাঁর সহচরদের অনেককে শিশুপাল হত্যা করেছিল ও অনেককে বন্দি করে নিজ রাজ্যে নিয়ে যায়। এই পাপাত্মা আমার পিতার অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব হরণ করেছিল। এই নৃশংস ছদ্মবেশে মামার মেয়ে ভদ্রাকে করুষ রাজার জন্য হরণ করেছিল। আমার পিসির জন্য আমি সব সয়েছি, কিন্তু শিশুপাল আজ আপনাদের সমক্ষে আমার প্রতি যে আচরণ করেছে তা আপনারা দেখলেন। এই অন্যায় আমি ক্ষমা করতে পারবো না। এই মূর্খ রুক্মিণীকে চেয়েছিল, কিন্তু পায়নি।

বাসুদেবের কথা শুনে রাজারা শিশুপালের নিন্দা করতে লাগলেন। শিশুপাল বললেন, কৃষ্ণ, পূর্বে রুক্মিণীর সঙ্গে আমার বিবাহের সম্বন্ধ হয়েছিল এই কথা এখানে বলতে তোমার লজ্জা হল না? তুমি ক্ষমা করো বা না করো, ক্রুদ্ধ হও বা প্রসন্ন হও, তুমি আমার কি করতে পারো?

শিশুপালের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ চক্র দিয়ে শিশুপালের দেহ থেকে মাথা কেটে ফেললে শিশুপাল ভূপতিত হলেন। রাজারা দেখলেন, আকাশ থেকে সূর্যের মতো এক উজ্জ্বল তেজ শিশুপালের দেহ থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণকে প্রণাম করে তাঁর দেহে প্রবেশ করলো। সেই সময় বিনা মেঘে বৃষ্টি ও বজ্রপাত হোলো, ধরিত্রী কেঁপে উঠল, রাজারা কৃষ্ণকে দেখতে লাগলেন কিন্তু তাদের মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হোলো না। মহর্ষিগণ, মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং মহাবল রাজাগণ কৃষ্ণের স্তুতি করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভাইদের আদেশ দিলেন যেন সত্বর শিশুপালের সৎকার করা হয়। তার পর যুধিষ্ঠির ও সমবেত রাজারা শিশুপালপুত্রকে চেদিরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।

তার পর নির্বিঘ্নে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হল। স্বয়ং কৃষ্ণ শেষ পর্যন্ত যজ্ঞ রক্ষা করলেন। যুধিষ্ঠির যজ্ঞ শেষে স্নান করলে সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজারা তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, ভাগ্যক্রমে আপনি সাম্রাজ্য পেয়েছেন এবং বংশের যশোবৃদ্ধি করেছেন। এই যজ্ঞে মহৎ ধর্মকার্য করা হয়েছে, আমরাও সর্বপ্রকারে তৃপ্ত হয়েছি। এখন অনুমতি দিন আমরা নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যাবো। কৃষ্ণ বিদায় চাইলে যুধিষ্ঠির বললেন, তোমার কৃপায় আমার যজ্ঞ সুসম্পন্ন হয়েছে, সমগ্র ক্ষত্রিয়মণ্ডল আমার বশে এসেছে। কি বলে তোমাকে বিদায় দেব? তোমার অভাবে আমি স্বস্তি পাবো না। তার পর সুভদ্রা ও দ্রৌপদীকে মিষ্টবাক্যে তুষ্ট করে কৃষ্ণ গরুড়ধ্বজ রথে দ্বারকায় ফিরে গেলেন।

______________

(ক্রমশ)